কালো জাদু

0
182

হায়াত মাহমুদ

জাদুটোনা , তন্ত্র-মন্ত্র , ভাগ্যগণনা , জ্যোতিষীপনা ইত্যাদি বর্তমান সময়ে সমাজে মহামারী আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে স্বামী -স্ত্রীর মনোমালিন্য , প্রেমিক -প্রেমিকাকে পাওয়ার আকাঙ্খা , বিদেশগমন , ভাগ্য উন্নতি , ব্যবসায় উন্নতি , স্ত্রী তার স্বামীকে বশে আনা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মানুষ দলে দলে ছুটে যায় কবিরাজ -তান্ত্রিক , যাদুকর ও জ্যোতিষীর কাছে। বর্তমানে টিভিতে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমেও জাদুকর -তান্ত্রিক ও জ্যোতিষীদের এই অপকর্মের কথা সম্প্রচার করা হয়। আর তাই দেখে কিছু শিক্ষিত মানুষ ও তাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা ভেবে মাথার বিবেক-বুদ্ধি খুইয়ে চলে যায় তাদের দরবারে।

জাদুর আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে اَلسِّحْرُ (আস সিহর) যার অর্থ হলো , اَلشَّيْءُ الْخَفِىُّ তথা গোপন , সূক্ষ্ম বস্তু , ধোঁকা , ভেল্কিবাজি ও কৌশল ইত্যাদি। পরিভাষায় ;
জাদু এমন এক বিষয়কে বলা হয় , যার উপকরণ নিতান্ত গোপন ও সূক্ষ্ম হয়ে থাকে। জাদু এমন সব গোপনীয় কাজের মাধ্যমে অর্জিত হয় , যা দৃষ্টির অগোচরে থাকে। জাদুর মধ্যে মন্ত্রপাঠ , ঝাড়ফুক , বাণী উচ্চারণ , ঔষধপত্র ও ধুম্ৰজাল – এসব কিছুর সমাহার থাকে। জাদুর বাস্তবতা রয়েছে।

ফলে মানুষ কখনো এর মাধ্যমে অসুস্থ হয়ে পড়ে , কখনো নিহতও হয় এবং এর দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছিন্নতাও সৃষ্টি করা যায়।

জাদু কবিরা গুনাহ হওয়ার কারন , জাদুকর সর্বাবস্থায় কুফরীতে লিপ্ত থাকে। অর্থাৎ কাফের না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যক্তির পক্ষে যাদু করা সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন , ”কিন্তু শয়তানরাই কুফরীতে লিপ্ত হয়ে মানুষকে জাদু শিক্ষা দিত।” ( সূরা আল বাকারা : ১০২ )

অভিশপ্ত শয়তান এজন্যই মানুষকে জাদু শিক্ষা দিত , যাতে করে মানুষ আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগী ভুলে গিয়ে আল্লাহ তাআলার সাথে শিরক করে।

আর মানুষ যেন আল্লাহ তাআলার উপর নির্ভর না করে জাদুর প্রভাবের উপর নির্ভর করে এবং আল্লাহ তাআলার একত্ববাদকে অস্বীকার করে। হারুত ও মারুত নামক ফেরেশতাদ্বয়ের অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন: “আর তারা কাউকে শেখাতো না যে পর্যন্ত না বলতো যে , ‘আমরা তো পরীক্ষা , সুতরাং তোমরা কুফরী করো না।

