বিওটির সদস্যরা যুদ্ধাপরাধীদের স্বার্থের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন * পাকিস্তানসহ ১৪ বিদেশী শিক্ষার্থীর বৈধ ভিসা নেই * বিওটিতে পর্যবেক্ষক ও নিয়োগ কমিটিতে ইউজিসির প্রতিনিধি নিয়োগসহ ১৭ সুপারিশ
অপরাধ বিচিত্রা ঃ
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (এনএসইউ) শিক্ষার্থীদের জঙ্গিবাদে জড়ানোর পর্যাপ্ত সুযোগ আছে। সেখানে আছে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরির মতো অনুকূল পরিবেশ। মানবতাবিরোধী অপরাধী বা যুদ্ধাপরাধীদের স্বার্থের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওটি) কতিপয় সদস্য। জঙ্গিবাদে উৎসাহিত হওয়ার মতো বই ছিল লাইব্রেরিতে। এসব বই পুড়ে ফেলতে নির্দেশনা দেয়ার পরও তা প্রায় এক বছর লাইব্রেরিতে ছিল। এনএসইউর ওপর ইউজিসির (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) সর্বশেষ তদন্ত প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা হয়েছে। রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি এবং শোলাকিয়ার ঈদগাহে জঙ্গি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ জুলাই এ সংস্থার চার সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের দল বিশ্ববিদ্যালয়ে সরেজমিন তদন্তে যায়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, আমরা তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছি। এতে বেশকিছু পর্যবেক্ষণসহ সুপারিশ আছে। যেহেতু এটি এখন সরকারি স¤পত্তি। তাই এ ব্যাপারে যা বলার সরকার বা মন্ত্রণালয়ই বলবে। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ, ধর্মীয় উন্মাদনার দিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ লুটপাট, নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি, আইন লংঘনের বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত পাঁচ বছরে ৫ হাজার ১১৬ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া শেষ না করেই চলে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পাকিস্তান ও নাইজেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ১৪ জনের বৈধ ভিসা নেই। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি এমন কর্মকান্ডের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া যেতে পারে বলে সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে। ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুযোগ পেয়েছেন মানবতাবিরোধী অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামীর সন্তানরা। সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে পরবর্তীতে তাদের ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এতে বিওটির সদস্যদের মানবতাবিরোধী অপরাধী/যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বা তাদের স্বার্থের পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায় বলে মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনে। এতে উল্লেখ করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অলিখিত প্রধান মুখপাত্র হিসেবে ইউজিসির তদন্ত দলের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহসান। তিনি ডেজিগনেটেড প্রোভিসি। এই প্রোভিসি ইউজিসির পরিদর্শনের দুদিন পরই জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেফতার হন। ছাত্রছাত্রীদের জঙ্গিবাদে ভেড়ার সুযোগের দিকে ইঙ্গিত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, অবসর সময় কাটানোর তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক সেমিস্টারে মাত্র দুটি কোর্স পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণকালীন শিক্ষার্থীর মর্যাদা পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড অনেক কম। শিক্ষার্থী কাউন্সিলিং ব্যবস্থা তেমন কার্যকর নয়। ফলে শিক্ষার্থীদের বিপথগামী হওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। মানবিক গুণাবলীস¤পন্ন শিক্ষার্থী সৃষ্টি ও মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ এখনও তৈরি হয়নি। এর অভাবে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরির মতো অনুকূল পরিবেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরাজ করছে। পরিদর্শনের আগের দিন (১৩ জুলাই) লাইব্রেরি থেকে নিষিদ্ধ বই সরানো ও লাইব্রেরিয়ানকে অপসারণ ধর্মীয় উগ্রবাদ সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশের সাক্ষ্য দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বছর আগে পরিদর্শনকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের বই পাওয়া গিয়েছিল। