অবৈধ ইটভাটা রক্ষা করেই কোটিপতি শওকত চেয়ারম্যান

0
145

মোঃ আহসানউল্লাহ হাসানঃ

পবিরেশ অধিদপ্তর,ডিসি, ই্উএনও সহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্মকর্তাদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করার কথা বলে বিগত ১০/১৫ বছর যাবৎ অন্তত ৫০টির বেশী ইটভাটার মালিকদের জিম্মি করে তাদের কাছে থেকে বক্তাবলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলীর বিরুদ্ধে কোটি কোটি হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। আরো অভিযোগ আছে, অসহায় মানুষের ফসলি জমি ও নদীর পাড়ের মাটি জোড়পূর্বক কেটে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ইটভাটা মালিকদের কাছে বিক্রি করা, টাকার বিনিময়ে গ্রামের শাখা রাস্তা দিয়ে ইটবোঝাই ট্র্যাক চলাচলের অনুমোতি প্রদান করা, বক্তাবলী ফেরিঘাট টেন্ডার, ইট ভাটার বার্থিং টেন্ডার, হাটঘাটের ইজারা, পরিষদের বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা হরিলুট, জমি দখল, ভুমিদস্যু ও মাদক ব্যবসায়ীদের শেল্টার প্রদান, ইউপি র্নিবাচনে মেম্বার প্রার্থীদের থেকে টাকা নেয়ার অভিযোগ, বক্তাবলী ইউনিয়ন ও ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগের বিভিন্ন কমিটিতে পদ বাণিজ্যের অভিযোগ সহ এমন আরো অসংখ্য অনিয়ম অপকর্মের অভিযোগ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, নারায়নগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লা থানাধীন বক্তাবলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী। বক্তাবলী ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ৫০টির বেশী ইটভাটা রয়েছে। হাতে গোনা দুয়েকটির সরকারী কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকলেও বেশীরভাগ ইটভাটারই পরিবেশের লাইসেন্স নেই, ডিসি অফিসের অনুমোদন নেই আবার থাকলেও নবায়ন নেই। পরিবেশ লাইসেন্স বিহীন তার নিজেরও কয়েকটি ইটভাটা রয়েছে। এরমধ্যে নুরানী ব্রিকস অন্যতম। এই সুবাদে তিনি ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে বিগত ১০/১৫ বছর যাবৎ এসব ইটভাটার মালিক সমিতির সভাপতির পদ দখল করে আছেন। থানা আওয়ামীলীগের সেক্রেটারী, ইউপি চেয়ারম্যান ও মালিক সমিতির সভাপতি এই ত্রিমুখী ক্ষমতার মসনদে বসে সবকিছুকে জিম্মি করে নিয়েছে। হামলা করার জন্য রয়েছে স্পেশাল টেটাযুদ্ধা বাহিনী। আর এই টেটাযুদ্ধা বাহিনী দিয়ে শওকত চেয়ারম্যান দীর্ঘদিন যাবৎ ইটভাটায় আধিপত্য বিস্তারকারী ছাবেদ আলী গ্রুপকে তার প্রতিপক্ষ কাসেম বেপারী গ্রুপকে শায়েস্তা করার জন্য শেল্টার দিয়ে আসছিলেন। বড়ধরনের আর্থিক লেনদেন ও ইটভাটা নিয়ন্ত্রণের রাখার জন্য ছাবেদ আলী বা কাসেম বেপারীকে হাতে মুঠোয় রাখার কোন বিকল্প নেই। একারনে যখন যেই গ্রুপ বেশী টাকা দেয়, তখনই শওকত চেয়ারম্যান তার পক্ষ নেয়। এতোদিন ছাবেদ আলী পক্ষে শওকত চেয়ারম্যানের টেটা বাহিনী কাসেম বেপারী বিরুদ্ধে অসংখ্যবার টেটাযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। ছাবেদ আলীর বিরুদ্ধে কাসেম বেপারী কর্মচারীকে হত্যা করে ইটভাটায় পুড়িয়ে ফেলার মামলা চলমান রয়েছে।

ছাবেদ আলী ও কাসেম বেপারী একে অপরের বিরুদ্ধে ৫০ থেকে ৬০ টি করে মামলা করেছে। এসব মামলার অন্তরালে শওকত চেয়ারম্যান কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।     