এরপরও তারা এদের কাছ থেকে শিখত , যার মাধ্যমে তারা পুরুষ ও তার স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাত। অথচ তারা তার মাধ্যমে কারো কোনো ক্ষতি করতে পারত না আল্লাহর অনুমতি ছাড়া। আর তারা শিখত যা তাদের ক্ষতি করতো, তাদের উপকার করতো না এবং তারা অবশ্যই জানতো যে , যে ব্যক্তি তা ক্রয় করবে, আখিরাতে তার কোন অংশ থাকবে না। ” ( সূরা আল বাকারা : ১০২ )
এ জন্য বহু পথ প্রান্ত লোককে জাদুর আশ্রয় নিতে দেখা যায়। কেননা তাদের ভ্রান্ত ধারণা, এটা শুধু একটা হারাম কাজ। আসলে তা যে কুফরী কাজ , তারা তা বুঝতে পারে না। তারা স্পর্শমণি ও তার ব্যবহার জাদুর শামিল করে নিয়েছে। তা জাদু ছাড়া আর কিছুই নয়। পরপুরুষের সাথে কোনো মহিলার প্রেম-প্রণয় সৃষ্টি , স্বামী- স্ত্রীর মাঝে হৃদ্যতা সৃষ্টি বা বিচ্ছেদ ঘটানোর কাজে এমন সব রহস্যময় মন্ত্র পাঠ করে জাদু করা হয় , যার অধিকাংশ শির্ক , কুফরী ও ভেল্কিবাজি।

➤ সুলাইমান (আ. )-এর সময়েও যাদু ছিলো :

“আর তারা অনুসরণ করেছে , যা শয়তানরা সুলাইমানের রাজত্বে পাঠ করত। আর সুলাইমান কুফরী করেনি ; বরং শয়তানরা কুফরী করেছে। তারা মানুষকে যাদু শেখাতো এবং (তারা অনুসরণ করেছে) যা নাযিল করা হয়েছিল বাবেলের দুই ফেরেশতা হারূত ও মারূতের উপর।” ( সূরা আল বাকারা : ১০২)

ইমাম সুদ্দী (রহ.) বলেন ‘সুলাইমান (আ.)-এর রাজত্বকালে শয়তানরা যা আবৃত্তি করতো , তারা তারই অনুসরণ করছে’ এর বর্ণনায় জানা যায়: সুলাইমান (আ.) এর রাজত্বকালের পূর্বে শয়তানরা আকাশে উঠে যেতো এবং পৃথিবীতে কার কখন মৃত্যু হবে , কোন ঘটনা সংঘটিত হবে ইত্যাদি অজানা গোপনীয় ব্যাপারে যখন ফিরিশতা আলাপ করতো শয়তান তা তাদের কাছ থেকে চুরি করে শুনে নিতো।

পরে শয়তান ঐ বিষয় গণকদের কাছে বলে দিতো এবং গণকরা আবার লোকদের কাছে বলে বেড়াতো। লোকেরাও গণকদের কথা সত্য বলে মেনে নিতো ও বিশ্বাস করতো।

গণকরা যখন শয়তানদের বিশ্বাস করতো তখন শয়তানরা সত্য ঘটনার সাথে আরো নানা মিথ্যা কথা যোগ করে গণকদের কাছে বলতো , এমনকি একটি সত্যের সাথে সত্তরটি মিথ্যা যোগ করতো। লোকেরা এসব কথা তাদের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করতে থাকে।

পরবর্তীতে বানী ইসরাঈলরা বলতে শুরু করে যে , জ্বিনেরা গাইবের খবর জানে। সুলাইমান (আ.) নবুওয়াত প্রাপ্ত হওয়ার পর ঐ সমস্ত গ্রন্থ সংগ্রহ করে একটি বাক্সে ভর্তি করে তাঁর সিংহাসনের নিচে মাটিতে পুঁতে রাখেন।

যদি কোনো শয়তান ঐ বাক্সের কাছে যেতে চেষ্টা করতো তাহলে সে পুড়ে মৃত্যু বরণ করতো। সুলাইমান (আ.) বলতেন : আমি যেন কারো কাছ থেকে না শুনি যে , জ্বিন বা শয়তানরা গাইবের খবর জানে ; যে বলবে তার শিরচ্ছেদ করা হবে। সুলাইমান (আ.) এর মৃত্যুর পর এবং যে জ্ঞানী ব্যক্তিগণ সুলাই

মান (আ.)-এর সঠিক বাণী জানতো তাদেরও মৃত্যুর পর নতুন এক প্রজন্মের আবির্ভাব হয়। জ্বিন শয়তান মানুষের বেশ ধারণ করে বানী ইসরাইলের কাছে এসে বললো: আমি কি তোমাদেরকে এমন এক ধন-ভাণ্ডারের কথা জানাবো না যা প্রাপ্ত হয়ে কাজে লাগালে কখনো নিঃশেষ হবে না?

তারা বললো: অবশ্যই বলবে! জ্বিন শয়তান বললো: সুলাইমান (আ.) এর সিংহাসনের নীচের দিকটি খনন করো।

সে তাদেরকে সুলাইমান (আ.)-এর সিংহাসনের জায়গাটি দেখিয়ে দিলো। তারা বললো: তুমিও আমাদের সাথে চলো। সে বললো: না , বরং তোমাদের জন্য আমি এখানে অপেক্ষা করবো খনন করে তোমরা যদি ধন-ভাণ্ডার না পাও তখন আমাকে হত্যা করো। তারা মাটি খনন করে পুঁতে রাখা গ্রন্থগুলো খুঁজে পেলো।

শয়তান তাদেরকে বললো: এই গ্রন্থগুলোতে যা লিখা আছে তা দিয়ে সুলাইমান (আ.) মানুষ , জ্বিন ও পাখিদের নিয়ন্ত্রন করতেন। এরপর লোকদের মাঝে এ কথা প্রচার লাভ করে যে , সুলাইমান (আ.) যাদু জানতেন।

বানী ইসরাঈলরা ঐ গ্রন্থগুলো অনুসরণ করতে শুরু করলো। নবি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আগমনের পর ইয়াহুদীরা ঐ গ্রন্থগুলোর ওপর ভিত্তি করে তাঁর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়।

তাই মহান আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ وَلَكِنَّ الشَّيْاطِيْنَ كَفَرُوْا

‘মূলত সুলায়মান কুফরী করেনি বরং শয়তানেরাই কুফরী করেছিলো।’
হাসান বসরী (রহ.) এর উক্তি আছে যে , যাদু সুলায়মান (আ.) এর পূর্বেও ছিলো। এটা সম্পূর্ণ সত্য কথা। সুলায়মান (আ.)-এর যুগে যাদুকরদের বিদ্যমানতা কুর’আন মাজীদ দ্বারাই সাব্যস্ত হয়েছে এবং সুলায়মান (আ.)-এর আগমন মূসা (আ.)-এর পরে হওয়াও কুর’আনুল কারীম দ্বারাই প্রকাশ পেয়েছে।

দাউদ (আ.) ও জালুতের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে من بعد موسى অর্থাৎ মূসা (আ.) এর পরে। এমনকি ইবরাহীম (আ.) এরও পূর্বে সালিহ (আ.)-কে তাঁর কাওম বলেছিলো: إنما أنت من المسحرين ‘তুমি যাদুকৃত লোকদের অন্তর্ভুক্ত।’ (২৬ : ১৮৫)

➤ যাদুর প্রভাব

অনেকের মত এই যে , যাদুর বলে প্রকৃত জিনিসই পরিবর্তিত হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ বলেন যে , যাদুর বাস্তব কোন প্রভাব নেই , তবে দর্শকের শুধু এর ধারণা হয়ে থাকে মাত্র , প্রকৃত জিনিস যা ছিলো তাই থাকে। যেমন পবিত্র কুর’আনে রয়েছে :
سحروا اعين الناس

অর্থাৎ তারা মানুষের চোখে যাদু করে দিয়েছেন। ( সূরা আল আ‘রাফ , আয়াত : ১১৬) অন্যত্র মহান আল্লাহ তাআলা বলেন :
يُخَيَّلُ إِلَيْهِ مِنْ سِحْرِهِمْ أَنَّهَا تَسْعَى
অর্থাৎ মূসা (আঃ)-এর মনে এ ধারণা দেয়া হয়েছে যে, যেন ঐ সাপগুলো তাদের যাদুর বলে চলাফিরা করছে। ( সূরা ত্বা-হা , আয়াত : ৬৬ )

