সরেজমিনে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে থাকছেন না আবাসিক মেডিকেল অফিসার * রোগী ভর্তিতে তালবাহানা * নিয়মবহির্র্ভূত অর্থ আদায় * ঔষধ সংকট * কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা * উন্নয়নের নামে আইÑওয়াশ মাত্র

0
1459

ষ্টাফ রিপোর্টার ঃ ১৬ই এপ্রিল ২০১৭, সময় বিকাল ৫.৫০ মিনিট। সরেজমিনে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরূরী বিভাগে গিয়ে দেখা গেল রোগীর চিকিৎসায় ব্যাস্ত জরূরী বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসকসহ অন্যান্য ব্যাক্তিরা। পাশেই বসে আছেন একটি ঔষধ কোম্পানীর দুজন মার্কেটিং বিভাগের লোক। অতঃপর জরূরী বিভাগ ছেড়ে সোজা হাসপাতালের ২য় তলায় আবাসিক মেডিকেল অফিসারের কক্ষের সামনে গিয়ে দেখা গেল কক্ষটি তালাবদ্ধ। পাশেই নার্সেস রুম। সেখানে কর্তব্যরত এক সেবিকার নিকট হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসারকে কখন পাওয়া যাবে জানতে চাইলে তিনি সোজাসুজি জানিয়ে দিলেন, ”এই সময়কি আর.এম.ও স্যারকে পাবেন! আগামীকাল সকালে ১২টার মধ্যে আসেন পেয়ে যাবেন। শুক্র ও শনিবার ব্যাতিত সপ্তাহে যে কোন দিন বেলা ১২টা পর্যন্ত তাকে পাওয়া যায়, এর পরে আর তিনি থাকেন না।” ঐ সেবিকার সাথে কথা বলে বিদায় নিয়ে হাসপাতালের মহিলা ওয়ার্ডের সামনে ষাটোর্দ্ধ এক নারীকে এক নবজাতক শিশুকে কোলে নিয়ে পায়চারি করতে দেখে এগিয়ে গিয়ে তার সাথে কুশল বিনিময়ের পর হাসপাতালের সেবা সম্পর্কে তার মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ” সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসা আর কেমুন হইবো! যেমুন দেখতাছেন এমুনই। পোলার বউয়ের বাচ্চা হইবো দেইখা কালকা (গতকাল) এইহানে আইনা ভর্তি করাইলাম, আইজকা (আজ) সকালে এইযে নাতি হইলো। চিকিৎসা বইলতেতো স্যালাইন ছাড়া আর কিছুই হেরা (তাহারা) দেয়না, সব ঔষধই বাইরেরতুন কিনন লাগে। বাচ্চা হইতেও ওটির (অপারেশন থিয়েটার) লাইগা ৫০০ টেহা (টাকা) নিলো। সরকারী দেইখা খরচ তো আর কম না, শুধু ডাক্তার আর বেডের খরচটাই মাফ পাওন যায়। আর হাসপাতাল থেইকা যেই খাওন (খাবার) দেয়, সকালের নাশÍা ছাড়া আর কিছুই খাওন (খাওয়া) যায় না। দুপুর-রাইতে ভাতের সাথে এক টুকরা তেলাপিয়া মাছ আর পাতলা ডাইল (ডাউল), এক্কেরে বাজে তরকারী, খাওন যায়না। আর বাথরূমের যে গন্ধ আহে (আসে) তাতে ওয়ার্ডে থাকন (থাকা) যায়না। অতঃপর তার সাথে কথা বলে মহিলা ওয়ার্ডে প্রবেশ করে পাওয়া গেল তার অভিযোগের সত্যতা। বাথরুমের দূর্গন্ধে ওয়ার্ডে বসে থাকা কষ্টসাধ্য। রোগীদের আশেপাশে চোখে পড়লো কয়েকটি বিড়ালের আনাগোনা। এরপর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আরও কয়েকজন রোগীর সাথে কথা বলে পাওয়া গেল প্রায়ই একই রকম অভিযোগ। সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে ওটি ফি’র বাহানায় রোগী প্রতি আদায় করা হচ্ছে ৫০০ টাকা হারে।
সরেজমিনে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেবা কার্যক্রম পর্যবেক্ষন ও দীর্ঘ অনুসন্ধানে এসকল চিত্রই ফুটে ওঠে অপরাধ বিচিত্রার কাছে।
অনুসন্ধানে হাসপাতালে আসা বিভিন্ন ভর্তি ইচ্ছুক রোগী ও তাদের স্বজনদের সাথে কথা বলে দেখা যায়, কোন ব্যাক্তি বা সংঘবদ্ধ চক্র কর্তৃক হামলার শিকার , কোন ঘটনায় আহত বা শারীরিক আঘাতপ্রাপ্ত পুলিশ কেসের রোগীদের ভর্তির ক্ষেত্রে  তালবাহানা করছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন বাহানায় এসকল রোগীদের নিজ বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা গ্রহনের পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। দেখা গেছে শারীরিক আঘাতজনিত কারনে সোজা হয়ে বসতে পাড়ছেন না এমন রোগীকেও বাসায় নিয়ে যেতে বলছেন হাসপাতালে কর্তব্যরতরা। অন্যদিকে পুলিশ কেস ব্যতিত অন্য কোন রোগীর ক্ষেত্রে এই অনিহা প্রকাশ করতে দেখা যায়না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। এ বিষযে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালে কর্তব্যরত একাধীক ব্যাক্তি জানান, ” হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ আমজাদুল হক এবং আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ মোঃ জাহিদুর রহমানের নির্দেশেই তারা এসকল রোগীদের ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন । মূলত পুলিশি ঝামেলা ও সাংবাদিকদের প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া থেকে বিরত থাকতেই তাদের এই সিদ্ধান্ত।” হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে রোগীদের নিকট হতে ৫০০ টাকা হারে অর্থ আদায়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা বলেন, ” আগে ওটি ( অপারেশন থিয়েটার) বাবদ ২০০ টাকা হারে আদায় করা হতো, তবে বর্তমান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ কর্মকর্তা দায়িত্ব গ্রহনের পর তা বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করা হয়েছে।” অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, বর্তমান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ কর্মকর্তার বিভিন্ন কর্মকান্ড, ব্যাবহার ও স্বেচ্ছাচারিতায় খোদ হাসপাতালে কর্মরত অনেকেই ক্ষুব্ধ। অভিযোগ রয়েছে তার অবর্তমানে হাসপাতালে কর্মরত কোন ব্যাক্তি কোন সাংবাদিকদের সাথে কথা বললে সেই ব্যাক্তির ওপর বিভিন্ন প্রকার চাপ সৃষ্টি করেন ওই কর্মকর্তা। কোন সাংবাদিকের সাথে কথা বলতে রয়েছে তার কড়া নিষেধাজ্ঞা। অন্যদিকে আবাসিক মেডিকেল অফিসারের সার্বক্ষনিক হাসপাতালে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও, সর্বোচ্চ বেলা ২ টার পর আর তাকে হাসপাতালের আশে পাশেও পাওয়া যায়না। এর আগে গত অক্টোবর ২০১৬ মাসে হাসপাতালের জরূরী বিভাগের সামনে এক অজ্ঞাতনামা ব্যাক্তির লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। সে-সময় আবাসিক মেডিকেল অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন বর্তমান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পঃ পঃ কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ আমজাদুল হক। সেই ঘটনার রাতেও হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ছিলেন অনুপস্থিত। হাসপাতাল করিডোরে লাশটি কিভাবে এলো, কিভাবে ওই ব্যাক্তির মৃত্যু হলো তার কোন যৌক্তিক ব্যাখ্যা আজও মেলেনি। হতে পারে তখনকার কর্তব্যরত ব্যাক্তিদের অবহেলাই ছিল ঐ অজ্ঞাতনামা ব্যাক্তির মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারন! তাছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হতে ঔষধের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ঔষধ সংকট থাকলেও সংকট নেই আশেÑপাশের ঔষধ বাজারে। সাভারের নামা বাজার, বাজার রোড, থানা রোড, কর্ণপাড়া, উলাইল, নামাগেন্ডা, ফুলবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকার ফার্মেসীগুলো ঘুরে দেখা যায়, ফার্মেসীগুলোতে হরদম চলছে সরকারী ঔষধের বেচাকেনা। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে থানা রোডের এক ফার্মেসী মালিক জানান, ” খোলা বাজারে সরকারী এ সকল ঔষধের সরবরাহ নিশ্চিত করছে খোদ সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত ব্যাক্তিরা। এক সাথে বেশ কিছু ঔষধ জমিয়ে তা হাসপাতালের মাঠকর্মি দ্বারা পাইকারী ঔষধ বিক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করা হয়। এরপর পাইকারী ব্যাবসায়ীদের হাত হয়ে তা চলে যায় বিভিন্ন মহল্লার খুচরা ফার্মেসীগুলোতে।”
এছাড়া সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবা নিতে আসা বিভিন্ন রোগীদের সাথে কথা বলে খোদ হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের মৌখিকভাবে রোগীদের বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিকে প্রেরনের প্রবনতার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তাদের এসকল অনিয়ম, অবহেলা আর নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়ের বিষয়ে ঢাকা জেলা সিভিল সার্জন জনাব মোঃ এহসানুল করিমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ সকল বিষয়ে অবগত নন বলে দাবী করেন। সেই সাথে তিনি এসকল বিষযে তদন্তপুর্বক যথাযথ ব্যাবস্থা গ্রহনেরও আশ্বাস দেন।
সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সার্বিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষনে দেখা যায়, বর্তমান সময়ে উন্ন্য়নের নামে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন কার্যক্রম সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের চোখ ফাকি দেওয়ার জন্য আই-ওয়াশ মাত্র। চিকিৎসাখাতে উন্নয়নের স্বার্থে বর্তমান সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের গ্রহন করা সকল পদক্ষেপ ও কার্যক্রম প্রতিনিয়তই ব্যাহত হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এসকল অনিয়ম আর অবহেলা দ্বারা। চিকিৎসাখাতে বর্তমান সরকারের উন্নয়নমূলক সকল কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী এসকল অনিয়ম-অবহেলা অনতিবিলম্বে বন্ধ করা না গেলে আগামীতে এর ভয়াবহতা আরও বৃদ্ধি পাবে সেই সাথে বাড়বে সাধারন রোগীদের হয়রানী আর ভোগান্তির মাত্রা। (অপরাধ বিচিত্রা)

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

three × 3 =