দক্ষিণ এশিয়ায় সাংবাদিকতা অত্যন্ত বিপজ্জনক …….ওয়াল্টার রবিনসন

0
1453

মার্কিন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ওয়াল্টার রবিনসন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্র বোস্টন গ্লোব-এর সম্পাদকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন চার দশকের বেশি সময় ধরে। বর্তমানে তিনি পত্রিকাটির ভ্রাম্যমাণ সম্পাদক (এডিটর-অ্যাট-লার্জ)। তিনি বহুল আলোচিত ‘স্পটলাইট’ প্রতিবেদনের অনুসন্ধানী টিমের নেতৃত্বে ছিলেন। ২০০২ সালে বোস্টন গ্লোব-এ ছাপা হয়েছিল শিশুদের ওপর যাজকদের যৌন নির্যাতন নিয়ে সাড়া জাগানো ওই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। পরের বছর ওই প্রতিবেদনের জন্য পুলিৎজার পুরস্কার দেওয়া হয় ‘স্পটলাইট’ টিমকে। পরে এই প্রতিবেদনের গল্প নিয়ে স্পটলাইট নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। গত ২২ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে দ্বিতীয় এশিয়ান ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলেন ওয়াল্টার রবিনসন। সেখানে তাঁর এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
প্রশ্ন ঃ আপনি কবে বোস্টন গ্লোব-এ যোগ দিয়েছেন?
ওয়াল্টার রবিনসন ঃ গ্লোব আমাকে প্রথমে একজন শিক্ষানবিশ প্রতিবেদক হিসেবে নিয়োগ দেয়। কিন্তু সাংবাদিকতার সঙ্গে আমার যোগাযোগ আরও অনেক আগে, ১১ বছর বয়সে। প্রতিদিন ভোর পাঁচটার দিকে ঘুম থেকে উঠে সাইকেল চালিয়ে তিন ব্লোক পেরিয়ে আমি এক বান্ডিল পত্রিকা আনতে যেতাম। পত্রিকাগুলো সেখানে একটি বৈদ্যুতিক বাতির থামের গোড়ায় রেখে যাওয়া হতো। সেগুলো বিলি করার দায়িত্ব ছিল আমার। তো বান্ডিল খুলে বাড়ি বাড়ি পত্রিকা বিলি করার আগেই আমি ওসব পত্রিকার প্রথম আর শেষ পাতায় চোখ বুলিয়ে নিতাম দিনের প্রধান খবরগুলো জানার জন্য। আমি পত্রিকা পড়তাম; কারণ, আমার মনে হতো, এটি আমাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দিত, ক্ষমতায়ন করত। পুরো জনপদের কোথায় কী হচ্ছে বা হয়েছে, তা জানে, এ রকম একজন প্রথম ব্যক্তি হওয়ার আনন্দ ও গৌরব দারুণ মনে হতো।
প্রশ্ন ঃ বিশ্বপরিসরে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কত দূর এগিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
ওয়াল্টার রবিনসন ঃ আসলে আমার এখানে (এশিয়ান অনুসন্ধানী সাংবাদিক সম্মেলন) আসার একটি কারণ হচ্ছে, বিশ্বপরিসরে কী হচ্ছে, সে বিষয়ে একটা ধারণা নেওয়া। কারণ, আমার অনুসন্ধানী রিপোর্টিং মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গলিতে সীমাবদ্ধ। নব্বইয়ের দশকে আমি ইউরোপে কিছু রিপোর্টিং করেছি, তবে তা তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। এ সম্মেলনে এসে শুনতে পারলাম, বুঝতে পারলাম, আমাদের পক্ষে আরও কত দূর যাওয়া সম্ভব। যেসব দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা দুরূহ বা কিপূর্ণ, সেসব দেশের সাংবাদিকদের জন্য কী কতটা করা সম্ভব এ সম্মেলন থেকে তার একটা ধারণা পাওয়া গেছে। আমার মনে হয়েছে, এ সম্মেলনে যেসব সাংবাদিক এসেছেন, তাঁদের অনেক কিছু করার আছে এবং তাঁরা আরও অনেক কাজ করতে পারবেন। সামনের দিনগুলোতে প্রতিবেদকেরা কেমন হবেন এবং কী করতে পারবেন, তা ভেবে আমি অত্যন্ত আশাবাদী। প্রত্যেকের মধ্যে যে চিন্তাভাবনা দেখেছি, তা আমাদের অনেক দূর নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। এ ছাড়া শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কীভাবে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা যায়, সে বিষয়েও অনুসন্ধানী প্রতিবেদকেরা এ সম্মেলন থেকে কিছু ধারণা পেয়েছেন।
প্রশ্ন ঃ পাশ্চাত্য ও উন্নত দেশগুলোর তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গোপনীয় নথিপত্র, তথ্য-উপাত্ত ইত্যাদি জোগাড় করা খুব কঠিন। এসব দেশের সাংবাদিকদের এ সমস্যা কীভাবে মোকাবিলা করা উচিত?