➤ যাদু শিক্ষা করা কুফরী কাজ

মহান আল্লাহ তাআলা বলেন :
﴿ وَ مَا یُعَلِّمٰنِ مِنْ اَحَدٍ حَتّٰى یَقُوْلَاۤ اِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ
فَلَا تَكْفُرْ ﴾

কিন্তু তারা উভয়ে এ কথা না বলে শিক্ষা দিতো না, ‘আমরা পরীক্ষাধীন ছাড়া কিছু নই , অতএব তোমরা কুফরী করো না।
ইবনু ‘আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন , ‘যখন কোনো লোক ঐ ফেরেশতাদ্বয়ের কাছে যাদু শেখার জন্য যেতো তখন তারা তাকে নিরুৎসাহিত করতো এবং বলতো: আমরা তো পরীক্ষাধীন আছি , অতএব তোমরা কুফরীতে পতিত হয়ো না। তারা জানতো যে , কোন কাজটি ভালো এবং কোন কাজটি মন্দ এবং কি কাজ করলে ঈমানদার হওয়া যায় ও কোন কাজ করলে মানুষ কুফুরীতে পতিত হয়। এরপরও যখন কোনো মানুষ যাদু শেখার জন্য তাদের কাছে যেতো তখন তাঁরা বলতো , তোমরা অমুক অমুক জায়গায় যাও।

সেখানে যাওয়ার পর শয়তান তার সাথে দেখা করতো এবং যাদু শিক্ষা দিতো। যখন কোনো ব্যক্তি যাদু শিক্ষা করতো তখন তার ঈমানের নূর অপসারিত হতো এবং তা আকাশে ভেসে বেড়াতে দেখতে পেতো। তখন সে বলতো: হায় আমার কপাল! আমিতো অভিশপ্ত হয়ে গেলাম! এখন আমার কি হবে? (তাফসীর ইবনে আবি হাতিম ১/৩১২)।

হাসান বাসরী (রহ.) বলেন যে , মহান আল্লাহ ঐ মালাকদ্বয়কে যাদুসহ দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন পরীক্ষা হিসেবে যে , কে তাতে উত্তীর্ণ হয়। মহান আল্লাহ তাআলা তাদের কাছ থেকে এ ওয়া‘দা নিয়েছিলেন যে , যাদু শিক্ষা দেওয়ার পূর্বে তারা প্রথমেই বলে নিবে ‘আমরা তোমাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। অতএব তোমরা কুফরীতে পতিত হয়ো না।’

(তাফসীর ইবনে আবি হাতিম ১/৩১০) কাতাদাহ (রহ.) বলেন : মহান আল্লাহ তাদের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন যে , লোকদের কাছে এ কথা না বলে তারা যাদু শিক্ষা দিবেনা: আমরা পরীক্ষাধীন স্বরূপ , অতএব কুফরী করো না।

এ ছাড়া ইমাম সুদ্দী (রহ.) বলেন : যখন কোন ব্যক্তি ঐ ফেরেশতাদের কাছে যেতো তখন তারা উপদেশ দিতো তোমরা কুফরী করো না , আমরা তো পরীক্ষাধীন। যদি ঐ লোক তাদের উপদেশ মানতে রাযী না হতো তাহলে তাকে বলা হতো ঐ ছাইয়ের স্তুপের কাছে যাও এবং তাতে প্রস্রাব করো।

তার ওপর প্রস্রাব করা হলে তার আলো অর্থাৎ ঐ লোকটির ঈমান চলে যেতো এবং ঈমানের জ্যোতি বিচ্ছুরিত হতে হতে আকাশে মিলিয়ে যেতো। অতঃপর কালো ধোঁয়া জাতীয় জিনিস পৃথিবীতে নেমে এসে তার কানের ভিতর এবং শরীরের অন্যান্য অংশে প্রবেশ করতো।

