বোমার স্প্লিন্টারে ক্ষতবিক্ষত একুশ আগস্ট

0
906

মো. এনামুল হক লিটন: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্ব-পরিবারে হত্যা করেছে একদল বিপদগামী সেনা সদস্য। যা ইতিহাসের একটি বেদনাক্লিষ্ট ও কলঙ্কজনক অধ্যায়। এরপর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে আরো একটি রক্তাক্ত, বর্বরোচিত ও কলঙ্কিত অধ্যায় রচিত হয়েছিল। প্রতিবছর যখন বর্বরোচিত ও কলঙ্কিত ১৫ ও ২১ আগস্ট আমাদের মাঝে ফিরে আসে, আমাদের গা তখন শিউরে ওঠে। বিশেষ করে একুশ আগস্ট এলে এখনো আঁতকে ওঠেন যারা স্বজন হারিয়েছেন, হারিয়েছেন রাজনৈতিক সহ-যাত্রী, বন্ধু, সহকর্মী। সেই স্মৃতি আজও অমলিন হয়ে আছে। সেদিনের নিক্ষিপ্ত বোমার স্প্লিন্টারের ক্ষত, আজও যারা শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন, তাঁরা কত যে দূর্বিসহ জীবন-যাপন করছে, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। সেদিন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে দলটির মিছিলপূর্ব এক সমাবেশে পৈশাচিক এই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল ঘাতকচক্র। ওই হামলার মূল টার্গেট ছিলেন, তৎকালীন বিরোধিদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কণ্যা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের কেন্দ্রিয় নেতৃবৃন্দ। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই হামলায় অল্পের জন্য রক্ষা পেলেও মর্মান্তিকভাবে নিহত হন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনী ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভী রহমানসহ দলের ২৪ নেতা কর্মী। আহত হন আরো ৫ শতাধিক। ওই সময়ে বঙ্গবন্ধু তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও তাঁর শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূণ্য করাই ছিল হামলার মূল উদ্দেশ্য। বলাবাহুল্য যে, স্বাধীনতা বিরোধি ঘাতকচক্র এদেশকে নের্তৃত্ব ও মেধাশূণ্য করতে বহুবার চেষ্টা করেছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাসহ এ নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা এবং বঙ্গবন্ধু কণ্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর করা ১৯ বার হত্যা প্রচেষ্টা একই গোষ্ঠির যড়যন্ত্রের অংশ বলে প্রতিয়মান হয়।

গ্রেনেড হামলা নিয়ে তৎকালিন সরকারের পক্ষ থেকে অনেক নাটকীয়তার ব্যাপারে দেশবাসী ওয়াকিবহাল। যা-ই হোক পরবর্তীকালে সেনা সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকার এই পাশবিক হামলার ঘটনার তদন্ত করে ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে জঙ্গী সংগঠন হরকত-উল-জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করে দুটি পৃথক মামলা দায়ের করে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে বিজ্ঞ আদালত এই বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয়। পুনঃতদন্ত শেষে ২০১১ সালের ৩ জুলাই আরও কয়েকজনকে অভিযুক্ত করে একটি সম্পূরক চার্জশীট আদালতে জমা দেয়া হয়। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর বহুল আলোচিত ও নৃশংসতম ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায় দিয়েছেন, বিজ্ঞ আদালত।

রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদন্ড, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ অপর ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং আরো ১১ জন সরকারি কর্মকর্তাকে আসামি করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখা ও বিরোধীদলের সঙ্গে সরকারের কী ধরনের মনোভাব ধাকা উচিত, তা নিয়ে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণও দিয়েছেন আদালত।

এর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটেছে, সেদিনের বোমার স্পিøন্টারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যারা তাকিয়ে ছিলেন বিচারের দিকে, তাদের এবং নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের বিচারের অপেক্ষার। সেই সাথে এই কলঙ্কের দায় থেকেও মুক্তি পেয়েছে পুরো জাতি। বাংলাদেশও এগিয়ে গেছে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার আরেকটি ধাপে। বর্বরোচিত ওই হামলার সময় আজকের প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে বাচাঁতে নেতা, নেত্রী-কর্মিরা চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে রচনা করেছিলেন মানববর্মের।

নিজেদের জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে নেতা-নেত্রীরা এই মানববর্ম তৈরী করে নজির স্থাপন করেছিলেন সেদিন। কতটুকু ভালোবাসা আর আন্তরিকতা থাকলে, এমনটি করা যায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা চাই দেশের প্রতি এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের প্রতি এই ভালোবাসা অটুট থাকুক।

সেই সাথে আমাদের সমৃদ্ধ বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অগ্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও অনেক বছর আমাদের মাঝে বেচেঁ থাকুক। এমনটাই প্রত্যাশা করছি।
সেদিন যা ঘটেছিল : সিলেটসহ দেশের বিভিন্নস্থানে উপর্যুপরী বোমা হামলার প্রতিবাদে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট দলের কেন্দ্রিয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সমাবেশ ছিল।

সমাবেশ শেষে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও তৎকালীন বিরোধিদলীয় নেতা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শান্তি মিছিল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সমাবেশ শুরুর পূর্ব মুহুত্বে ট্রাকের উপর নির্মিত খোলা মঞ্চে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়া মাত্র ঘড়ির কাটা ঠিক বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে তাঁকে লক্ষ্য করে মুহুমুহু গ্রেনেড হামলা শুরু হয়। বিকট শব্দে একের পর এক ১৩টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। অল্পের জন্য প্রাণে  বেঁচে যান শেখ হাসিনা।

এতেও ক্ষান্ত হয়নি ঘাতকচক্র। শেখ হাসিনার গাড়ি লক্ষ্য করে পরপর ১২ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে দূর্বৃত্তরা। বর্বরোচিত ও নরকীয় ওই হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন প্রাণ হারান। আহত হন আরো ৫ শতাধিক নেতাকর্মী। বোমার স্প্লিন্টারে ক্ষতবিক্ষতদের অনেকে এখনও তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে দিনাতিপাত করছে।

ওই হামলা থেকে আওয়ামী লীগ সভানেন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে গিয়ে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের মাথায় অসংখ্য স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়। প্রায় আড়াই বছর অসহ্য যন্ত্রনা ভোগ এবং দেশ বিদেশে চিকিৎসার পর ২০০৬ সালের ২৭ নভেম্বর মারা যান তিনি।
-মো. এনামুল হক লিটন, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, প্রগতিশীল সংবাদপত্র পাঠক লেখক ফোরাম, কেন্দ্রিয় কমিটি।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

18 − four =