নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছেন আদালতের বিচারকরা

0
87

নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছেন অধস্তন আদালতের বিচারকরা। একের পর এক হুমকি আর নানা অপ্রীতিকর ঘটনায় বিচলিত তারা। গত তিন মাসে আদালত অঙ্গনে এ ধরনের ঘটনা ছিল চোখে পড়ার মতো। বিষয়টি লক্ষ্য করে সারা দেশের সব আদালত ও ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণ এবং বিচারকদের বহনকারী গাড়ি ও বাসভবনের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বৃদ্ধির নির্দেশনা দিয়ে প্রধান বিচারপতি মো. ওবায়দুল হাসান গত ডিসেম্বরে পুলিশ মহাপরিদর্শককে চিঠি দেন। এখনো পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হলে বিচারকদের পাশাপাশি তাদের পরিবারের সদস্যদেরও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে হবে।

জানা গেছে, গত সোমবার গভীর রাতে জয়পুরহাটে ফাঁসির রায় প্রদানকারী এক বিচারকের বাসার জানালার গ্রিল কেটে ভেতরে ঢুকে তাকে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে। ছুরি হাতে ওই বিচারকের উদ্দেশে একজন দুষ্কৃতকারী বলেছে, ‘তুই বেদিন ও তার লোকজনকে ফাঁসি দিয়েছিস। এখন আমরা তোর ফাঁসি দিতে এসেছি।’ ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন তিনি। ২২ বছর আগের এক হত্যা মামলায় গত ৩১ জানুয়ারি ১১ জনকে ফাঁসির আদেশ দেন তিনি। তাদের মধ্যে কয়েকজন আসামি পলাতক ছিল। এই অতিরিক্ত জেলা জজকে হত্যাচেষ্টার বিষয়টি সামনে আসায় বিচারকদের নিরাপত্তার বিষয়টি ফের আলোচনায় উঠেছে।

যদিও বিচারকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে প্রধান বিচারপতির আইজিপিকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, সম্প্রতি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ও খুলনা জেলা জজ আদালতে বোমা হামলা হয়েছে। এর আগে কুমিল্লা আদালতে বিচারকের খাসকামরায় বিচারপ্রার্থীকে হত্যার ঘটনা ও সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোতে সারা দেশের বিচারকরা চরমভাবে উদ্বিগ্ন, আতঙ্কিত ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। দেশের বিচার ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য দেশের সব আদালত ও ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণ, বিচারকদের বহনকারী গাড়ি এবং বাসভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অতি জরুরি। নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অপরাধ বিচিত্রাকে বলেছেন, বিচারকদের নিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই নিশ্চিত করা হবে। আমি এ ব্যাপারে দ্রুততার সঙ্গে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

বিচারকরা বলছেন, মাঝে মাঝেই বিভিন্ন আদালতে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। হুমকি দেওয়া হচ্ছে বিচারকদের। বিশেষ করে স্পর্শকাতর মামলা যারা পরিচালনা করছেন, সেই সব বিচারকের নিরাপত্তা বেশি হুমকির মুখে পড়ছে। গত সোমবার রাতে জয়পুরহাটের অতিরিক্ত জেলা জজ আব্বাস উদ্দীনকে হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে। গত ৩১ জানুয়ারি তিনি একটি হত্যা মামলায় ১১ জনকে ফাঁসির আদেশ দেন। ওই অতিরিক্ত জেলা জজ একজন জেলা জজের এখতিয়ার সম্পন্ন মামলারও বিচার করেন। হত্যা মামলারও রায় দেন। তার নিরাপত্তার জন্য কোনো গানম্যান নেই। আবার নিরাপত্তা সংবলিত জাজেস কম্পাউন্ডের ভেতরে কোনো বাসস্থানের ব্যবস্থাও হয়নি। তিনি ভাড়া বাসায় ছিলেন। এর আগে ২০২১ সালে জয়পুরহাটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. রুস্তম আলীকে হুমকি দিয়ে চিঠি দেয় জঙ্গিগোষ্ঠী। গত জানুয়ারিতে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে যশোরের ভারপ্রাপ্ত জেলা জজকে চিঠি দিয়েছে দুষ্কৃতকারীরা। যশোরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক ফারজানা ইয়াসমিন ভারপ্রাপ্ত জেলা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। গত ২৮ জানুয়ারি তিনি ডাকযোগে একটি চিঠি পান। এতে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির জনৈক নজরুল ইসলাম নামে একজনের স্বাক্ষর ছিল। চিঠিতে বলা হয়, ‘আপনাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা যাচ্ছে, ৩০ জানুয়ারি ক্রিমিনাল মিস ২৯/২৪ নম্বর মামলায় ধর্ষণের অভিযোগ থাকলেও সব আসামিকে জামিন দেবেন। অন্যথায় আপনার জীবন শেষ করে দেওয়া হবে এবং আপনারও ওই অবস্থা করা হবে।’ বিচারক বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানালে ডিবি পুলিশ তদন্ত শুরু করে। এ ঘটনায় জড়িত তিনজনকে গত ২ ফেব্রুয়ারি কারাগারে পাঠানো হয়।