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর বই পুড়িয়ে ফেলতে গত বছরের আগস্ট মাসের ইউজিসির পরিদর্শন প্রতিবেদনে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এবারের পরিদর্শনের আগের দিন পর্যন্ত লাইব্রেরিতে ওইসব বই ছিল। পরিদর্শন দল যাওয়ার আগের দিন লাইব্রেরি থেকে ১৪টি নিষিদ্ধ বই সরিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। যদিও তাদের দাবি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর কোনো কার্যকলাপে অংশগ্রহণ কিংবা সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তৎপরতায় প্রশ্রয় দেয়ার প্রশ্ন ওঠে না। এ ব্যাপারে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে প্রায় এক বছর আগে ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যা¤েপ অঙ্গীকারনামা দিতে বললেও তারা তা দেয়নি। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান সমস্যা নিরসনে মোট ১৭টি সুপারিশ করেছে ইউজিসির তদন্ত কমিটি। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সার্বিক কার্যক্রম নজরদারির লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটিতে পর্যবেক্ষক বসানো, একাডেমিক কাউন্সিল ও বিভিন্ন নিয়োগ কমিটিতে ইউজিসির দুজন করে সদস্য মনোনয়ন এবং সার্বিক হিসাব-নিকাশ একটি নিরপেক্ষ সিএ ফার্ম দ্বারা নিরীক্ষা করানো। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক কর্মকান্ডের ওপর এর আগে ইউজিসি যেসব অনিয়ম চিহ্নিত করে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে, তা মন্ত্রণালয় মনোনীত নিরপেক্ষ সিএ ফার্ম দ্বারা পর্যালোচনা করা এবং গত ১০ বছরের নিরীক্ষিত অডিট রিপোর্ট সরকার কর্তৃক মনোনীত সিএ ফার্মের মাধ্যমে আবার নিরীক্ষার সুপারিশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিওটি এখতিয়ারের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করছে। বিওটির নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭টি কমিটি আছে। এটা বিওটির একচ্ছত্র আধিপত্যের প্রমাণ। শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে বিওটি সদস্যদের সুপারিশ থাকে। চলতি বছরের ¯িপ্রং সেমিস্টারে বিওটি সদস্যদের সুপারিশে ৬০-৭০ জন ভর্তি হয়েছে। ১৯ সদস্যের মধ্যে ১০-১২ জন প্রভাব বিস্তার করেন। বিওটি সভায় উপস্থিতির জন্য সদস্য ড. রওশন আলমকে পত্র না দেয়ায় তিনি একটি রিট মামলা করেছেন। ফলে গত ১৮ জুনের এজিএম স্থগিত হয়। ইউজিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিওটির সদস্যরা মিটিং অ্যালাউন্স বাবদ প্রতি সভার জন্য ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা গ্রহণ করেন। তাদের বিদেশ ভ্রমণ অব্যাহত আছে। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এবারের ১৪ জুলাই পর্যন্ত সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের নামে বিওটির কিছু সদস্য চারবার বিদেশ গেছেন। এর মধ্যে ভিসি গেছেন মাত্র একবার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে অধিকাংশ বিওটি সদস্যের বিলাসবহুল অফিস কক্ষসহ ট্রাস্টের সচিবালয় আছে। কাজেই সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। এমনকি আর্থিক বিষয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটির ভূমিকা স্বচ্ছ নয় বলেও মনে করে তদন্ত কমিটি। আইন লংঘন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের অর্থ বিওটির কিছু সদস্য ব্যয় করছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই তহবিলে ৬শ কোটি টাকা আছে। এর মধ্যে আড়াইশ কোটি টাকা জমি ক্রয়ের নামে তুলে ব্যয় করা হয়েছে। এর জন্য সরকার বা ইউজিসির কোনো পূর্ব অনুমোদন নেয়া হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক ভিসি অধ্যাপক আমিন ইউ সরকারের পদত্যাগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আইন লংঘন করে অস্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। আইনের ৯(৪) ধারা মতে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র মেধাবী কোটায় ভর্তি করানো হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও কোর্সে ইউজিসির অনুমোদনের আসন সংখ্যার চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। বলার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্ট্যাচুট প্রণয়ন করা হয়নি। গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ নেই। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কর্মকান্ড সন্তোষজনক নয়।