গাছ কেটে, পশুপাখি শিকার করে বনের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে

30
1000

বন রক্ষার জন্য ভারত সরকার একসময় প্রায় জিহাদ ঘোষণা করেছিল। কংগ্রেস তখন ক্ষমতায়, নেহরু ক্ষমতার চূড়ায়। উঁচুতে থাকলে সবকিছু ঠাওর করা কঠিন। তাই নিচে থাকা মানুষদের বুদ্ধিসুদ্ধি, চিন্তাচেতনার ওপর নির্ভর করতে হয়। সেটা না করে বনকর্তারা নেহরুকে বোঝালেন, কাজটা খুব সহজ। আমাদের হুকুম দিলেই হবে। নেহরু ভ্রু কুঁচকে জানতে চান, কী রকম? কী হুকুম নেই, যেটা তোমাদের দরকার? তাঁরা জানালেন, বন রক্ষার জন্য আমাদের বনরক্ষীরা জান কোরবান করে দিচ্ছে।

শুধু সমস্যা করছে বনে যেসব অশিক্ষিত বুনো, বাগদি, সাঁওতাল, আপাতানি, মেটটি, রাজবংশী, গুজজার, বোড়ো, মিনা ইত্যাদি লোকজন বসবাস, তারা। এরাই গাছ কেটে, পশুপাখি শিকার করে বনের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। আমরা এখন স্বাধীন দেশ, এরা কেন বনে-বাদাড়ে থাকবে? শহরে বসবাসের অধিকার, স্কুল, গরম পানি, রেল, উড়োজাহাজ এরা দেখবে না? দেশের সুখশান্তির ভাগীদার তাদেরও করতে হবে। বনে-বাদাড়ে আর তাদের রাখা ঠিক হবে না। এটা স্বাধীনতার ঘোষণার সঙ্গে মানায় না। বনের বাইরে শহরতলির কাছে তাদের বসবাসের সুযোগ করে দিলে বনও বাঁচবে, তারাও উন্নতি করবে। চা, পাউরুটি, পাউভাজি খাবে। হিন্দি-ইংরেজি শিখবে। নেহরু ভাবলেন আর পরিকল্পনা কমিশনের মি. মহলানবিশকে পরিকল্পনা তৈরির হুকুম দিলেন। বন বাঁচাও, আদিবাসী তাড়াও টাইপের সেই পরিকল্পনা ক্রমে তৈরি হতে থাকল। বন সৃজন করেছেন যিনি, সেই ভগবান দেখলেন, এ তো মহাবিপদ! বনও থাকবে না, আদিবাসীও থাকবে না। তিনি আঁটলেন অন্য ফন্দি। আল্লাহর মার দুনিয়ার বাইর। নেহরুকে বহনকারী হেলিকপ্টার হঠাৎ আকাশে বিগড়ে গেল। জরুরি অবতরণ করলেন এক জঙ্গলে। সেখানে নির্ভরেরা নেই, নেই ভাঁড়েরাও। আরেকটা উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার না আসা পর্যন্ত নেহরুর অখণ্ড সময়। তিনি দেখলেন, জঙ্গলটা ম্যাপেই আছে, আসলে সব ফরসা। নেহরু হাঁটা শুরু করলেন। দেখলেন, সেখানেই শুধু গাছপালা আর পাখপাখালি আছে, যেখানে আদিবাসীরা বসবাস করছেন। তারাই গাছ রক্ষা করছেন, বন রক্ষা করছেন। যেখানে আদিবাসী, নেই সেখানে বন বিভাগেরųকোঠা আছে কিন্তু বন নেই। সব কার যেন রাতে চুরি করে নিয়ে যায়। নেহরু মত বদলালেন। আদিবাসীদের বনচ্যুত করার ফন্দি-ফিকির মার্কা পরিকল্পনার শিকড় উপড়ালেন। বন বাঁচল, আদিবাসীরাও সমূহ সংকট থেকে রেহাই পেলেন। আমাদের সবেধন নীলমণি সুন্দরবন নিয়ে প্রায় একই ধরনের সর্বনাশা আয়োজন চলছে। প্রচার করা হচ্ছে, বাওয়ালি-মৌয়ালরা বন খেয়ে ফেলছে। তাদের পায়ে দড়ি দিলেই বন হু হু করে বাড়বে—এ রকম একটা ধারণা নীতিনির্ধারণী মহলকে বেশ ভালোভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন বনের মালিক বন বিভাগ। পরিণামে সুন্দরবনে বাওয়ালিদের প্রবেশ কঠোরভাবে সীমিত করার চেষ্টা চলছে। মানুষের যেমন বন প্রয়োজন, বনেরও তেমনি মানুষ প্রয়োজন। বিশেষ করে সুন্দরবনের মতো বনে মানুষ না ঢুকালে বনের স্বাভাবিক বিস্তার বিঘ্নিত হবেই। ২০০৮ সালে সিডরে আক্রান্ত সুন্দরবনকে প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। বনে বাওয়ালিরা যাবে না, তাহলেই বন নিজের মতো করে বেড়ে উঠবে—খুবই নান্দনিক ধারণা। কিন্তু কী পেলাম আমরা? এক বছরের মধ্যে খবর রটে গেল, সুন্দরবন লতাজাতীয় আগাছায় ছেয়ে যাচ্ছে। অজানা-অচেনা এক লতা বড় বড় গাছের মাথা নষ্ট করে দিচ্ছে, লাফিয়ে লাফিয়ে গ্রাস করে ফেলে গাছ। আগে কেন তা করত না? এখন কেন করল? এটাকি সিডরের তাছির, না অন্য কিছু? মৌয়ালরা মধু সংগ্রহে গেলে গাছে ওঠার সময় গাছকে পরিষ্কার করে। আগাছাগুলো কেটে দেয়, গাছ ভারমুক্ত হয়। মৌয়ালদের অনুপস্থিতিতে সে কাজ কে করবে? বন কর্মকর্তা বনবাবুরা? তারা কেন দা-কাটারি হাতে ধরবে? একই ঘটনা ঘটেছে গোলপাতার বেলায়। গোলপাতার বন বাড়তে পারেনি যেমন বাড়া উচিত ছিল। গোলপাতা তাল, নারকেল-জাতীয় গাছ। ইংরেজরা এর নাম দিয়েছে নিপা পাম। তাল-নারকেল বছর বছর ঝুড়তে হয়, মানে এ গাছগুলোর পরিণত ডালগুলো কেটে দিতে হয়, গাছের মাথা পরিষ্কার করে দিলে নতুন ডাল ডানা মেলে, ফুল মুকুলিত হয়ে ফল ধরে। কয়েক বছর নারকেলগাছ পরিষ্কার না করে দিলে ফল ধরা বন্ধ হয়ে যায়, গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। এসব গাছ পরিষ্কার করার আবার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। বর্ষার পর আশ্বিন মাসে নারকেলগাছ পরিষ্কার করতে হয়। কোনোমতেই কার্তিক পার করা ঠিক নয়। আবার তালগাছ পরিষ্কার করার সময় মাঘ-ফাল্গুন। মূলত, ফাল্গুন-চৈত্রের দাবদাহ শুরুর আগেই এভাবে তালপাতার পাখাও মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। গোলপাতা পরিষ্কারের সময়ও এটা মাঘ-ফাল্গুন-চৈত্রে—মানে মার্চের পর আর কাটা ঠিক নয়। এই পঞ্জিকা মেনেই এযাবৎ বন বিভাগ বাওয়ালিদের অনুমতি দিত। চাঁদপাই ও শরণখোলা—এই দুই রেঞ্জ নিয়ে পূর্ব সুন্দরবন আর খুলনা সাতক্ষীরা রেঞ্জ নিয়ে পশ্চিম সুন্দরবন। এবার বাওয়ালিদের পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জে সীমিত আকারে গোলপাতা আহরণের পাস দেওয়া হলেও শরণখোলা রেঞ্জে কোনো পাস দেওয়া হয়নি। ২০০ থেকে ৩০০ নৌকা চলাচলের অনুমতির রেওয়াজ থাকলেও এবার মাত্র ১৩৩টি বাছাই করা (রাজনৈতিক বিবেচনায় কি?) নৌকাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। চাঁদপাই রেঞ্জের এসিএফ (বন কর্মকর্তা) সংবাদমাধ্যমকে এ খবর নিশ্চিত করেছেন। তা ছাড়া নৌকার দৈর্ঘ্য নিয়েও বায়নাক্কা আছে। বন বিভাগের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে এ বছর এমনিতেই দেরি করে অনুমতি দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়। আবার ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে গোলপাতা কাটার সব আদেশ স্থগিত করে বন থেকে সব বাওয়ালিকে বের করে দেওয়া হয়। পরে নানা শর্ত দিয়ে আবার অনুমতি দিলে অনেকেই পক্ষে আবার নৌকা জোগাড় করে ফিরে আসা সম্ভব হয়নি। লোকসানের টাকাই শুধু তাদের গুনতে হয়েছে। বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ডিএফও সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নিতান্তই মানবিক বিবেচনায় বাওয়ালিদের সংসারের কথা ভেবে এসব সীমিত অনুমতির ব্যবস্থা। দয়ার সাগর বন কর্মকর্তা। তাহলে গোলপাতার ঝাড় পরিষ্কার করবে কে? বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে গোলপাতার ফুল হবে, বংশবিস্তারের প্রক্রিয়া শুরু হবে। বরগুনা-পটুয়াখালী অঞ্চলে গোলপাতার গুড়ের মৌসুম এবার কি শূন্য থাকবে। গোলপাতা এখনো দক্ষিণ অঞ্চলের প্রধান গৃহনির্মাণসামগ্রী। আসন্ন কালবৈশাখী আর বর্ষার মৌসুমের আগে তাদের ঘর ছাওয়ার কাজ শেষ করে ফেলতে হয়। গোলপাতার সরবরাহ কম থাকায় দাম এই ভরা মৌসুমেও আকাশছোঁয়া। বড় গৃহস্থরা পারলেও প্রান্তিক মানুষেরা এবার পারবে কি? সীমিত ভাগ্যবান মুখচেনা নৌকামালিকদের ভালো ব্যবসার সুযোগ করে দিয়ে আমরা না বনের ভালো করলাম, না প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়ালাম। এই প্রান্তিক মানুষেরাই এ দেশটা স্বাধীন করার জন্য মুক্তিপণ যুদ্ধ করেছিল। ছাউনির গোলপাতা এখন আকাশের চাঁদ—গাছেরাও খুশি নয়। বনজীবীদের যাতে ভালো হয়, বনেরও তাতেই মঙ্গল। এই সত্যটা না বুঝে কীভাবে চলবে বন প্রশাসন?

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

four × one =