একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের সাফল্য ………………….আকবর হোসেন, পরিচালক একটি বাড়ি একটি খামার

0
2026

গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সংগঠিতকরণ, সঞ্চয়ে উৎসাহ প্রদান, সদস্য সঞ্চয়ের বিপরীতে সমপরিমান অর্থ বোনাস প্রদান, সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের মানবসত্তাকে শাণিতকরণ, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনায় পুঁজি গঠনে সহায়তা প্রদান করাই
একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের  সাফল্য
………………….আকবর হোসেন, পরিচালক
একটি বাড়ি একটি খামার

অপরাধ বিচিত্রাঃ একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের দর্শন, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি?
প্রকল্প পরিচালকঃ একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সংগঠিতকরণ, সঞ্চয়ে উৎসাহ প্রদান, সদস্য সঞ্চয়ের বিপরীতে সমপরিমান অর্থ বোনাস প্রদান, সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের মানবসত্তাকে শাণিতকরণ, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনায় পুঁজি গঠনে সহায়তা প্রদান, আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার কার্যক্রমসহ বহুমুখী কর্মকান্ড পরিচালনা করা হচ্ছে। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মূলদর্শন হল, প্রচলিত ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনের পরিবর্তে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মাধ্যমে স্থায়ী তহবিল গঠন করে দিয়ে পুঁজির অভাব দূর করে কর্মসৃজন করে দেয়া। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নপ্রসূত এ প্রকল্প সারা দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দারিদ্র বিমোচনে এ প্রকল্প উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। প্রকল্পের আওতায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী চিহ্নিত করে তাদেরকে গ্রাম উন্নয়ন সমিতিতে অন্তর্ভূক্ত করা হচ্ছে। যার মধ্যে ৪০ জন মহিলা ও ২০ জন পুরুষ সদস্য। তাদের নিজস্ব তহবিল সৃষ্টির লক্ষ্যে সদস্যগণ তাদের সমিতিতে মাসিক ২০০ টাকা সঞ্চয় জমা প্রদান করছেন। সরকার প্রকল্পের মাধ্যমে সদস্য সঞ্চয়ের বিপরীতে সমপরিমাণ উৎসাহ বোনাস প্রদান করছে। প্রতি সমিতিতে বার্ষিক ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা আবর্তক তহবিল প্রদান করছে। এতে বছরে ৬০ জনের একটি সমিতিতে ৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার তহবিল গঠন হচ্ছে। দুবছরে প্রকল্প প্রদত্ত সুবিধাসহ সমিতির তহবিল ৯.০০ লক্ষাধিক টাকায় উন্নীত হয়। এ তহবিল স্থায়ী এবং ফেরতযোগ্য নয়। সমিতির সদস্যগণ নিয়মিত উঠান বৈঠকে মিলিত হয়ে নিজস্ব সিদ্ধান্তে এ তহবিল হতে ঋণ গ্রহণ আয়বর্ধক কাজে নিয়োজিত হন। মাত্র ৮% সার্ভিসচার্জসহ গৃহীত অর্থ নিজেদের জন্য সহনীয় কিস্তিতে আবার সমিতিতেই ফেরত প্রদান করেন। পূনরায় নতুন কোন আয়বর্ধক কাজের জন্য ঋণ গ্রহণ করেন। ঘূর্ণায়মান এ প্রক্রিয়ায় সমিতিভুক্ত পরিবারগুলো স্থায়ীভাবে দারিদ্রমুক্তির সুযোগ পাচ্ছে।
অপরাধ বিচিত্রাঃ একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের এ পর্যন্ত সাফল্য ও অর্জনগুলো কি?