ঐ কালো ধোঁয়ার মতো জিনিস হলো মহান আল্লাহ্‌র ক্রোধ। এ সমস্ত ঘটনা ফেরেশতাদ্বয়কে জানানোর পর তারা যাদু শিক্ষা দিতো। তাই মহান আল্লাহ বলেন , ‘তারা উভয়ে কাউকেও সেটা শিক্ষা দিতো না এটা না বলে যে , আমরা পরীক্ষাধীন ছাড়া কিছু নই , অতএব তোমরা কুফরী করো না।’

ইবনে জুরাইজ (রহ.) এই আয়াতের বিশ্লেষণে বলেন : বেঈমান ছাড়া কেউ যাদু শিক্ষা করে না। ‘ফিতনা’ হলো পরীক্ষা এবং পছন্দ করার স্বাধীনতা। (তাফসীর তাবারী ২/৪৪৩)। যেমন মহান আল্লাহ মূসা (আ.) সম্পর্কে সংবাদ দিয়ে বলেন :
﴿اِنْ هِیَ اِلَّا فِتْنَتُكَ تُضِلُّ بِهَا مَنْ تَشَآءُ وَ تَهْدِیْ مَنْ
تَشَآءُ﴾
‘এটা তো কেবল তোমার পরীক্ষা, যাকে চাও তা দ্বারা পথভ্রষ্ট করো, আর যাকে চাও সত্য পথে পরিচালিত করো।’

যাদু শিক্ষা করাকে যারা কুফরী করা বলে থাকেন তারা এ আয়াতের আলোকেই বলেন। তারা ঐ হাদীসেরও উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন যা আবু বাকর আল বাযযার (রহ.) ‘আবদুল্লাহ রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন ,

‘যে ব্যক্তি কোনো ভবিষ্যৎ বক্তা কিংবা যাদুকরের কাছে গেলো এবং সে যা বললো তা বিশ্বাস করলো , সে যেন মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- এর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা অস্বীকার করলো। (হাদীসটি সহীহ। সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী-৮/১৩৬ , আল মাজমা ‘উয যাওয়ায়েদ -৫/১১৮ , কাশফ আল-আশতার ২/৪৪৩ )

➤ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানো হয় যাদুর মাধ্যমে

﴿فَیَتَعَلَّمُوْنَ مِنْهُمَا مَایُفَرِّقُوْنَ بِه بَیْنَ الْمَرْءِ
وَزَوْجِه﴾

‘এতদসত্ত্বেও তারা উভয়ের নিকট থেকে এমন জিনিস শিক্ষা করতো , যা দ্বারা তারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করতো।’ অর্থাৎ মানুষেরা হারূত ও মারূতের কাছে গিয়ে যাদু বিদ্যা শিক্ষা করতো। ফলে তারা খারাপ কাজ করতো এবং স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে যেতো।

সহিহ মুসলিমে আছে , রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন , ‘শয়তান তার সিংহাসনটি পানির ওপর রাখে। অতঃপর মানুষকে বিপথে চালানোর জন্য সে তার সেনাবাহিনীকে পাঠিয়ে দেয়।

সে ব্যক্তিই তার নিকট সবচেয়ে সম্মানিত যে হাঙ্গামা সৃষ্টির কাজে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে যায়। এরা ফিরে এসে নিজেদের জঘন্য কার্যাবলীর বর্ণনা দেয়। কেউ বলে , ‘আমি অমুককে এভাবে পথভ্রষ্ট করেছি।’ কেউ বলে , ‘আমি অমুক ব্যক্তিকে এ পাপকাজ করিয়েছি।’

শয়তান তাদেরকে বলে : ‘তোমরা কিছুই করোনি। এতো সাধারণ কাজ।’ অবশেষে একজন এসে বলে: ‘আমি একটি লোক ও তার স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছি , এমনকি তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে গেছে।’ শয়তান তখন তার কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে বলে: ‘হ্যাঁ , তুমি উত্তম কাজ করেছো।’ ( হাদিসটি সহীহ। সহিহ মুসলিম ৪/২১৬৭ , মুসনাদে আহমাদ-৩/৩১৪ , ৩১৫ )