একাধিক ইটভাটার মালিক জানান, ক্ষমতার দাপটে বিগত ১৫ বৎসর যাবৎ পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের হাত থেকে উচ্ছেদ অভিযান ঠেকানোর কথা বলে ইটভাটার মালিকদের কাছ থেকে ইটভাটা প্রতি ১০থেকে ১৫ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন চেয়ারম্যান শওকত আলী। 

পরিবেশ অধিদপ্তর নারায়নগঞ্জ জেলা শাখার অফিস, ডিসি অফিস ও ইউএনও অফিস সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বছরে ইটভাটা প্রতি ৩/৪লক্ষ টাকা খরচ করে বাকী টাকা নিজে আত্মসাৎ করে। এতে ৫০টি ইটভাটা থেকে বছরে ৪/৫ কোটি টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নেন এই প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা। এছাড়া ইটবোঝাই ট্র্যাক গ্রামের শাখা রাস্তা দিয়ে চলাচলের সুযোগ দিয়ে ইটভাটা মালিকদের নিকট থেকে ২ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছেন। গ্রামবাসীর প্রতিবাদে চাপের মুখে এসব রাস্তা দিয়ে কিছু দিন ট্র্যাক চলাচল বন্ধ থাকলেও আবারো তা চালু করা হয়েছে। এতে গ্রামের রাস্তাগুলো নষ্ট হয়ে জনজীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে।   

বক্তাবলীবাসী জানায়, ইউপি চেয়ারম্যান শওকত আলী ক্ষমতার দাপটে এলাকার জনসাধারনের কৃষি আবাদী জমির মাটি জোরপূর্বক কেটে তার নিজের ইটের ভাটায় নিয়ে যায় এবং লক্ষ লক্ষ টাকায় অন্যত্র নিয়ে বিক্রি করে দেয়। এছাড়া কৃষি জমিতে ১০/১৫ ফুট গভীর করে মাটি কেটে জমি গুলোকে চিরতরে চাষাবাদের অনপুযোগী করে দিয়েছে। নদীর পাড়ে অত্যাধুনিক ক্রেন দিয়ে মাটি কেটে ইট ভাটায় বিক্রি করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। 

নিন্মবিত্ত পরিবারের শওকত আলী বক্তাবলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই তার ভাগ্য চাকা বদলে যায়। পরিবেশ আইন অমান্য করে ইউনিয়নের উত্তর গোপালনগর গ্রামের মধ্যে গড়ে তুলেন সরকারী অনুমোদন বিহীন ইটভাটা। অথচ তার পাশেই ছিলো ২টি স্কুল, ১টি মাদ্রাসা, ও মসজিদ। সেই সাথে কাচা-পাকা রাস্তা-ঘাট। পরিবেশ আইন অনুযায়ী ইটভাটা স্থাপন করা যায় না। অথচ প্রভাব খাটিয়ে শওকত আলী চেয়ারম্যান তার ক্যাডার বাহিনী দ্বারা গ্রামের নিরীহ কৃষকের ফসলি জমির উর্বর মাটি জোরপূর্বক কেটে তার ইটভাটায় নিয়ে ইট তৈরি করেন। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ইটভাটার মালিক বলেন, শওকত চেয়ারম্যানের বিরোধীতা করে এখান ইটভাটা চালানো সম্ভব না। পরিবেশ অনুযায়ী এই এলাকায় ইটভাটা স্থাপন করা যায় না। শুধুমাত্র প্রশাসনের লোকজনকে ম্যানেজ করে তা সম্ভব। একটি ইটভাটায় এক সিজন ব্যবসা চালাতে পারলে কোটি টাকা লাভ আসে। তাই এই ব্যবসায় কাউকে ম্যানেজ করা কোন ব্যাপারই না। কিন্তু শওকত আলী চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাধে ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতির পদ দীর্ঘদিন যাবৎ নিজে দখল করে রেখেছেন। ফলে তিনি যেভাবে বলেন ইটভাটা মালিকদের সেভাবেই কাজ করতে হয়। একারনে সে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সহ প্রশাসনের লোকজনকে ম্যানেজ করার কথা বলে বছরে এক একটি ইটভাটা থেকে ১০/১৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। ইটের জন্য মাটি, লেবার, পরিবহন সবকিছুই চওড়া মুল্যে তার সিন্ডিকেটের নিকট থেকে নিতে হচ্ছে। 

