চট্টগ্রামে ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের একের পর এক ঘটনা

0
683

চট্টগ্রামে ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের একের পর এক ঘটনা সামনে আসছে। কেউ ভোগ্যপণ্য আমদানির নামে ব্যাংকঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না। কেউ আবার জাহাজ ভাঙা শিল্পের নামে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। এবার আলোচনায় এক বালি ব্যবসায়ী। প্রায় শতকোটি টাকার ব্যাংকঋণ আত্মসাৎ করে এরই মধ্যে পালিয়েছেন আবু সালেহ মো. জাফর নামে ওই বালি ব্যবসায়ী। তাকে দেয়া এ ঋণের বিপরীতে জামানতও রাখেনি অর্থায়নকারী ব্যাংক এশিয়া। এতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে আবু জাফরের কাছ থেকে ব্যাংকের অর্থ উদ্ধার। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী ও ব্যাংকসূত্রগুলো বলছে, একসময় বালির ব্যবসা করতেন আবু জাফর।

সেই থেকে তার পরিচয় ‘বালি ব্যবসায়ী’ হিসেবে। বালি ব্যবসার সময় থেকেই ঋণ সুবিধা পেয়ে আসছিলেন এ ব্যবসায়ী। প্যাসিফিক মেরিন নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পর ঋণের পরিমাণও বেড়ে যায়। এমনকি জামানত ছাড়াও ব্যাংকঋণ পান আবু জাফর। তার কাছে জামানতবিহীন এমন ৮১ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে ব্যাংক এশিয়ার। ব্যাংকটির এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও হেড অব ব্রাঞ্চ (আগ্রাবাদ) সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ২০০৬-০৭ সালে প্যাসিফিক মেরিনের সঙ্গে ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার ব্যবসা শুরু হয়। তবে বড় অংকের ঋণ নেন কর্ণফুলীর ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ পাওয়ার পর। যদিও তা আর পরিশোধ করছে না। প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী আবু জাফর দেশের বাইরে অবস্থান করছেন বলে শুনেছি। ঋণের টাকা আদায়ে তাই আদালতে মামলা করতে হয়েছে। ব্যাংক এশিয়া ছাড়াও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকেরও সাড়ে ৬ কোটি টাকা বকেয়া রেখেছেন আবু জাফর। এ অর্থপ্রাপ্তিও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ব্যাংকের। ব্যাংকাররা বলছেন, কিছুদিন ড্রেজিংয়ের কাজ করে বড় অংকের বিলও পেয়েছেন আবু জাফর। তার পরও ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেননি। ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ না করেই একসময় দেশ ছাড়েন তিনি। আবু জাফরের পরিচিতজনরা জানান, একসময় কর্ণফুলী নদী ও বিভিন্ন খাল থেকে মাটি তুলে ইটভাটায় সরবরাহ করতেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার এ ব্যবসায়ী। পরে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে বালি সরবরাহ শুরু করেন। চট্টগ্রামের কয়েকটি বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসার সুবাদে বন্দরের নিয়মিত ড্রেজিংয়ের কাজ পান। এরই ধারাবাহিকতায় ২২৯ কোটি টাকার কর্ণফুলী নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ পায় প্যাসিফিক মেরিন। ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কিছু কাজ করার পর বিল তুলে তা বিদেশে পাচারেরও অভিযোগ আছে আবু জাফরের বিরুদ্ধে। একসময় তার পরিবারের সদস্যদের কানাডায় পাঠিয়ে দেন তিনি। ২০১৪ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ না করে নিজেও দেশ ছাড়েন। এতে ড্রেজিংয়ের কাজ বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি আটকে যায় ব্যাংকের টাকাও। আবু জাফরের কাছে বড় অংকের পাওনার বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী বণিক বার্তাকে বলেন, মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে কাজ পাওয়ায় প্যাসিফিক মেরিনকে আমরা অর্থায়ন করেছিলাম। পরবর্তীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং থেকে বাদ দেয়া হলে এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করে প্রতিষ্ঠানটি। মামলার রায় গ্রাহকের পক্ষে গেলে অর্থ পেতে ব্যাংকের কোনো সমস্যা হবে না। জানা গেছে, ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল ব্যাংক প্রটেকশন ও জেটি ফ্যাসিলিটিসহ কর্ণফুলী নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প বাস্তবায়নে ২২৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি করে মালয়েশিয়ান মেরিটাইম অ্যান্ড ড্রেজিং করপোরেশন। মালয়েশীয় প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয় প্যাসিফিক মেরিন সার্ভিসকে। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। নির্ধারিত সময়ে তা শেষ করতে না পারায় ২০১৩ সালের ১১ আগস্ট চুক্তি বাতিলের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নোটিস দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। ২০১৪ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের কাজ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নতুন করে আবেদন করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তীতে চিঠি চালাচালিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে প্রকল্পের কাজ। ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে। পরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আদালতে যায়। এতে থমকে যায় ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কাজে গাফিলতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পায় ক্যাপিটাল ড্রেজিং নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটিও। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি কর্ণফুলী নদীর নির্দিষ্ট এলাকার মাত্র ৪০ শতাংশ ড্রেজিং কাজ শেষ করে। অথচ ৬২ শতাংশ কাজ দেখিয়ে ১২০ কোটি টাকার স্থলে ১৬৫ কোটি টাকা তুলে নেয়। এদিকে দীর্ঘ জটিলতার পর ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ আবার শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ‘সদরঘাট থেকে বাকলিয়া চর পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি’ নামে ২৪২ কোটি টাকার প্রকল্পটি বর্তমানে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত কমিটিতে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

1 + one =