ওয়াল্টার রবিনসন ঃ আমার মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্রে ও দক্ষিণ এশিয়ায় সাংবাদিকেরা সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটির মুখোমুখি হন তা হচ্ছে মিডিয়ার সম্পাদক বা মালিক। কারণ, সম্পাদক বা মালিক প্রায়ই বলে ওঠেন, ‘দেখেন, আমার মনে হয়, আমাদের এ কাজ করা ঠিক হবে না, আমাদের প্রয়োজন নেই।’ যুক্তরাষ্ট্রেও এ রকম ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা চীনে প্রায় সব সময়ই যে প্রশ্নটি সামনে চলে আসে তা হলো জীবনের নিরাপত্তা। কোনো একটি বিষয়ে কাজ করা সাংবাদিকদের জন্য হয়তো অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। জীবনের ঝুঁকি তৈরি হয় বা পত্রিকার ওপর চাপ সৃষ্টি হয়।
প্রশ্ন ঃ এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী করা উচিত?
ওয়াল্টার রবিনসন ঃ আমার মনে হয়, যখন আপনি এ ধরনের প্রতিরোধের সম্মুখীন হবেন, তখন সামনে এগোনোর সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে একটু একটু করে অগ্রসর হওয়া। মনে করুন, আমাদের সামনে গ্রানাইটের বিরাট একটি খন্ড আছে এবং আমাদের সবার হাতে একটি করে বাটাল। আমরা যদি প্রতিবার গ্রানাইটের ওই খন্ড থেকে একটু একটু করে খসিয়ে দিতে পারি, তাহলে ধীরে ধীরে আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। মাঝেমধ্যে আমরা হয়তো খুব বেশি দূর এগোতে পারব না; কারণ, অনেক সময় দুই পা সামনে এগিয়ে আবার এক পা পেছাতে হয়। বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহি করানো খুব দুরূহ কাজ। তবু চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে আমরা খুব বেশি হলে সম্পাদক বরাবর একটি ক্ষুব্ধ চিঠি লিখে পাঠাতে পারি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমস্যার ভিন্নতা আছে। যুক্তরাষ্ট্রে আমরা যে স্বাধীনতা ভোগ করছি, তা পুরোপুরি কাজেও লাগাই না। তাই অনেক সুযোগ-সুবিধা পেলেও ‘মুক্ত’ বা ‘অবাধ’ প্রেস বা সংবাদপত্র পাই না। আবার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করার মতো স্বাধীনতা থাকলেও তা করার মতো প্রতিবেদক না-ও থাকতে পারে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ বলতে গেলে ‘সিরিয়াস’ সংবাদের ব্যাপারে ‘সিরিয়াস’ নয়। আমি মনে করি, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় সমস্যা।
প্রশ্ন ঃ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য অনেক ধৈর্য আর সাহস প্রয়োজন। এর জন্য মানসিকতা কেমন হওয়া উচিত?