বক্তাবলী খেয়াঘাটের ইজারা প্রায় ১৫ বছর যাবৎ তার নিয়ন্ত্রণে চলছে। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে কাউকে ইজারা সিডিউল কিনতে না দিয়ে তাঁর ছেলের নামে নামমাত্র টাকায় ইজারা নিয়ে থাকেন। অথচ সবাই যদি ওপেন সিডিউল কিনতে পারতো তবে প্রতি বছর সরকারী কোষাগারে ৩০ থেকে ৩৫ লক্ষ টাকার রাজস্ব জমা হতো। অথচ তিনি তার ছেলের নামে ৭/১০ লাখ টাকায় টেন্ডার নিয়ে আসেন। এভাবে বিগত ১৫ বছরে সরকারের অন্তত ৫/৬ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির অন্তরালে আত্মসাত করা হয়েছে। 

বক্তাবলী ফেরিঘাটের ইজারা তাকে ছাড়া বিগত ১০ বছরের কাউকে সিডিউলই কিনতে পারেনি। চেয়ারম্যানের পিএস বাধন এন্টারপ্রাইজের প্রোপ্রাইটর আনোয়ারের নামে মাত্র ১৯ লক্ষ টাকা মুল্যে ইজারা গ্রহন করেন। কিন্তু ওপেন সিডিউল কেনার সুযোগ থাকলে এই ইজারা ১কোটি টাকার উপরে বিক্রি হতো। সওজ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্রতি বছর চেয়ারম্যানই এই ঘাটের ইজারা নিয়ে থাকেন। বক্তাবলী ফেরিঘাটটি চেয়ারম্যান শওকত আলীর হাতে এভাবে জিম্মি হওয়ায় সরকার এঘাট থেকে বছরে কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। 

বক্তাবলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটি গুলোতে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে নিজের ইচ্ছে মতো পদ বানিজ্য করেন। এমপি শামীম ওসমানের দোহাই দিয়ে পকেট কমিটি তৈরী করেন। আর এই কমিটি বানিজ্য করে অন্তত কোটি টাকার উপরে হাতিয়ে নেন।  

বক্তাবলী খেয়াঘাটে পাশে সরকারী জায়গা সহ ওয়ারিশদের জায়গা জোরপূর্বক দখল করে তার ছেলে হৃদয়ের নামে হৃদয় স্টীল মিলস স্থাপন করেন। পাশেই নদীর জায়গায় গড়ে তুলেন বালু মহাল। এলাকায় রয়েছে তার একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তাদের দিয়ে সাধারণ মানুষের জমির অংশ কিনে মানুষকে হয়রানি করেন এবং বিচার সালিশের নামে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেন। সাধারন মানুষ তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। ইউনিয়নের এলজিইডি, কাবিখা,টিআর, ইউনিয়নের ১% সহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্ধের কাজ তার পিএস আনোয়ারকে দিয়ে নামমাত্র করিয়ে বাকী ভাগ-বাটোয়ারা করেন। 

আর এসব অর্থে গড়ে তুলেন সম্পদের পাহাড়। এলাকাবাসীর দেয়া তথ্যমতে মতে, শওকত চেয়ারম্যান নামে বেনামে অন্তত ৫ বাড়ীর মালিক। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৩০ কোটি। বর্তমানে তার ৫টি ইটভাটা যাহার মূল্য ২০কোটি টাকা, ৫টি বাল্কহেড জাহাজ যাহার মূল্য ১৫ কোটি টাকা, বক্তাবলী ফেরিঘাটে তার ১টি হৃদয় স্টীল মিল আছে যার বর্তমান মূল্য ৫০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে তিনি এখন শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক। 

অথচ ২০/২৫ বছর পূর্বে তিনি এতো সম্পদের মালিক ছিলেন না। তিনি একজন সাধারন পরিবারের লোক হয়ে সাদা মাটা জীবন যাপন করতেন। চেয়ারম্যান হওয়ার পর তার জীবন ধারন বদলে যায়।

তার এসব বিত্তবৈভব ও আধিপত্য বিস্তার সহ নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে অভিযোগ জানিয়েছে স্থানীয় এলাকাবাসী।

এ ব্যাপারে শওকত আলী চেয়ারম্যান বলেন এগুলো নিয়ে দুদকের তদন্ত কার্যক্রম চলছে, আপনি চাইলে নিউজ করতে পারেন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

12 + 12 =