যাদুকরও তার যাদুর দ্বারা ঐ কাজই করে থাকে , যার ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদের সৃষ্টি হয়। যেমন তার কাছে স্ত্রীর আকৃতি খারাপ মনে হবে কিংবা তার স্বভাব চরিত্রকে সে ঘৃণা করবে অথবা অন্তরে শত্রুতার ভাব জেগে যাবে ইত্যাদি। আস্তে আস্তে এসব বৃদ্ধি পাবে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটবে।

➤ যাদুকারীর হুকুম

وَلَوْ اَنَّهُمْ اٰمَنُوْا وَاتَّقَوْا

‘আর যদি তারা ঈমান আনতো এবং মুত্তাক্বী হতো’ অত্র আয়াতাংশের ভিত্তিতে যাদুকারীকে ও যাদু বিদ্যা শিক্ষার্থীকে কাফির বলা হয়েছে। যেমন ইমাম আহমাদ (রহ.) ও পূর্ব যুগীয় মনীষীদের একটি দল এরূপই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

আবার কেউ কেউ কাফির বলেন নি কিন্তু তার হদ হিসেবে হত্যা করার হুকুম দিয়েছেন। যেমনটি ইমাম শাফি‘ঈ (রহ.) এবং আহমাদ ইবনে হাম্বাল (রহ.) একটি সূত্রে বাজালাহ ইবনে ‘উবাইদ (রহ.) বলেন: আমিরুল মু’মিনীন ‘উমার রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু তাঁর এক নির্দেশ নামায় লিখেছেন: ‘যাদুকর পুরুষ বা স্ত্রীকে তোমরা হত্যা করো।’

এ নির্দেশ অনুযায়ী আমরা তিনজন যাদুকরের গর্দান উড়িয়েছি।’ ( সুনান আবূ দাউদ ৩/৩০৪৩ ) উম্মুল মু’মিনীন হাফসা (রা.) এর ওপর তাঁর দাসী যাদু করেছিলো বলে তাকে হত্যা করা হয়। ( মুওয়াত্তা ইমাম মালিক ২/১৪/৮৭১ , সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮/১৩৬ )

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল (রহ.) বলেন যে , তিনজন সাহাবি থেকে যাদুকরকে হত্যা করার ফাতাওয়া রয়েছে। জামি‘উত তিরমিযীর মধ্যে আছে যে , রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: ‘যাদুকরের শাস্তি হচ্ছে তরবারি দ্বারা হত্যা করা।’ ( জামি ‘তিরমিযী ৪/১৪৬০ )
ওয়ালীদ ইবনে ‘উকবার নিকট একজন যাদুকর ছিলো সে তার যাদু কার্য বাদশাহকে দেখাতো। সে প্রকাশ্যভাবে একটি লোকের মাথা কেটে নিতো। অতঃপর একটা শব্দ করতো , আর তখনই মাথা জোড়া লেগে যেতো।

মুহাজির সাহাবিগণের মধ্যে একজন মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবি তা দেখতে পেয়ে পরের দিন তিনি তরবারী নিয়ে আসেন। যাদুকর খেলা আরম্ভ করার সাথে সাথেই তিনি স্বয়ং যাদুকরেরই মাথা কেটে ফেলেন এবং বলেন তুমি সত্যবাদী হলে নিজেই জীবিত হয়ে যাও। অতঃপর তিনি কুর’আন মাজীদের নিম্নের আয়াতটি পাঠ করেন-
أَفَتَأْتُونَ السِّحْرَ وَأَنْتُمْ تُبْصِرُونَ

‘তোমরা যাদুর নিকট যাচ্ছো ও তা দেখছো?’ ( সূরা আল আম্বিয়া , আয়াত : ৩ ) ঐ সাহাবি ওয়ালীদের নিকট থেকে তাকে হত্যা করার অনুমতি নেননি বলে বাদশাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট হোন এবং শেষে তাকে ছেড়ে দেন।

