কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা

0
319

মালবাহী ট্রেনের নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৮, একই পরিবারের ৪

স্টাফ রিপোর্টার: স্টেশনে প্রবেশের অনুমতি ছিল না মালবাহী ট্রেনের। দেওয়া হয়নি কোনো সিগন্যাল। যে ট্রেনকে সিগন্যাল দেওয়া হয় না, সেই ট্রেন সিগন্যাল স্থানের আগেই থেমে যাবে। এরপরও সিগন্যাল অতিক্রম করলে আউটার ক্রসিংয়ের আগে অপেক্ষা করবে। কিন্তু কনটেইনারবাহী ট্রেনটি এসবের কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেনি। কিশোরগঞ্জের ভৈরব বাজার স্টেশন মাস্টার মো. ইউসুফ এ তথ্য দিয়ে গতকাল বলেছেন, এসব নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। তদন্তে সিগন্যাল ট্র্যাকিং ম্যাপ প্রতি সেকেন্ড বিশ্লেষণ করে দেখা হয়। এসব রেকর্ড এবং ফুটেজ ঢাকায় রেলওয়ে অধিদফতরে রয়েছে। সেখানেই বেরিয়ে আসবে দুর্ঘটনায় আসলে কার গাফিলতি ছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাত্র ১০ সেকেন্ডের তারতম্যেই হয়েছে সর্বনাশ। ঘটেছে দুর্ঘটনা। এদিকে দুর্ঘটনায় আহতদের মধ্যে বিল্লাল মিয়া নামে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। তার বাড়ি নরসিংদীর বেলাব উপজেলায়।

 আহত অবস্থায় মঙ্গলবার রাতে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে ওই দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৮ জন হলো। নিহতদের মধ্যে একই পরিবারের চারজন রয়েছেন। তারা হলেন- ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার রাজগাতি ইউনিয়নের বনাটি গাঙ্গাটিয়াপাড়া গ্রামের মহিউদ্দিনের ছেলে সুজন মিয়া (৩৪), তার স্ত্রী ফাতেমা বেগম (২৫) ও তাদের দুই ছেলে যথাক্রমে সজীব (১১) ও ইসমাইল (৮)। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় নিজ বাড়িতে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাদের লাশ দাফন করা হয়েছে। জানা গেছে, ঢাকার মোহাম্মদপুর তাজমহল রোড এলাকায় স্ত্রী আর ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন সুজন মিয়া। আশপাশের এলাকায় ডাব বিক্রি করে চালাতেন সংসার। ভাতিজার বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এসেছিলেন নিজ গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইলের বনাটী গ্রামে। অনুষ্ঠান শেষে সোমবার সপরিবারে ফিরছিলেন ঢাকায়।

নিহত সুজনের ভাই স্বপন মিয়া জানান, ১৯ অক্টোবর রাতে বড় ভাই মিজানের ছেলের বিয়েতে যোগ দিতে পরিবার নিয়ে ময়মনসিংহের নান্দাইলে যান সুজন। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সোমবার দুপুরে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। বেলা পৌনে ১টার দিকে কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে স্ত্রী, দুই সন্তান, বড় ভাই ও ভাবিকে নিয়ে এগারোসিন্দুর ট্রেনে করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন সুজন। তিনি বলেন, আমরা ট্রেনে ছিলাম। হঠাৎ ট্রেনের দুটি বগি লাইনচ্যুত হলে আমরা এদিক-সেদিক ছুটি। পরে কোনোমতে ট্রেন থেকে বের হই। কিন্তু সুজন ও তার পরিবারকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে বড় ভাই মিজান এসে সুজন, তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের লাশ শনাক্ত করে। এ ছাড়া দুর্ঘটনায় নিহত ১৮ জনের মধ্যে ১০ জনই কিশোরগঞ্জ জেলার।

 তারা হলেন- কটিয়াদী উপজেলার বোয়ালিয়া এলাকার (দাদন কমিশনারের বাড়ির পাশে) মো. কাশেমের ছেলে গোলাপ (২৩), মিঠামইন উপজেলার চানপুর গ্রামের চান মিয়ার ছেলে সাইমন মিয়া (২২) ও ভরা গোলহাটি গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে রাসেল মিয়া (২৬), করিমগঞ্জ উপজেলার সাকুয়া গ্রামের (নদীর পশ্চিম পাড়) জোনায়েদ হোসেনের স্ত্রী হোসনা খাতুন (২৩), ভৈরব উপজেলার রানীবাজার এলাকার প্রবোধ চন্দ্র শীলের ছেলে সবুজ চন্দ্র শীল (৫০), আগানগর ইউনিয়নের রাধানগর গ্রামের আবদুল মান্নানের ছেলে আফজাল হোসাইন (২৪), শ্রীনগর গ্রামের মানিক মিয়ার ছেলে রাব্বী (৩০), আমলাপাড়া এলাকার (স্থায়ী ঠিকানা নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার মাহমুদাবাদ গ্রাম) দর্শন মিয়ার ছেলে নজরুল (৪০), কুলিয়ারচর উপজেলার গোবরিয়া আবদুল্লাহপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর ঘাটিপাড়া গ্রামের মৃত জিল্লুর রহমানের ছেলে হুমায়ুন কবির (৫৭), বাজিতপুর উপজেলার ডুয়াইগাঁও গ্রামের মৃত আবদুল হাইয়ের ছেলে আছিব উদ্দিন (৩৪)। নিহত অন্যরা হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার বরইচারা গ্রামের মৃত সদর আলী সরকারের ছেলে নিজাম উদ্দিন (৬৫), ঢাকার দক্ষিণখান থানার ৭৮ নর্দ্দাপাড়া এলাকার (ইয়াকুব আলী রোড, বায়তুস সুজুত জামে মসজিদের পাশে) মৃত আবদুর রহমানের ছেলে এ কে এম জালাল উদ্দিন আহম্মেদ (৩৭) ও অজ্ঞাত পুরুষ (৩৩)। সোমবার বিকালে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে এগারোসিন্দুর গোধূলির সঙ্গে কনটেইনারবাহী ট্রেনের সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম, সিলেট ও নোয়াখালীর রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকলেও ওইদিন রাত পৌনে ১০টায় ডাউন লাইন চালু করা হয়। গতকাল ভোর সাড়ে ৫টায় ভৈরবে ট্রেন দুর্ঘটনার উদ্ধারকাজ শেষ হয়েছে। উদ্ধারকাজ শেষে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সকাল ৭.২০ মিনিটে উভয় ট্র্যাকে রেল চলাচল স্বাভাবিক হয়। তবে এ ঘটনায় সব ট্রেন শিডিউল বিপর্যয়ে পড়ে। ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।

রেলপথ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সিগন্যাল না মানায় তিনজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তারা হলেন- লোকোমাস্টার জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী লোকোমাস্টার আতিকুর রহমান এবং গার্ড আলমগীর হোসেন।

প্রত্যক্ষদর্শী একজন জানান, আউটার ক্রসিংয়ে এগারোসিন্দুর ট্রেনের শেষ বগিতে ধাক্কা লাগার আগ মুহূর্তে মালবাহী ট্রেনের লোকোমাস্টার অনেক চেষ্টা করেছেন হার্ডব্রেক করতে। প্রায় ১০ সেকেন্ডের তারতম্যে সংঘর্ষ লেগে যায়। সংঘর্ষের ঘটনায় রেলওয়ে বিভাগীয় একটি ও জেলা প্রশাসকের ১টিসহ দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ জানান, সোমবারের দুর্ঘটনায় ৭৫ জনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়। এ ছাড়া ১৩টি লাশ উদ্ধার করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও তিনজন মারা যান। ১৫ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায় সোমবার রাতে। আরেকজনের পরিচয় আজ দুপুরের পর শনাক্ত হয়। তিনি হলেন- কিশোরগঞ্জ বাজিতপুরের শাহ আলম (১৭)। লাশটি কিশোরগঞ্জ সদর হাসপাতাল মর্গে রাখা আছে। লাশ দাফনের জন্য প্রতি পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। আহত ৭৫ জনের মধ্যে ২২ জনকে ঢাকা মেডিকেল এবং পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। বাকিদের চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরিচয় না জানা আট বছরের একটি শিশু চিকিৎসাধীন।গতকাল ভৈরব স্টেশনের আউটার ক্রসিংয়ে সরেজমিন দেখা যায়, এগারোসিন্দুর পেছনের দিকের তিন বগিতে ধাক্কা দেয়। এতে দুমড়েমুচড়ে যাওয়া দুটি বগি রেল লাইনের পাশেই পড়ে ছিল। ঘটনাস্থল দেখতে ভিড় করেন শত শত মানুষ। এদের মধ্যে কেউ কেউ আশপাশের ঝাড় জঙ্গলে খুঁজতে থাকেন যদি মিলে মূল্যবান কিছু। সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটের দিকে ঢাকা থেকে ভৈরব স্টেশনে প্রবেশ করে এগারোসিন্দুর সেই ট্রেন। কিছু সময় স্টেশনে থেমে আবারও কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা করে। ঘটনাস্থলে আসা স্থানীয়রা এ সময় ট্রেনটির ছবি তুলতে শুরু করেন। প্রতিদিনের চেনা ট্রেনটিকে যেন আবার নতুন করে দেখছেন। দিনের আলো ফুটতেই আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রেনের ধ্বংসাবশেষ দেখতে ছুটে আসেন তারা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন রেল লাইনে পড়ে থাকা বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

18 − thirteen =