প্রকল্প পরিচালক দেশের ৬৪টি জেলায় ৪৮৫টি উপজেলার ৪৫০৩টি ইউনিয়নের ৪০৫২৭টি ওয়ার্ডে এ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় গঠিত হয়েছে ৪০ হাজারের অধিক গ্রাম উন্নয়ন সমিতি। প্রকল্পের নীতিমালা অনুযায়ী সমিতিতে পরিব পরিবার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে প্রায় ২২ লক্ষ, যার মোট জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ। সদস্যদের শতকরা ৬০ ভাগ নারী। প্রকল্পের মাধ্যমে বর্তমানে দেশের প্রায় ৩০ ভাগ দরিদ্র জনগোষ্ঠী দারিদ্রমুক্তির সুযোগ পাচ্ছে। পর্যায়ক্রমে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমিতির মাধ্যমে দরিদ্রজনগোষ্ঠীর তহবিল গঠনের প্রক্রিয়ায় সদস্যগণ ১০০০ কোটি টাকার অধিক সঞ্চয় জমা করেছে। যার বিপরীতে সরকার প্রদান করেছে ১৯৫৬ কোটি টাকা। প্রকল্পের সদস্যদের মোট তহবিল দারিয়েছে ৩১১৩ কোটি টাকা। যার লেনদেন সমিতির নিজস্ব ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে। এ তহবিল ব্যবহার করে প্রকল্পের সদস্যরা কৃষি ও অকৃষি খাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকল্প গ্রহণ করে আয়বর্ধক কর্মকা-ের মাধ্যমে তাদের ভাগ্যন্নোয়নে নিয়োজিত রয়েছে। সদস্যদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খামারের সংখ্যা ২৬ লক্ষ ৮২ হাজারে উন্নতি হয়েছে, যাতে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ৩৪৪৮ কোটি টাকা। প্রকল্পের ব্যবস্থাপনায় ইতিমধ্যে ৮ লক্ষাধিক সদস্য ও কর্মকর্তা/কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। প্রকল্পের উপকারভোগী ২২ লক্ষ পরিবারের অনলাইন ডাটাবেস তৈরী হয়েছে। তারা সঞ্চয় জমা, ঋণ গ্রহণ ও ঋণের কিস্তি জমাসহ সকল আর্থিক কর্মকান্ড অনলাইন ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে পরিচালনা করছে। এ প্রকল্পের কার্যক্রমকে স্থাইরূপ প্রদানের জন্য সরকার ইতিমধ্যে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক স্থাপন করছে। ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু করেছে। বলা যায় একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ জনপদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে।
অপরাধ বিচিত্রাঃ একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প দর্শনের সাথে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম বা এনজিও কার্যক্রম বা এনজিও কার্যক্রমের পার্থক্য কি?
প্রকল্প পরিচালক আবহমান কাল থেকে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম চলে আসলেও তা দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাঙ্খিত ভূমিকা রাখতে পারেনি। দরিদ্র মানুষের জন্য যে পরিমান সরকারি/বেসরকারি উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে, তাতে বহু আগেই বাংলাদেশ দারিদ্রমুক্ত হওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু তা হয়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর কারণগুলো চিহ্নিত করে দরিদ্র মানুষের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের পরিবর্তে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মাধ্যমে স্থায়ী তহবিল গঠন করে দেয়ার ধারনার প্রবর্তন করেন। যে তহবিল বংশ পরম্পরায় তারা ব্যবহার করে দারিদ্রমুক্ত হবেন। ক্ষুদ্র ঋণের পদ্ধতিতে এ সুযোগ নেই। ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সরকারি/বেসরকারি সংস্থা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে তা আবার সুদসহ ফেরত নিয়ে আসে। ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবহার, কিস্তি পরিশোধ, কিস্তির মেয়াদ ইত্যাদি ঋণ প্রদানকারী সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্তে পরিচালিত হয়। এতে ঋণ গ্রহণকারীর নিজস্ব মতামত প্রদান বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোন সুযোগ নেই। ফলে চাপিয়ে দেয়া ক্ষুদ্র ঋণে দরিদ্র মানুষ সামান্যই উপকৃত হয়। পক্ষান্তরে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের ক্ষুদ্র সঞ্চয় মডেল দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করে তাদের সঞ্চয়ের বিপরীতে সরকার থেকে সমপরিমাণ বোনাস প্রদান এবং সমিতিতে নির্দিষ্ট পরিমান আবর্তক তহবিল প্রদান করে তাদের স্থায়ী তহবিল গঠন করে দেয়া হয়। এ তহবিল তারা স্বল্প সেবামূল্যে নিজস্ব সিদ্ধান্তে ব্যবহার করে তাদের জীবনমান উন্নয়নে নিয়োজিত হয়। এটি তাদের স্থায়ী তহবিল। কোন কর্তৃপক্ষের নিকট এ তহবিল ফেরত দেয়ার প্রয়োজন হয়না। সদস্যগণ নিজেরাই পছন্দমত ঋণ গ্রহণ ও কিস্তি নির্ধারণ করেন। ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে তারা পুনরায় ঋণ গ্রহণ করেন। কারণ এ তহবিল তাদের নিজস্ব। দারিদ্রবিমোচনের এ ক্ষুদ্র সঞ্চয় মডেল পরীক্ষিত মডেল পরিণত হয়েছে। এ মডেলে দারিদ্রশূন্য বাংলাদেশ গড়ার কার্যক্রম এগিয়ে চলছে।
অপরাধ বিচিত্রাঃ এ প্রকল্পের সুবিধাভোগী কারা এবং কি প্রক্রিয়ায় সুবিধাভোগী হতে পারে?
