প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামী শিক্ষায় গুরুত্ব বাড়াতে হবে

0
1313

মামুন ইবনে হাতেমী : গত ১৬ মার্চ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে জাতিসংঘ কর্তৃক উন্নয়নশীল দেশে (ডেভেলপিং কান্ট্রি) হিসাবে স্বীকৃতি পেল বাংলাদেশ। দীর্ঘদিন স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকার পর চলতি বছর উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার স্বীকৃতি লাভ বাংলাদেশের জন্য সত্যিই অনেক মর্যাদার। এর ফলে প্রমাণিত বাংলাদেশ সম্ভাবনাময় এক দেশ এবং নতুন অবয়বে সারা বিশ্বের সামনে অভ্যুদয় ঘটেছে বাংলাদেশের। এ স্বীকৃতি আমাদের জন্য যেমন গর্বের এবং এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে।

 

নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া তিনটি শর্ত পূরণ  করে এ সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। শর্ত তিনটি হলো- মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি সূচক (ইভিআই)। তিন শর্তই পূরণ করে উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ, যা বিরল ঘটনা। ইকোসকের মানবসম্পদ সূচকে উন্নয়নশীল দেশ হতে ৬৪ পয়েন্টের প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশের আছে ৭২।

উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক স্বীকৃতি সম্পর্কে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অর্জনে সুবিধার পাশাপাশি রয়েছে নানা চ্যালেঞ্জও। একটি আদর্শবান শিক্ষিত জাতিরই কাছেই সম্ভব এই ‍অর্জন ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা।

তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, বর্তমান পরিস্থিতিতে আজকের তরুণদের অনেকেই ক্রোধ আর হতাশার মাঝে নিজের খেই হারিয়ে ফেলছে। তারা যেন স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছে। দেশের ঘুরে দাঁড়ানোর সাথে নিজের উন্নয়নের এক অদ্ভুত দূরত্ব তৈরি করে তারা মনে করছে, দেশের উন্নয়নটা যেন অন্য কারো কর্তব্য তাদের এখানে কোন প্রকার সংশ্লিষ্টতা নেই।

বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষাখাতের দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র গোটা জাতির জন্যই এক অশনি সংকেত। শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যারা এই সকল দুর্নীতে জড়িত তারা গোটা জাতির জন্য একটি অশনিসংকেত। নৈতিকতাহীন শিক্ষা কুশিক্ষার নামান্তর। উদ্বেগের বিষয় হল, দেশের শিক্ষা খাত ঘুষ-দুর্নীতি তথা অনৈতিকতায় আকীর্ণ। এটি বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণায়, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সুপারিশে এবং শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় শিক্ষা প্রশাসনে অনিয়ম-দুর্নীতি ও হয়রানির ভয়াবহ সব তথ্য উঠে এসেছে। বস্তুত শিক্ষা খাতে ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই একরকম ‘ওপেন সিক্রেট’।

মানুষ ‘‘আশরাফুল মাখলুকাত’’, সৃষ্টির সেরা জীব। আর এই সেরা বা শ্রেষ্ঠত্ব জন্মগত নয় বরং তা অর্জন করতে হয় যা শিক্ষার মাধ্যমেই সাধিত হয়। শিক্ষা এমন এক প্রণালী যা মানুষের অন্তর্নিহিত ও নিজস্ব জ্ঞান প্রতিভাকে জাগ্রত করার মাধ্যমে মনুষ্যত্ববোধ উজ্জীবিত করে নৈতিকতার চোখে বিশ্বকে দেখায়। ফলস্বরূপ সে সহজে ভাল মন্দ উপলব্ধি করতে পারে যা তাকে গুনাহের পথ থেকে বাঁচিয়ে ন্যায়ের পথে পরিচালিত করে।

বাংলাদেশের বেশীরভাগ মানুষই যেহেতু মুসলিম এবং ইসলামে রয়েছে নৈতিকতা শিক্ষার পূর্ণ মাপকাঠি তাই বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামী নৈতিক শিক্ষা বেশী করে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে জাতিকে নিজস্ব মননে ও সঠিক পথে পরিচালিত করা এখন সময়ের দাবি।

ইসলামী যুগে জিহাদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ কখনো ছিল না এখনো নাই। ইসলামের পঞ্চম রুকন হচ্ছে জিহাদ। অথচ এই জিহাদ থেকে ছাত্রদেরকে পৃথক করে বলা হচ্ছে, তোমরা জিহাদে যেও না। বরং তোমরা জ্ঞান অর্জন কর। কুরআনে কারীমের ফায়সালা এটাই সাব্যস্ত করে যে, ছাত্রদেরকে জিহাদ থেকে পৃথক রাখা হবে।

