রূপগঞ্জের তারাব পৌরসভা ও কাঞ্চন পৌরসভার সেতুবন্ধ ‘রূপসী-কাঞ্চন’ সড়ক। প্রায় ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ নারায়ণগঞ্জের সড়কটি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) নির্মাণ করে ১৯৯৯ সালে। নির্মাণের সময় সড়কটির আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছিল ১০ বছর। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার
না করায় তার আগেই খানাখন্দে চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়ে সড়কটি। এখন পুনর্নির্মাণ ছাড়া গত্যন্তর নেই পণ্য পরিবহনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ‘রূপসী-কাঞ্চন’ সড়কের। সড়কটি মেরামতে এলজিইডির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে বলে জানান তারাব পৌরসভার মেয়র হাসিনা গাজি। তিনি বলেন, সড়কটির কিছু অংশ পড়েছে তারাব পৌরসভায়, কিছু ইউনিয়ন পরিষদে ও কিছু অংশ কাঞ্চন পৌরসভায়। তারাব পৌরসভার মধ্যে যে অংশটি পড়েছে, সেটি মেরামতের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। দ্রুতই সড়কটি মেরামত করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি। ২০০৪-০৫ অর্থবছরে নির্মাণের পর নিয়মমাফিক রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি ঢাকা- ময়মনসিংহ হাইওয়ের সিড স্টোর জিসি-সখীপুর হেড কোয়ার্টার সড়কটিও। ফলে গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কের ভালুকা অংশটুকু একেবারেই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আয়ুষ্কাল হারিয়েছে এ সড়কটিও। এলজিইডির অধীন আয়ুষ্কাল হারানো এ ধরনের ভাঙাচোরা সড়ক রয়েছে সারা দেশেই। সংস্থাটির অধীনে সারা দেশে পাকা সড়ক রয়েছে ১ লাখ ৮০৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৭০ হাজার কিলোমিটারই আয়ুষ্কাল হারিয়েছে বলে জানা গেছে। ভালো নয় বাকি ৩০ হাজার ৮০৫ কিলোমিটার পাকা সড়কের অবস্থাও। আয়ুষ্কাল শেষ হওয়া এসব সড়ক পুনর্নির্মাণ ছাড়া বিকল্প নেই বলে জানান এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, সারা দেশে এলজিইডির আওতাধীন পাকা ও মাটির সড়ক রয়েছে ২ লাখ ৮৯ হাজার কিলোমিটার। বিশাল এ সড়ক নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি বছর প্রয়োজন কমপক্ষে ১৭ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে আমরা পাই মাত্র দেড় হাজার কোটি টাকা। পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবে সড়কগুলো নিয়মিত বা সময়ান্তর রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। মূলত এ কারণেই দেশের ৭০ হাজার কিলোমিটার সড়ক আজ আয়ুষ্কাল হারিয়ে চলাচলের অনুপযোগী। প্রচুর অর্থ ব্যয়ে হলেও সড়কগুলো পুনর্নির্মাণ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের আলোচনাও হয়েছে। শুধু নিয়ম অনুযায়ী রক্ষণাবেক্ষণ না করার কারণে নির্ধারিত সময়ের কিছুটা আগেই আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে নীলফামারীর ডোমার উপজেলার বক্করের মোড় থেকে হরিণচরা ইউনিয়নের বুড়িরহাট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি। ২০০৬ সালে নির্মাণের পর সড়কটি সংস্কারের কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। ইট, সিমেন্ট, কার্পেটিং উঠে গিয়ে বোঝার উপায় নেই যে, এটি একটি পাকা সড়ক। এ অবস্থায় সড়কটিকে চলাচল উপযোগী করতে হলে এর পুরোটাই ভেঙে দ্বিগুণ ব্যয়ে পুনর্নির্মাণ করতে হবে। হরিণচরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম বলেন, সড়কটি নির্মাণের পর কখনো দেখতে আসেনি এলজিইডি কর্তৃপক্ষ। উদ্বোধনের কয়েক বছরের মধ্যেই বেহাল হয়ে পড়ে সড়কটি। সর্বশেষে বন্যায় সড়কজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় খানাখন্দ। এখন যানবাহন চলাচলেরও উপায় নেই সড়কটিতে। পথচারীরাও হাঁটছেন বিকল্প পথে। বিষয়টি জানানোর পর এলজিইডি পূর্বের সড়কটি ভেঙে নতুন সড়ক নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করছে। আট বছর ধরে পিচ নেই যশোরের কালীবাড়ি থেকে মণিরামপুর পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটিতে। সাত কিলোমিটারজুড়ে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে উপজেলার পাড়দিয়া থেকে লেঙ্গুরাহাট সড়কটিতে। এ সড়কটিও দীর্ঘ সময় সংস্কার করা হয়নি। মণিরামপুর উপজেলা চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন লাভলু বলেন, শুধু ওই দুটি সড়ক নয়, উপজেলার বেশির ভাগ সড়কই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বিষয়টি জানিয়ে এলজিইডি বরাবর চিঠি দিয়েছি। কিন্তু সংস্কারের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এলজিইডির সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিট সূত্র জানিয়েছে, আয়ুষ্কাল হারানো ৭০ হাজার কিলোমিটার পাকা সড়ক পুনর্নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হবে দেড়-দুই কোটি টাকা। এছাড়া অবশিষ্ট ৩০ হাজার ৮০৫ কিলোমিটার সড়কও জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করতে হবে। তা না হলে এ সড়কগুলোও পুনর্নির্মাণ করার মতো অবস্থায় চলে যাবে। এতে একদিকে সরকারের ব্যয় বাড়বে, অন্যদিকে নষ্ট হবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। এছাড়া বেহাল সড়কে দুর্ঘটনা ও দীর্ঘ যানজটের কারণে ভোগান্তিতে পড়বে সাধারণ মানুষ, স্থবির হয়ে পড়বে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা। সাধারণত নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার ১০ বছর পর যেকোনো সড়কের ট্রাফিক ভলিউমে পরিবর্তন আসে। পথচারীর সংখ্যাও বেড়ে যায়। ১০ বছর আগে একটি সড়কে যে ধরনের যান চলাচল করত, ১০ বছর পর ওই সড়কে পুরনোগুলোর পাশাপাশি নতুন ধরনের ভারী যানবাহনও চলাচল শুরু করে। এছাড়া প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো রয়েছেই। মূলত এসব বিবেচনায় সড়কের আয়ুষ্কাল কমপক্ষে ১০ বছর নির্ধারণ করে এলজিইডি। কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে নির্ধারিত এ সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সড়ক নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে না সংস্থাটি। অনেক সময় অর্থস্বল্পতার মধ্য দিয়ে কিছু সড়ক সংস্কার করা হলেও এতে থেকে যায় প্রযুক্তিগত ত্রুটি। ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সড়কগুলো আবারো ফিরে যায় পুরনো জীর্ণ অবস্থায়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ডিপার্টমেন্ট অব আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিংয়ের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শাকিল আখতার বলেন, নির্ধারিত সময়ে প্রয়োজন অনুযায়ী সড়ক সংস্কার বা পুনর্বাসন করা না হলে তার আয়ুষ্কাল আরো কমে আসে। পাশাপাশি অবকাঠামো নির্মাণে প্রকৌশলগত ত্রুটি থাকলেও এমন ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে সড়কগুলো পুরোপুরি ভেঙে ফেলে পুনর্নির্মাণ করা ছাড়া অন্য কোনো সমাধান নেই। সড়কের এমন পরিস্থিতিতে পুরো দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন এলজিইডি কর্তৃপক্ষও। আয়ুষ্কাল হারানো এসব সড়কের বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছে সংস্থাটি। এলজিইডির সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিটের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রহিম বলেন, আয়ুষ্কাল হারানো সড়ক এবং অবশিষ্ট ভাঙাচোরা সড়কগুলোর বিষয়ে আমরা বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো দাতা সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করছি। তারা ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। প্রয়োজনীয় সমীক্ষা শেষে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সড়কটিই সংস্কার, পুনর্বাসন বা পুনর্নির্মাণের জন্য বেছে নেয়া হবে। এছাড়া আগামীতে সড়ক ব্যবস্থাপনায় আমরা বেশকিছু পরিবর্তন আনছি। উল্লেখ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সম্প্রতি সড়ক ব্যবস্থাপনায় নতুন পদ্ধতিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এলজিইডি। নতুন এ পদ্ধতিতে বেশকিছু মানদণ্ডের ভিত্তিতে বিদ্যমান সড়কগুলোর ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন (আইআরআর) নির্ধারণ করবে সংস্থাটি। অর্থনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্ব বিবেচনায় যে সড়কের আইআরআর যত বেশি হবে, সংস্কার বা পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে সে সড়কটি তত বেশি গুরুত্ব পাবে। বুয়েটের সহযোগিতায় সড়ক ব্যবস্থাপনার এ পদ্ধতি এরই মধ্যে টাঙ্গাইলে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। এতে ভালো ফল পাওয়ায় এখন বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলায় নতুন এ পদ্ধতি বাস্তবায়ন সম্ভব। আগামী বছরের শুরুতেই সড়ক ব্যবস্থাপনার আধুনিক এ পদ্ধতিটির উদ্বোধন হবে বলে জানিয়েছেন এলজিইডির প্রকৌশলীরা।