( মুসতাদরাক হাকিম-৪/৩৬১ , সুনান দারাকুতনী-৩/১১৪ , সুনান বায়হাক্বী-৮/১৩৬ ,আল ইসাবাহ-১/২৬১ , তারিখুল বুখারী ১/২/২২২)
ইমাম শাফি‘ঈ (রহ.) ‘উমার রাদিআল্লাহু তাআলা আনহু -এর নির্দেশ ও হাফসার (রহ.) ঘটনা সম্পর্কে বলেছেন যে , ঐ হুকুম তখন কার্যকরী হবে যখন যাদুকরের মধ্যে শিরক যুক্ত শব্দ থাকবে। মহান আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে বেশি জানেন।

➤ যাদু বিদ্যা শিক্ষা করার হুকুম

যারা যাদু শিক্ষা করে ও এটা ব্যবহার করে তাদেরকে ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) , ইমাম মালিক (রহ.) এবং ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল (রহ.) কাফের বলেছেন। ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর কয়েকজন শিষ্যের মতে যাদু যদি আত্মরক্ষার জন্য কেউ শিক্ষা করে তবে সে কাফির হবে না।

তবে হ্যাঁ যারা এর প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং একে উপকারী মনে করে সে কাফের। অনুরূপ ভাবে যারা ধারণা করে যে , শয়তানরা এ কাজ করে থাকে এবং তারা এরকম ক্ষমতা রাখে তারাও কাফের।
ইমাম শাফি‘ঈ (রহ.) বলেন , যে যাদুকরদেরকে জিজ্ঞেস করতে হবে , যদি তারা বাবেলবাসীদের মতো বিশ্বাস রাখে এবং সাতটি গতিশীল তারকার প্রভাব সৃষ্টিকারী রূপে বিশ্বাস করে তবে তারা কাফির। আর যদি এরূপ না হয় , কিন্তু যাদুকে বৈধ মনে করে তবে তারাও কাফির।

ইমাম মালিক (রহ.) ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) এর অভিমত এটাও আছে যে , যারা যাদু করে এবং একে ব্যবহারে লাগায় তাদেরকে হত্যা করে দেয়া হবে। ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) এবং ইমাম শফি‘ঈ (রহ.) বলেন যে , যে পর্যন্ত বারবার না করে কিংবা কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি সম্বন্ধে নিজে স্বীকার না করে সেই পর্যন্ত হত্যা করা হবে না।

তিনজন ইমামই বলেন যে , তার হত্যা হচ্ছে শাস্তির জন্য। কিন্তু ইমাম শাফি‘ঈ (রহ.) বলেন যে , এ হত্যা প্রতিশোধের জন্য। ইমাম মালিক (রহ.) , আবূ হানীফা (রহ.) এবং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) একটি প্রসিদ্ধ উক্তিতে এ নির্দেশ আছে যে , যাদুকরকে তাওবাহও করানো হবে না এবং তার তাওবা করার ফলে তার শাস্তি লোপ পাবে না।

ইমাম শাফি‘ঈ (রহ.) এর মতে তার তাওবাহ গৃহীত হবে। একটি বর্ণনায় ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) থেকেও এমন উক্তি আছে। ইমাম আবূ হানীফা (রহ.)-এর মতে কিতাবীদের যাদুকরকে হত্যা করা হবে। কিন্তু অন্য তিনজন ইমামের অভিমত এর উল্টো। লাবীদ বিন আ‘সাম নামক ইয়াহুদী রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর যাদু করেছিলো , কিন্তু তাকে হত্যা করা হয়নি।

যদি কোনো মুসলমান মহিলা যাদু করে তবে তার সম্বন্ধে ইমাম আবূ হানিফা (রহ.) এর মত এই যে , তাকে বন্দী করা হবে আর অন্য তিনজন ইমামের মতে পুরুষের মতো তাকেও হত্যা করা হবে। আল্লাহ তা‘আলাই এ সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জ্ঞান রাখেন।

