নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত পুনঃতফসিল আনুযায়ী গত২৭জানুয়ারি ২০২১ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও ৩১ নং সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী তারেক সোলেমান সেলিম মৃত্যুবরণ করায় উক্ত ওয়ার্ডের নির্বাচন গত ২৮ ফেব্র“য়ারি ২০২১ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিজয়ীদের তথ্যের বিশ্লেষণ তুলে ধরতে আজ ১৫ মার্চ ২০২১ সকাল ১১টায় সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিকের উদ্যোগে একটি অনলাইন সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সুজন সভাপতি জনাব এম হাফিজউদ্দিন খান। এছাড়া সংবাদ সম্মেলনেসাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, অধ্যাপক সিকান্দর খান, সুজন স¤পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।লিখিত বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেনসংগঠনটির কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার। দিলীপ কুমার সরকারবলেন, বিজয়ী সকল জনপ্রতিনিধির মধ্যে স্বল্পশিক্ষিতের (এসএসসি ও তার নিচে) তুলনায় উচ্চশিক্ষিতের (স্নাতক ও স্নাতকোত্তর) হার কিছুটা বেশি। তবে বিজয়ী সংরক্ষিত ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মধ্যে সিংহভাগই (৬৪.২৮%) স্বল্পশিক্ষিত।
বিজয়ীদের মধ্যেএকচতুর্থাংশ (২৫%) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারেননি। বিজয়ীদের পেশা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অন্যান্য নির্বাচনের মত এই নির্বাচনেও ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য ছিল; বিজয়ীদের মধ্যে ব্যবসায়ীর হার ৮০.৩৬%। মামলার ক্ষেত্রে সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে মামলার আধিক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বর্তমান মামলা ২৮.৮৭% থাকলেও বিজয়ীদের মধ্যে এই হার ১৪.২৮%। অপর দিকে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অতীত মামলা ২২.১৮% থাকলেও বিজয়ীদের মধ্যে এই হার ৩৫.৭১%।বিজয়ীদের মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ (৩২.১৪%) বছরে ৫ লক্ষ টাকা বা তার কম আয় করেন। তবে অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি (৫১.২৯%) আয় করেন ৫ লক্ষ থেকে ২৫ লক্ষ পর্যন্ত।
বছরে কোটি টাকার অধিক আয়কারী জনপ্রতিনিধির ৩.৫৭%।প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে ২৪ জন (১০.০৪%) ছিলেন ঋণ গ্রহীতা। নির্বাচিতদের মধ্যে এই হার ১০.৭১%। ফলে বিশ্লেষণে বলা যায় প্রতিদ্ব›িদ্বতার তুলনায় নির্বাচিতদের মধ্যে ঋণ গ্রহীতার হার সামান্য হলেও হ্রাস পেয়েছে।
ভোটের দিনের পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনিবলেন, ভোটের দিন বেশ কিছু ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষের ঘটনা এবং একজনের প্রাণহানি ঘটনা, বিএনপি’র পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়া,
পোলিং এজেন্টদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া, সরকারি দল কর্তৃক ভোটকেন্দ্রের প্রবেশ পথসহ আশেপাশে মহড়া দিয়ে এলাকাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, বুথ ক্যাপচার করে একজনের ভোট আর একজন দিয়ে দেওয়া,
গোপন বুথে অবাঞ্ছিত ব্যক্তির উপস্থিতি এবং ভোটারের পরিবর্তে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি কর্তৃক ভোট প্রদানের বাটন টিপে দেওয়া, কোনো কোনো কেন্দ্রে মেয়র প্রার্থীর ভোট প্রকাশ্য দিতে বাধ্য করা,
নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিতরাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষপাতমূলক আচরণ, ৪টি ইভিএম ভেঙ্গে ফেলা, দুইজন কাউন্সিলর প্রার্থীর (একজন বিএনপি সমর্থিত এবং একজন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী) গ্রেফতার হওয়া, অভিযোগ পাওয়ার পরেও নির্বাচন কমিশন কর্তৃক কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া, ইভিএম-এ ভোট হলেও ১০ ঘন্টা পর ফলাফল ঘোষণা,
ভোট কম পড়া (২২.৫২%) ভোটের হার বাড়িয়ে দেখানো, ফলাফল পাল্টে দেওয়া ইত্যাদি ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। ফলাফল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গিয়েছে মেয়র পদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোঃ রেজাউল করিম চৌধুরী বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছেন।
তিনি পেয়েছেন ৩,৬৯,২৪৮ ভোট (প্রদত্ত ভোটের ৮৪.৬৮%)। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রার্থী শাহাদাত হোসেন পেয়েছেন মাত্র ৫২,৪৮৯ ভোট (প্রদত্ত ভোটের ১২.০৪%)।
অন্যান্য মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী জান্নাতুল ইসলাম ৪,৯৮০ ভোট; ন্যাশনাল পিপল্স পার্টির প্রার্থী আবুল মনজুর ৪,৬৫৩ ভোট; বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের প্রার্থী এম এ মতিন ২,১২৬ ভোট; ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের প্রার্থী মুহাম্মদ ওয়াহেদ মুরাদ ১,১০৯ ভোট এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী খোকন চৌধুরী ৮৮৫ ভোট পেয়েছেন।
কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে বিএনপি প্রার্থীর ২২টি কেন্দ্রে ০ ভোট পাওয়া, আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ১৫টি কেন্দ্রে প্রাপ্ত ভোটের শতভাগ অর্থাৎ সবকটি ভোট পাওয়া, ৭৩৩টি কেন্দ্রের মধ্যে বিএনপির প্রার্থীর মাত্র ২টি কেন্দ্রে জেতা, ভোটের গড় হার ২২.৫৩% হওয়া সত্তে¡ও প্রায় অর্ধশতাধিক কেন্দ্রে ৮০ ভাগের বেশি ভোট পড়া, কয়েকবার ফলাফল ঘোষণা করা প্রভৃতি অসঙ্গতি লক্ষ করা গিয়েছে।
এম হাফিজউদ্দিন খানবলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর কারও কোনো আস্থা নাই। তাঁরা দায়িত্ব পালনে যেমন ব্যর্থতার পরচিয় দিচ্ছেন তেমনি বিভিন্ন আর্থিক দুর্নীতিতেও লিপ্ত হয়েছেন, যা সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে কমিশনের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণè করেছে।
তাই ৪২ নাগরিকের সুপ্রীম কাউন্সিল গঠনের দাবির প্রতি আমরা সমর্থন জানিয়ে এই কমিশনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি। ড. এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ইভিএমে কয়েক ঘন্টার মধ্যে ফলাফল দেওয়া সম্ভব সেখানে ফলাফল দিতে এত দেরি করা হলো,
তারপর ইভিএমে বাতিল ভোট আসে কীভাবে? একটা ইতিবাচক দিক ছিল ট্রাইবুনালে মামলা হওয়া। যেভাবে ইলেকশন করা হয়ছে তাতে এটি একটি ভালো নির্বাচন হয়েছে বলে আমি মনে করি নাড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন,গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন প্রভাবিত হলে জনগণের প্রতিনিধি স্বাধীনভাবে বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে না।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন কমিশন এবং ইভিএমের বিশ্বাসযোগ্যতাকে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আমাদের ব্যবহৃত ইভিএম অন্ত্যন্ত নিæমানের এবং এতে ভিভিপিএটিও সংযুক্ত নেই। ফলে একটা ডিজিটাল জালিয়াতির সুযোগ থেকে যায়।অধ্যাপক সিকান্দর খান বলেন, আমরা আশা করেছিলাম চট্টগ্রামের নির্বাচনটি একটা ভালো নির্বাচন হবে, কিন্তু আমাদের আশা পূরণ হয়নি। বিএনপির লোকদের মাঠে তেমন একটা দেখা যায়নি, মাঠে উপস্থিত থাকলে তারা হয়ত আরো ভালো করতে পারতো। ।