খালেদা জিয়া ৮০ দিন পর নিজ বাসায়

0
248

দীর্ঘ ৮০ দিন রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর বাসায় ফিরলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। হাসপাতালের ছাড়পত্র পাওয়ার পর মঙ্গলবার রাত পৌনে ৯টার দিকে গুলশানের ভাড়া বাসা ‘ফিরোজায়’ পৌঁছান তিনি।এর আগে এক সংবাদ সম্মেলনে তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদার জানান, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা আপাতত স্থিতিশীল। তবে সেটি অপরিবর্তিত থাকবে কিনা তা বলা যাচ্ছে না।

করোনা সংক্রমণের কারণে হাসপাতালে স্বাস্থ্যঝুঁকি চিন্তা করে বাসায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এভারকেয়ারে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানেই বাসায় তার চিকিৎসা চলবে। উন্নত চিকিৎসার জন্য মেডিকেল বোর্ড মনে করে তাকে দ্রুত বিদেশে নেওয়া প্রয়োজন বলেও জানান এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

খালেদা জিয়ার শারীরিক সর্বশেষ অবস্থা জানাতে এভারকেয়ার হাসপাতালের অডিটোরিয়ামে সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করে মেডিকেল বোর্ড। চিকিৎসকরা জানান, লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত খালেদা জিয়া আপাতদৃষ্টে স্থিতিশীল আছেন।

তবে শিগগিরই আবার অসুস্থ হয়ে পড়বেন না এমন নিশ্চয়তা নেই। যে কারণে খালেদা জিয়া আশঙ্কামুক্ত নন। গত বছরের ১৩ নভেম্বর খালেদা জিয়া এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন।

লিভারে রক্তক্ষরণের কারণে তাকে দুই মাস সিসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। কেবিনে আনা হয় ১০ জানুয়ারি। বিএনপি চেয়ারপারসনের সুচিকিৎসর জন্য অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করে এভারকেয়ার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এই মেডিকেল টিমে আরও দুটি বেসরকারি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের যুক্ত করা হয়।

অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদার বলেন, খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়ার কনসালট্যান্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। সবারই এক মত, আপাতত আমরা নিয়ন্ত্রণ করেছি। কিন্তু স্থায়ী চিকিৎসার জন্য তাকে জরুরি বিদেশ নেওয়া প্রয়োজন।

মেডিকেল বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ সিদ্দিকী বলেন, এভারকেয়ার হাসপাতালের ৩৮০ জনের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

এই অবস্থায় খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা চিন্তা করে মেডিকেল বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই মুহূর্তে অবস্থা একটু স্থিতিশীল হওয়ায় তাকে বাসায় রেখে চিকিৎসা করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, করোনা সংক্রমণে যদি তার আবার জটিলতা তৈরি হয়, তখন চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা আরও কঠিন হবে। এজন্য তাকে হাসপাতাল থেকে সরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

লিভারে সংক্রমণের কারণে খালেদা জিয়ার শরীরে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, খুব ছোট আকারে এখনো রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তিনি আপাতদৃষ্টে স্থিতিশীল আছেন। তবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই যে অদূর ভবিষ্যতে আবারও রক্তক্ষরণ হবে না।

এই চিকিৎসক বলেন, খালেদা জিয়ার অসুখের যে কনসিকোয়েন্স, তা হলো ‘হাই প্রেসার পোর্টাল সার্কুলেশন’। সেটার জন্য বাইপাস ড্রেন তৈরি করে দিতে হয়, কিন্তু সেটা করা যায়নি। দৃশ্যমান বড় যে ভেসেলগুলো (শিরা) ফেটে যাচ্ছিল, সেগুলোর কিছু ব্লক করা হয়েছে।

চিকিৎসকেরা জানান, খালেদা জিয়া গত অক্টোবরে যখন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, সে সময় তার মেডিকেল পরীক্ষায় টিউমার শনাক্ত হয়েছিল। এই টিউমার প্রাথমিক পর্যায়ে থাকায় তাকে একটা মেডিকেল বোর্ডের অধীনে রেখে সার্জারি করে সেটি বের করা হয়েছে।