ইমাম যুহরী (রহ.)-এর মতে মুসলমান যাদুকরকে হত্যা করা হবে। কিন্তু মুশরিক যাদুকরকে হত্যা করা হবে না। ইমাম মালিক (রহ.) বলেন যে , যদি কোনো যিম্মীর যাদুর ফলে কেউ মারা যায় তবে যিম্মীকেও মেরে ফেলা হবে।

তিনি এটাও বর্ণনা করেন যে , তাকে প্রথমে তাওবাহ করতে বলা হবে। যদি সে তাওবাহ করে ইসলাম গ্রহণ করে তবে তা ভালোই , নচেৎ তাকে হত্যা করা হবে। আবার তাঁর থেকে এটাও বর্ণিত আছে যে , ইসলাম গ্রহণ করলেও তাকে হত্যা করা হবে। যে যাদুকরের যাদুতে শিরকী শব্দ আছে , চারজন ইমামই তাকে কাফের বলেছেন।

ইমাম মালিক (রহ.) বলেন যে যাদুকরের ওপর প্রভুত্ব লাভ করার পর যদি সে তাওবা করে তবে তার তাওবাহ গৃহীত হবে না। যেমন যিন্দিক সম্প্রদায়। তবে যদি তার ওপর প্রভুত্ব লাভের পূর্বেই তারা তাওবাহ করে তাহলে তা গৃহীত হবে। আর যদি তার যাদুতে কেউ মারা যায় তবে তাকে হত্যা করতেই হবে।


ইমাম শাফি‘ঈ (রহ.) বলেন যে , যদি সে বলে যে , আমি মেরে ফেলার জন্য যাদু করিনি তা হলে ভুল করে হত্যার অপরাধে তার নিকট হতে জরিমানা আদায় করা হবে। সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব (রহ.) যাদুকরের দ্বারা যাদু উঠিয়ে নিতে অনুমতি দিয়েছেন , যেমন সহীহ বুখারীর মধ্যেও রয়েছে।

‘আমির শা‘বীও এটাকে কোন দোষ মনে করেন না। কিন্তু খাজা হাসান বাসরী (রহ.) এটাকে মাকরুহ বলেছেন। ‘আয়িশাহ্ (রা.) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর খিদমতে আরয করেন : আপনি যাদু তুলে নেন না কেন? তিনি বলেন: মহান আল্লাহ তো আমাকে আরোগ্য দান করেছেন। আমি লোকের ওপর মন্দ খুলিয়ে নিতে ভয় করি।

♦ যাদুর চিকিৎসা:

ইমাম ওয়াহাব (রহ.) বলেন যে , কুলের সাতটি পাতা পাটায় বেটে পানিতে মিশাতে হবে। অতঃপর আয়াতুল কুরসি পড়ে তার ওপর ফুঁ দিতে হবে এবং যাদুকৃত ব্যক্তিকে তিন ঢোক পানি পান করাতে হবে এবং অবশিষ্ট পানি দিয়ে গোসল করাতে হবে। ইনশা’আল্লাহ যাদুর ক্রিয়া নষ্ট হয়ে যাবে।

এ ‘আমল বিশেষ ভাবে ঐ ব্যক্তির জন্য খুবই মঙ্গলজনক যাকে তার স্ত্রী থেকে বিরত রাখা হয়েছে। যাদু ক্রিয়া নষ্ট করার সবচেয়ে বড় চিকিৎসা হচ্ছে قل اعوذ برب الفلق ও قل اعوذ برب الناس এ সুরাগুলো।

হাদিসে আছে যে , এই সূরাগুলোর চেয়ে বড় রক্ষাকবয আর কিছু নেই। এরকমই আয়াতুল কুরসিও শায়তানকে দূর করার জন্য বড়ই ফলদায়ক।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

twelve + nineteen =