আজও রহস্যে ঘেরা দুইশ বছর আগের ‘সোনার নৌকা’

0
526

১৯৮০-৯০ সাল পর্যন্ত নৌকাটি দেখা যেত কুয়াকাটার জিরো পয়েন্ট থেকে দুই কিলোমিটার পূর্বে সমুদ্রসৈকত থেকে প্রায় এক হাজার মিটার দূরে বনের ভেতরে একটি বড় কূপের মধ্যে। সোনার নৌকা দেখার জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে কখনো হেঁটে কখনো ইটের রাস্তায় ভ্যানে করে লোকজন ছুটে আসতো।

কূপের পাশে দাঁড়িয়ে বিশালাকৃতির নৌকাটি দেখে মানুষ অবাক হতো আর ভুলে হেটে আসার কষ্টটুকু। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড় ‘ম্যারিয়েন’র কারণে জলোচ্ছ্বাস হলে বালুতে ঢেকে যায় নৌকাটি। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে এলোমেলা হয়ে যায় কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকত।

ঘূর্ণিঝড়ে ব্যাপক বালুকক্ষয়ের কারণে সি-বিচ এলাকায় বেরিয়ে আসে নৌকাটির উপরিভাগের কিছু অংশ। কখনো বালুর স্তর পড়ে ঢেকে যায় আবার কখনো বালুক্ষয়ে নৌকাটি বেরিয়ে আসার খবর প্রচার হয় গণমাধ্যমে। এভাবে কয়েক বছর পরে এর ওপর দৃষ্টি পড়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের।

বিভিন্ন গবেষণার পর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ উদ্যোগ নেয় আদি নিদর্শন হিসেবে এটিকে উদ্ধার করার। ২০১২ সালে নৌকা বিশেষজ্ঞ ইভস মেরিকে প্রধান করে ২৩ ডিসেম্বর নৌকাটি মাটির নিচ থেকে আনুষ্ঠানিক উত্তোলনের কাজ শুরু করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর।

সেই থেকে ২০১৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন প্রযুক্তি আর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় নৌকাটি উদ্ধার করে সংরক্ষণ করা হয় কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টের পাশে। পরবর্তী গবেষণায় বেরিয়ে আসে অনেক তথ্য।

৭২ ফুট দৈর্ঘ্য আর ২৪ ফুট প্রস্থের নৌকাটি তৈরি করা হয় অন্তত ২০০ বছর আগে। স’মিল বা আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকায় তখনকার সময় ছেনি বা কুঠার দিয়ে তেমন কোনো ফিনিশিং ছাড়াই তৈরি করা হয় এই নৌকাটি।

ব্যবহার করা হয় লোহাকাঠ, শালকাঠ ও অর্জুন কাঠ। পুরো একটি গাছ দিয়েই তৈরি করা হয় নৌকার বাহা, গছা ও গুড়ার কাজ। পাতাম বা গজাল লোহার পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় লোহার রড। এরপর নৌকার বাইরে আটকে দেয়া হয় পিতলের সোনালি সিট।

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বিশেষজ্ঞ দলের ধারণা- ৯০ টন ওজনের এই নৌকাটি অন্তত ২০০ বছরের পুরনো, এটি রাখাইনদের তৈরি নৌকা হতে পারে।

নৌকা থেকে উদ্ধার করা হয় তামার তৈরি পেরেক, নারকেলের মালাই, নারকেলের ছোবলা দিয়ে বানানো রশি, ভাঙা মৃৎপাত্রের টুকরো, পাটের তৈরি ছালার নিদর্শন, ভারী ও বিশালাকৃতির শিকলসহ তামার পাত। তবে নৌকাটির বহিরাংশে থাকা পিতলের পাতগুলো পানিতে থাকা অবস্থায় এবং পরবর্তীতে উত্তোলনের সময় স্বর্ণের পাত মনে করে লোকজন কেটে নিয়ে যায়।

রাখাইন নেতা উচাচি মাতুব্বর বলেন, ‘এই নৌকা আমাগো পূর্ব পুরুষরাই বানাইছে। এই নৌকায় আমাগো পূর্ব পুরুষরা আরাকান দিয়া এই দেশে আইছে। এমন অনেক নৌকা এই দেশে আইছে’।

তিনি আরও জানান, ১৭৮৪ সালের রাখাইনরা আরাকান থেকে এইসব নৌকাতে চড়ে বাংলাদেশে আসে। সেই নৌকাই এমন।

সমুদ্র সৈকত এলাকায় বেড়ে ওঠা শতবর্ষ ছুঁই ছুঁই বৃদ্ধ আতাহার আলি বলেন, ‘আগেতো মানসে এই নৌকারে সোনার নৌকা কইতো। নৌকাডা আছেলে একটা বড় কূয়ার মধ্যে। তহন হুনছি এই দ্যাশে মগেরা আইছে এই নৌকায়’।

স্থানীয় রাখাইন ইতিহাস বলে ১৭৮৪ সালে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে সাম্প্রদায়িক কোন্দলে বিতাড়িত হয়ে ১৫০টি পরিবার ৫০টি নৌকাযোগে বাংলাদেশের কক্সবাজার, রাঙ্গাবালী, কুয়াকাটা, বরগুনাসহ দক্ষিণ উপকূলের কয়েকটি স্থানে আশ্রয় নেয়। পরে এসব এলাকাতেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন রাখাইনরা।

কখনো সোনার নৌকা, কখনো আজব নৌকা, আবার কখনো রাখাইন নৌকা – যেই নামেই ডাকা হোক না কেন ২০০ বছরের বেশি সময় পানি আর মাটির নিচে চাপা থাকলেও বিশালাকৃতির এই আদি নৌকাটি এখন কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টের পাশে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে পর্যটকদের জন্য। যা দেখতে ভিড় জমায় তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

19 − fifteen =