প্রকল্প পরিচালক: সারাদেশের প্রতিটি ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডের একাধিক গ্রামে প্রকল্প কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে প্রকল্পের সুবিধাভোগী নির্বাচন করা হয়। অগ্রাধিকারভিত্তিক সুবিধাভোগী নির্বাচন নীতিমালা নিন্মরূপ।
১। ভিক্ষুক পরিবার, যাদের নিজস্ব জমি/বসতভিটা নেই, অন্যের জমিতে বা ছিন্নমূল হিসেবে বাস করে।
২। ভিক্ষুক পরিবার, যাদের নিজস্ব বসতভিটা আছে, কিন্তু জরাজীর্ন ঘরে বাস করে।
৩। হতদরিদ্র পরিবার, যাদের জমি আছে কিন্তু ঘর নেই।
৪। হতদরিদ্র পরিবার, যাদের নিজস্ব জমির পরিমাণ একেবারেই নগন্য।
৫। বিধবা/স্বমী পরিত্যক্তা মহিলা পরিবার প্রধান, যাদের জমির পরিমাণ অনধিক ৩০ শতক।
৬। দরিদ্র পুরুষ পরিবার প্রধান, যাদের জমির পরিমাণ অনধিক ৫০ শতক।
৭। দরিদ্র পরিবার, যাদের জমির পরিমাণ অনধিক ৫০ শতক।
৮। পাহাড়ী/চরাঞ্চলের দরিদ্র পরিবার, যাদের জমির পরিমাণ অনধিক ১.০০ একর।
৯। প্রকৃতি/ইকোসিস্টেম সংরক্ষণে নিয়োজিত দরিদ্র পরিবার, যারা প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।
ওয়ার্ড/গ্রাম পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার কর্তৃক নিয়োগকৃত ইউনিয়নের ট্যাগ অফিসারের নেতৃত্বে গরিব উপকারভোগী নির্বাচনের প্রকাশ্য সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয়ভাবে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, মাইকিং করে এ সভায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। এ কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে প্রকল্পের উপজেলা সমন্বয়কারী এ সভা অনুষ্ঠানের সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রকাশ্য সভায় সর্বসাধারণের কাছে যিনি গরিব বিবেচিত হন তিনিই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্পের সমিতির সদস্য হওয়ার সুযোগ পান।
অপরাধ বিচিত্রাঃ এ প্রকল্পের সদস্যদের সুবিধা অসুবিধা বিষয় কিভাবে সমাধান করা হয়?
প্রকল্প পরিচালক: এ প্রকল্পের আওতায় ৬০ জন সদস্য সমন্বয়ে একটি গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠিত হয়। সমিতির সদস্যগণ প্রতি সপ্তাহে একটি উঠান বৈঠকে উপস্থিত হয়ে সমিতির কর্মকা- বিষয়ে আলোচনা করে থাকেন। এ বৈঠকেই তাদের আর্থ-সামাজিক সকল বিষয় আলোচিত হয়। তাদের সমস্যাদি তারা নিজেরা আলোচনা করে এ বৈঠকেই সমাধান করে থাকেন। তাদের আওতা বহির্ভুত যে কোন বিষয় প্রকল্পের উপজেলা কার্যালয়ের মাধ্যমে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট উপস্থাপিত হয়। একই সাথে তাদের বিষয়গুলো উপজেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটিতেও আরোচিত হয়। ইউএনও তাদের সমস্যা সমাধানে কার্যক্রম গ্রহণ করেন।
অপরাধ বিচিত্রাঃ একটি বাড়ি একটি খামার বিষয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
প্রকল্প পরিচালক: একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মডেলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য স্থায়ী তহবিল গঠন করে দিয়ে উক্ত তহবিল ব্যবহার করে স্থায়ী দারিদ্র বিমোচন আজ একটি সার্বজনীন দরিদ্র বিমোচন মডেলে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এ মডেলে দারিদ্র শূন্য বাংলাদেশ বিনির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের ৩য় সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে। এর মাধ্যমে অতিরিক্ত ৩০ লক্ষ দরিদ্র পরিবারকে প্রকল্পভুক্ত করে দারিদ্রমোচন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। ২০২০ সাল নাগাদ এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৫২ লক্ষ দরিদ্র পরিবারকে দারিদ্রমুক্ত করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০২২ সালের মধ্যে দেশকে দারিদ্রমুক্ত করে মধ্যম আয়ের দেশ রূপান্তরের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একটি বাড়ি একটি খামার প্রধান সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

2 + 18 =