ওয়াল্টার রবিনসন : সাংবাদিক হিসেবে আমরা সবাই প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে কোথায় কী হচ্ছে, তার খোঁজ পাই। ঘটনাগুলোর সরকারি ভাষ্যে আমরা সন্তুষ্ট নই আর তাই সত্য উদ্ঘাটন করতে চাই। এটিই আমাদের কাজ। আমরা সত্যিকারের ঘটনা রিপোর্ট করি এবং তা যথাসম্ভব বস্তুনিষ্ঠভাবে এবং পরিপূর্ণভাবে করার চেষ্টা করি। এটা করতে পারলে আমরা তৃপ্তি পাই এবং এ জন্যই আমাদের কাজটি গুরুত্বপূর্ণ। যখন সরকার আমাদের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন কাজটি দুরূহ হয়ে পড়ে। কিন্তু আমার মনে হয়, সব সরকারের ভেতরের অনেক লোকই বিশ্বাস করেন, সত্যি সত্যি যা ঘটছে, তা প্রকাশ পাওয়া উচিত। তাই সাংবাদিকদের থেমে গেলে চলবে না।
প্রশ্ন ঃ ক্যাথলিক গির্জার অভ্যন্তরে কম বয়সী ছেলেদের যৌন হয়রানির মতো গুরুতর একটি বিষয় উদ্ঘাটিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আপনি বা আপনার টিম কি এ নিয়ে কোনো সন্দেহ করেছিল?
ওয়াল্টার রবিনসন ঃ চার্চের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা আমাকে অবাক করেনি। কারণ, চার্চে একটি হায়ারার্কিক্যাল নেতৃত্ব দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত। এ ধরনের নেতৃত্বের অধীনে জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে ওঠার সুযোগ খুব একটা থাকে না। থাকলেও নেতৃত্ব বিকশিত হতে পারে না। জবাবদিহি, পরিক্ষণ, সংশোধন ইত্যাদির অনুপস্থিতিতে কেউ একজন মুহূর্তের ভুলে যৌন হয়রানির মতো গুরুতর অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে তাতে আমি অবাক হইনি। তবে অবাক হয়েছি চার্চের নেতৃত্বের পক্ষ থেকে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা দেখে।
প্রশ্ন ঃ এবার আসি স্পটলাইট সিনেমার বিষয়ে। চারজন সাংবাদিক নিয়ে গড়া এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন আপনি। ছবিতে অনুসন্ধানের দীর্ঘ প্রক্রিয়া দেখানো হয়েছে। একটা প্রতিবেদন তৈরি করতে কত গবেষণা করতে হয়, সেই খাটুনিটাও দেখানো হয়েছে। প্রতিবেদনটা সবার আগেই প্রকাশ করতে হবে, এমন একটা চাপ ছিল। কারণ, প্রতিপক্ষ বোস্টন হেরাল্ড পত্রিকা যদি আগে স্টোরিটা ব্রেক করে, তাহলে স্পটলাইট টিমের সব কষ্টই বৃথা। স্পটলাইট ছবিতে আপনার ভূমিকায় মাইকেল কিটনকে অভিনয় করতে দেখে আপনার কেমন লেগেছে?
ওয়াল্টার রবিনসন ঃ এই কাজে ওরা, মাথায় আমার চেয়ে কম চুল আছে, হলিউডের এমন একমাত্র অভিনেতা বাছাই করেছেন। আমার খুব ভালো লেগেছে; কারণ, ও একজন দারুণ অভিনেতা। আপনি জানেন নিশ্চয়ই, ও একবার দ্য পেপার (১৯৯৪) শিরোনামের একটি ছবিতে একটি বড় পত্রিকার নগর সম্পাদকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল। এটি বেশ ভালো একটি ছবি, সব সাংবাদিকের দেখা উচিত। ও যখন নব্বইয়ের দশকে ওই চরিত্রে অভিনয় করছিল, আমি তখন বোস্টন গ্লোব-এর নগর সম্পাদক ছিলাম। তাই ওরা যখন বলল, ও এ চরিত্রে অভিনয় করতে যাচ্ছে, আমি বললাম, তাহলে বেশ ভালোই হবে। ও যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ভালো অভিনেতাদের একজন। খুব বিশ্বস্ত অভিনয় করেছে মাইকেল কিটন। সাংবাদিকেরা কীভাবে হোঁচট খান, নিজেদের মধ্যে তর্কে লিপ্ত হন এবং কী হচ্ছে, তা বের করতে যুগের পর যুগ সময় নেন এ দিকগুলো ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে ছবিটি দারুণ ভাবে সফল। আমরা সাংবাদিকেরা কীভাবে কথা বলি, কীভাবে এটা-ওটা করি এসব রপ্ত করার পেছনে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সবাই অনেক সময় দিয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

7 − four =