অধিকাংশ ক্লিনিক অবৈধ কুমিল্লায়

0
948

অপরাধ বিচিত্রা

কুমিল্লার ‘বিষফোঁড়া’ দুশতাধিক অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিক। বৈধ কাগজপত্র ও লাইসেন্স না থাকাসহ নানা অনিয়ম ও অপরাধের দায়ে ইতোমধ্যে ১৭টি প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেয়া হয়। এছাড়া আমাদের এ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। প্রায় এক বছর আগে জাঁকজমকভাবে কুমিল্লার লাকসামের বিজরা বাজারে চিকিতসা সেবার ‘ব্যবসা’ শুরু করে এস.এম সাফি হাসপাতাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান। শুরু থেকেই কুমিল্লা-চাঁদপুর আঞ্চলিক মহাসড়কে উপজেলার সীমান্ত এলাকায় প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটিতে বড় পদের চিকিতসকরা রোগী দেখেন এমন কথা পোস্টার, ব্যানার ও মাইকিংয়ের মাধ্যমে বেশ জোরেসোরে প্রচার করে রোগীদের আকৃষ্ট করতে থাকেন মালিক পক্ষ। কিন্তু ‘নামিদামি’ এই হাসপাতালটি গত ৯ নভেম্বর হঠাত বন্ধ করে দিয়েছেন কুমিল্লা জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. মজিবুর রহমান। কারণ বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিদর্শন টিম পরিদর্শনে গিয়ে ঐ হাসপাতালের কোনো লাইসেন্সই খুঁজে পায়নি। এতে বোঝা গেছে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অবৈধভাবে সেবার নামে ব্যবসা চালিয়ে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধুমাত্র এস.এম সাফি হাসপাতাল নয়, কুমিল্লা জেলায় লাইসেন্সবিহীন এমন অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা দুইশ ছাড়িয়েছে। তবে স্থানীয় সূত্রের দাবি এই সংখ্যা প্রায় ডাবল হবে। গত ৭ থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ১০ দিনের অভিযানে জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে শুধুমাত্র ৩টি উপজেলা ও কুমিল্লা নগরীতেই লাইসেন্সবিহীন ১৭টি অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধ করেছেন জেলা সিভিল সার্জন। বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই শহর এলাকায় অবস্থিত। উপজেলা সদরের তুলনায় পিছিয়ে নেয় গ্রাম্য এলাকার হাটবাজারগুলোতে অবাধে গড়ে উঠা অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো। সেখানেও চলছে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রতিযোগিতা। তাহলে একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় পুরো জেলার কি অবস্থা। এছাড়া অনুমোদন পাওয়ার আগে শুধুমাত্র আবেদন করেই সেবার নামে ব্যবসা শুরু করেছেন অন্তত ২০টি প্রতিষ্ঠান।
সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের লাইসেন্স না পাওয়া পর্যন্ত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালু করে ব্যবসা পরিচালনা করা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং বেআইনি। কুমিল্লা জেলায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের লাইসেন্সপ্রাপ্ত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডেন্টাল ক্লিনিক, বস্নাডব্যাংক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা রয়েছে ২৭৫টি। যার মধ্যে শুধুমাত্র কুমিল্লা নগরীতেই রয়েছে ১০৩টি। এছাড়া জেলার চান্দিনায় ১২টি, চৌদ্দগ্রামে ১০টি, বরুড়ায় ৮টি, নাঙ্গলকোটে ৪টি, সদর দক্ষিণে ৬টি, লাকসামে ১৭টি, মনোহরগঞ্জে একটি, হোমনায় ১০টি, মেঘনায় একটি, বুড়িচংয়ে ৭টি, ব্রাহ্মণপাড়ায় ৬টি, তিতাসে ১১টি, দেবিদ্বারে ১৩টি, মুরাদনগরে ২৩টি ও দাউদকান্দিতে ৩৯টি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার লাইসেন্স প্রাপ্ত রয়েছে।
কিন্তু পুরো জেলার চিত্র দেখলে মনে হবে বৈধ প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অবৈধরাই এগিয়ে রয়েছে। উপজেলাগুলোর সদর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে প্রতিনিয়ত ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠেছে এসব অবৈধ ক্লিনিক-হাসপাতাল। জেলার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর বাজার থেকে হোমনা সড়কে প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকার মধ্যেই অন্তত ৪০টি ক্লিনিক-হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। যার বেশিরভাগেরই লাইসেন্স নেই। পুরো জেলার এসব অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বেশির ভাগেরই অবস্থা বেহাল। এসব প্রতিষ্ঠানে জেলা সিভিল সার্জন অফিস থেকে পরিদর্শনে গেলে প্রায়ই সন্ধান