এ ছাড়া এক মাসের ব্যবধানে চট্টগ্রামের আদালতে দুজন বিচারককে উদ্দেশ করে এজলাসে জুতা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ঢাকা এবং খুলনার আদালত চত্বরে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। অনেক সময় আইনজীবীদেরও তোপের মুখে পড়তে হচ্ছে অনেক বিচারককে। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পিরোজপুর, নওগাঁসহ বেশ কয়েকটি জেলার আদালতে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। এজলাসে দাঁড়িয়ে আইনজীবীরা বিচারককে হুমকি দিয়েছেন। এসব ঘটনায় জড়িত আইনজীবীদের হাইকোর্ট তলবও করেন। বিচার অঙ্গনের এসব অপ্রীতিকর ঘটনা দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে বিচারকদের। বারবার তাদের নিরপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

এর আগে ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক ফাতেমা ফেরদৌসের আদালতে এক আসামি আরেক আসামিকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। এ ঘটনায় সারা দেশের আদালতে নিরাপত্তা চেয়ে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে তখন হাইকোর্ট রুল জারি করেন। এ ছাড়া সারা দেশের আদালতের নিরাপত্তায় কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা হাইকোর্ট জানতে চান।

এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে গতকাল আইনজীবী ইশরাত হাসান অপরাধ বিচিত্রাকে বলেন, সরকার পক্ষ থেকে তখন প্রতিবেদন দিয়ে জানানো হয়েছিল, বিচারকদের নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এ-সংক্রান্ত রুলটি চূড়ান্ত শুনানির অপেক্ষায় আছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিটি রায় কারও না কারও বিপক্ষে যায়। একজন বিচারক অসংখ্য মামলায় রায় দেন। রায়ে শত্রুপক্ষ যে কোনো সময় তার ওপর আক্রমণ করতে পারে। তাই বিচারকের নিরাপত্তা না থাকলে তিনি সঠিকভাবে বিচার করতে পারবে না। ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে তার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। আমি মনে করি, বিচারকদের পাশাপাশি তাদের পরিবারের সদস্যদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’

জানা যায়, ২০০৫ সালের ১৩ আগস্ট ৬৩ জেলার আদালত অঙ্গনে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ হয়। এ ঘটনায় সারা দেশ কেঁপে ওঠে। এর পরই দেশের বিচারাঙ্গনের নিরাপত্তার প্রশ্নটি প্রথম সামনে আসে। তৎকালীন সরকার ওই ঘটনার পর আদালতগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে। কথিত এই ‘জোরদার ব্যবস্থা’র ভেতরই একই বছরের ১৪ নভেম্বর আদালতে যাওয়া-আসার পথে জঙ্গি হামলায় নিহত হন ঝালকাঠির সিনিয়র সহকারী জজ সোহেল আহম্মেদ এবং জগন্নাথ পাঁড়ে। সে বছরের ২৯ নভেম্বর চট্টগ্রাম আদালতের মূল ফটকে পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন পুলিশ কনস্টেবল রাজীব বড়ুয়া এবং ফুটবলার শাহাবুদ্দীন। পরে হামলাকারী জেএমবি সদস্য মুহাম্মদ হোসেনও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। এরপর গাজীপুরসহ বিভিন্ন আদালতে হামলা হয়। কোনো একটি হামলা হলেই বিচারাঙ্গনের নিরাপত্তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মাঝে তোড়জোড় শুরু হয়।

এক সময় দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়ে যায় বিচারাঙ্গনের নিরাপত্তা ইস্যু। থিতিয়ে পড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও। ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই কুমিল্লা আদালত এজলাসে বিচারকের খাসকামরায় সহ-আসামির ছুরিকাঘাতে আসামি ফারুক নিহত হওয়ার ঘটনার পর ফের আলোচনায় উঠে আসে আদালতের নিরাপত্তা বিষয়টি। আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, বিচারকদের নিরাপত্তার বিষয়ে প্রধান বিচারপতি অবগত আছেন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

fourteen + 15 =