এই পর্যায়ে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন বলে জানান অধ্যাপক ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘তখন তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নিয়ে আমরা এতটাই উদ্বিগ্ন ছিলাম যে সেই ব্যাপার আপনাদের (সাংবাদিকদের) জানানো হয়নি।’

খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তার এই চিকিৎসক বলেন, খালেদা জিয়ার শরীরে ওই ধরনের টিউমার যাতে আর না হয়, সে জন্য আধুনিক চিকিৎসা দেওয়া দরকার হয়। কিন্তু সেই চিকিৎসা যেভাবে হওয়া দরকার, সেটা এখানে হচ্ছে না।

মেডিকেল বোর্ডের আরেক সদস্য অধ্যাপক শামসুল আরেফিন বলেন, তার অবস্থা সংকটপূর্ণভাবে স্থিতিশীল, তবে তিনি সুস্থ নন। হাসপাতালে করোনা পরিস্থিতির কারণে তিনি বেশ ঝুঁকিতে। সে জন্য আপাতত তাকে বাসায় পাঠানো হচ্ছে।

তিনি রোগমুক্ত নন। খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া প্রয়োজন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়াকে যত দূর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব, দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসক, দেশের বাইরের চিকিৎসকদের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। সবার একই মত, তাকে ভবিষ্যতের চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানো প্রয়োজন।

মেডিকেল বোর্ডের আরেক সদস্য অধ্যাপক একিউএম মোহসীন বলেন, যেখান থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, আমরা সেটা টার্গেট করে বন্ধ করেছি। কিন্তু তার লিভারে যে প্রাইমারি হাইপারটেনশন, এটাকে ডাইভার্ট করে দিলে প্রেসার কমে যাবে। এজন্য তাকে দেশের বাইরে নেওয়া উচিত।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেডএম জাহিদের সঞ্চলনায় সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- মেডিকেল বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক শেখ মুহাম্মদ আবু জাফর, অধ্যাপক নুর উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক লুৎফুল আজিজ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইফুল ইসলাম, অধ্যাপক জাফর ইকবাল, ডা. মুহাম্মদ আল মামুন, ডা. রফিকুল ইসলাম, ডা. শাহরিয়ার সাইদ, ডা. আরমান রেজা চৌধুরী প্রমুখ।

এদিকে খালেদা জিয়ার বাসায় ফেরা উপলক্ষ্যে তার বাসভবনে কর্মরত সবার করোনা পরীক্ষা করা হয়।

সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে হাসপাতাল থেকে বাসার উদ্দেশে রওনা হন খালেদা জিয়া। এ সময় গাড়ির চারপাশে অবস্থান নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের নানা স্লোগান দিতে দেখা যায়। হাত নেড়ে নেতাকর্মীদের সালামের উত্তর দেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

পৌনে ৯টার দিকে গুলশানের বাসা ‘ফিরোজায়’ পৌঁছান খালেদা জিয়া। বাসভবনের সামনেও ছিল প্রচুর নেতাকর্মী। দলীয় প্রধানকে এক নজর দেখতে বিকাল থেকেই সেখানে অবস্থান করছিলেন তারা।

বাসায় পৌঁছালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, চেয়ারপারসনের ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার ও তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা, প্রয়াত সাইদ ইস্কান্দারের স্ত্রী নাসরিন এস্কান্দার , বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আমান উল্লাহ আমান, আবদুস সালাম, খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এবিএম আবদুস সাত্তার তাকে স্বাগত জানান।

তৃতীয় দফায় হাসপাতালে ভর্তির পর বিএনপি নেতারা বেশ কয়েকবার খালেদা জিয়ার জীবনশঙ্কা প্রকাশ করে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নেওয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন। এই দাবিতে দলটি বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করে। বিএনপির অভিযোগ, সরকার আইনের অজুহাতে তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দিচ্ছে না।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

ten + 12 =