মিলে ভুয়া বিশেষজ্ঞ-সার্জারি চিকিৎসক, প্যাথলজিস্ট, সনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান ও নার্সের। আর জটিল রোগের অপারেশনে পিছিয়ে নেই বাহারি পদবির এসব বিশেষজ্ঞ চিকিতসক নামধারী ভুয়া ডাক্তাররা। জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলার বাসিন্দা দুলাল মিয়া, লাকসাম পৌর শহরের বাসিন্দা আবুল কালামসহ বেশ কয়েকজন সচেতন ব্যক্তি জানান, এসব অবৈধ ক্লিনিক-হাসপাতালে সু-কৌশলে রোগীদের পকেট কাটা হচ্ছে। অনেক সময় বড় বড় ভুয়া ডিগ্রি নিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে এসে ভুয়া চিকিৎসকরা এসব প্রতিষ্ঠানে মোটা অংকের ফি’তে রোগী দেখেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে এসব ভুয়া ডাক্তারদের ভুল চিকিৎসায় অকালে প্রাণ দিতে হয় অনেক মানুষকে। অবৈধ হাসপাতাল বৈধদের ছাড়িয়ে গেছে। এ যেন ‘নকলের ভিড়ে আসল চেনা দায়’ হয়ে পড়েছে। কুমিল্লা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, অবৈধভাবে কার্যক্রম পরিচালনার দায়ে গত ৭ থেকে ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিদর্শন করেন।
এ সময় কুমিল্লা নগরীতে ৬টি, জেলার চান্দিনা উপজেলায় ৭টি, লাকসামে ২টি, দাউদকান্দি উপজেলার ২টিসহ মোট ১৭টি হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বন্ধ করে দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলো হলো; চান্দিনা উপজেলার সরকারি হাসপাতাল সড়কে অবস্থিত পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মর্ডান ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মুক্তি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মাতৃ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মেডিনোভা হসপিটাল, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ সংলগ্ন চান্দিনা সেন্ট্রাল হাসপাতাল, লাকসাম উপজেলা বিজরা বাজারে এস.এম সাফি হাসপাতাল ও বিজরা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, দাউদকান্দি উপজেলার এ্যাপোলো প্লাস হসপিটাল, দাউদকান্দির লাইফ হসপিটাল অ্যান্ড ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার কুমিল্লা নগরীর রেসকোর্স সিমপ্যাথি হাসপাতাল, ঝাউতলা কমফোর্ট ডায়াগনস্টিক, সেভ লাইফ ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরিজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
এছাড়া ঐদিন নগরীর রেসকোর্সে অবস্থিত বি. রহমান হাসপাতালটি ভুয়া ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা ও চরম অব্যবস্থাপনার জন্য বন্ধ করা হয় এবং রেসকোর্স এলাকার মিশন হাসপাতালের প্যাথলজির ফ্রিজে রক্ত রাখায় উক্ত প্রতিষ্ঠানের প্যাথলজি বিভাগের কার্যক্রমও বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
ডা. মো. মজিবুর রহমান আরো জানান, প্রায় ২০টি প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র আবেদন করেই কার্যক্রম শুরু করেছে। ঐ প্রতিষ্ঠানগুলোকে গত ৮ নভেম্বর সাত দিনের মধ্যে ঐ সব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। গত ১৫ নভেম্বর নির্দেশনার সময় শেষ হয়েছে। এর মধ্যে যারা এখনও প্রতিষ্ঠান বন্ধ করেননি তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হবে। তিনি বলেন, আমাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মাধ্যমে প্রত্যেক উপজেলার লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। পরে পর্যায়ক্রমে প্রতিটিতে অভিযান চালানো হবে। তবে প্রাথমিক ধারণা থেকে বলা যায় পুরো জেলায় শতাধিক অবৈধ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাইসেন্স নিয়েই কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে বলে জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লা সিভিল সার্জন ডা. মো. মজিবুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের চূড়ান্ত অনুমোদন (লাইসেন্স) ছাড়া কোনো বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নার্সিং হোম, ডেন্টাল ক্লিনিকের কার্যক্রম শুরু করা যাবে না। এছাড়া শুধুমাত্র আবেদন করে অনুমোদন ছাড়াই প্রতিষ্ঠান খুলে চিকিৎসা কার্যক্রম চালানো সম্পূর্ণ অবৈধ এবং বেআইনি। গত ৭ নভেম্বর থেকে বৈধ কাগজপত্র ও লাইসেন্স না থাকার অপরাধসহ নানা অনিয়মের দায়ে ইতোমধ্যে ১৭টি প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া আমাদের এ অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

four × 5 =