দ্বীনী ইলমের উদ্দেশ্য কখনো শুধু পড়া নয়, বরং দ্বীনী প্রজ্ঞা অর্জন করা। কুরআনের দাবী হল, সর্বদা এমন জামাত থাকতে হবে যারা দ্বীনী প্রজ্ঞা অর্জনের জন্য নিজেদের জীবনকে ওয়াকফ করে দেবে। এই জামাতকে মুজাহিদ ও গাযীদের জামাত থেকে পৃথক করে উলেস্নখ করা হয়েছে। জিহাদের সওয়াবের কোনো সীমা পরিসীমা নেই। কিন্তু তালিবুল ইলমদের তা থেকে আলাদা রাখা হয়েছে। কিছু লোক শুধু এই কাজের জন্য ফারেগ হয়ে যাবে। তারা আর কোনো কাজ করবে না।

ছাত্রজীবনের মেহনতের মাধ্যমে যে যোগ্যতা অর্জন হবে তাই হবে সারাজীবনের পুঁজি। ইলমের অর্জনকারীদের জন্য ছাত্রজীবনই হচ্ছে ভালো কিংবা মন্দ হওয়ার প্রকৃত সময়।আমাদের অনেক ছাত্র উদাসীনতায় ডুবে আছে। তারা মনে করে, এখনও তো ছাত্র। ছাত্রজীবন স্বাধীন জীবন। কর্মজীবনে যখন প্রবেশ করব তখন সব করব। কিন্তু বাস্তব কথা হল, যে এখানে ঠিক হবে না, সে কোথাও ঠিক হবে না।

ছাত্রজীবন যে কত মূল্যবান, তাদের এই সময়টা যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা তারা নিজেরাই অনেক সময় বুঝতে পারে না। আর এই না বুঝার কারণেই তারা অত্যন্ত অবহেলায় তাদের এই মূল্যবান সময়কে নষ্ট করে। এজন্য অবশ্য শুধু ছাত্রদেরকে একতরফা দোষ দিয়ে লাভ নেই, কারণ আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা তাদের সামনে জীবনের কোন মহৎ আদর্শ ও লক্ষ্য তুলে ধরতে পারেনি। তাদের সামনে নেই জীবনের কোন সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য। বর্তমান সময়ে ভাল কোন চাকরি লাভ বা পয়সা উপার্জনই পড়াশোনা ও জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ভোগবাদই যেন শিক্ষার এবং জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। যার কারণে আজ ছাত্ররা নিজের জীবনে কোন মহৎ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও আদর্শের তাড়না অনুভব করে না। বরং এই তরুণ বয়সে জীবনকে উপভোগ করার বর্ণিল আহবান ও চাকচিক্যই তাদেরকে বেশি প্ররোচিত করে। এভাবে তার পড়াশোনাই শুধু নষ্ট হয় না বরং নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন যথার্থ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতেও সে ব্যার্থ হয়। এভাবেই জাতির ভবিষ্যত গড্ডালিকা প্রবাহে হারিয়ে যায়।

উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে এই পরিচিতি ও খুশির সাথে যোগ আছে কিছুটা দু:চিন্তারও । কারণ যখন চুড়ান্তভাবে বাংলাদেশের নাম উঠবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় তখন আর থাকবেনা স্বল্পোন্নত দেশ হিসাবে পাওয়া আগের সব সুযোগ সুবিধা। উঠে যাবে শুল্কমুক্ত রপ্তানি। বাড়বে বিদেশি ঋণের সুদ। থাকবেনা বিদেশী ফেলোশিপ, স্কলারশিপ. প্রশিক্ষণসহ নানা সুবিধা।

জাতির ভবিষ্যত নাগরিকদেরকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে তাদের সামনে জীবনের সঠিক পথ, সঠিক জীবনদৃষ্টি এবং তাদের জীবনের সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ করতে সাহায্য করাই শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত।

ঐশী কালাম আল কোরআনই সেই মহৎ আদর্শের নাম যা মানুষকে সত্যিকার মানুষ বা ইনসানে কামেল হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। সেই ঐশী জীবনাদর্শের আলোকেই ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে জীবনের একটি মহৎ মানুষের স্বপ্ন এঁকে দিতে হবে। এই স্বপ্নের পথে হেঁটেই তারা জীবনের সঠিক তাৎপর্য খুঁজে পাবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

five + seventeen =