খাল আর জলাশয়গুলো যেন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়

33
875

নিয়মিত পরিষ্কার না করায় রাজধানীর খাল, ঝিল, জলাশয়, লেক ও নিচুজমি এখন কচুরিপানা ও আবর্জনায় পরিপূর্ণ। খাল আর জলাশয়গুলো যেন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। বিভিন্ন এলাকায় সুকৌশলে দিন দিন ময়লা আবর্জনা ফেলে আসাধু চক্র সরকারি অনেক জলাশয় দখল করে নিচ্ছে। দুই সিটি কর্পোরেশনের হিসাবমতে প্রতিবছরই রাজধানীর জলাশয়ের আয়াতন কমছে। নগরীর খাল, ঝিল, জলাশয় ও লেক কচুরিপানা ও নোংরা আবর্জনায় জন্মাচ্ছে মশা। কচুরিপানা ও আবর্জনায় পরিপূর্ণ এসব জলাশয়কে বিশেষজ্ঞরা মশার আদর্শ প্রজননস্থল বলে মনে করছেন। প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস সময়ে রাজধানীর বদ্ধ জলাশয়ের কচুরিপানা পরিষ্কার করে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন।

পাশাপাশি চালানো হয় বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান ও সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচি। এবছর কচুরিপানা পরিষ্কার করা হয়নি। দুই সিটি কর্পোরেশনের এ খাতে পর্যাপ্ত বাজেট থাকার পরও নেওয়া হয়নি বিশেষ কোনো পরিচ্ছন্নতা অভিযানও। ফলে শীত শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাজধানীতে মশার উপদ্রব প্রচন্ড রকম বেড়ে গেছে। মশার জ্বালায় নগরবাসী এখন অতিষ্ঠ। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জানা গেছে, রাউজক, গণপূর্ত অধিদপ্তর, সিভিল এভিয়েশন, রেলওয়েসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান এসব জলাশয়ের মালিক। এছাড়া ব্যক্তি মালিকানয়ও রয়েছে কিছু জলাশয়। তাদের ভাষ্য, এসব জলাশয় পরিষ্কারের জন্য কর্পোরেশনের আলাদা বাজেট নেই, তাছাড়া এগুলো পরিষ্কারের দায়িত্বও তাদের নয়। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের চলতি ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের বাজেট বই থেকে জানা যায়, ডোবা, নালা ও জলাশয়গুলোর কচুরিপানা, ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার ও রক্ষণা বেক্ষণের জন্য দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বাজেট রয়েছে ৩০ লাখা টাকা। অন্যদিকে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বাজেট রয়েছে এক কোটি টাকা। প্রতিবছরই এ খাতে বজেট বরাদ্দ রাখা হয়। এবং বছর বছর এ বাজেট বাড়তে থাকে। বছর যায় বাজেট শেষ হয়। ডোবা, নালা ও জলাশয়ের নোংরা অবর্জনা ও কচুরিপানা পরিষ্কার হয় না। এ থেকে জন্মনেয়া মশায় নাজেহাল হচ্ছে নগরবাসী। মেলেরিয়া, ডেঙ্গু এবং চিকনগুনিয়াসহ মারাত্মক সব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. শেখ সালাহউদ্দীন গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এরিয়ায় ৪৮৩ বিঘা জলাশয় রয়েছে। এগুলো পরিষ্ককার করার জন্য আমি বহু আগেই ১, ২ ও ৫ নং আঞ্চিল কর্মকর্তাদের (আনিক) লিখিতভাবে নোটিশ করেছি। কিন্তু তারা এ ব্যপারে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। পরে বিষয়টি আমি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিল্লালকে জানিয়েছি। বর্তমানে ডিএসসিসি’র প্রনিক এ বিষয়টি দেখছেন। তিনি বলেন, ডোবা, নালা ও জলাশয় থেকে ময়লা আবর্জনা ও কচুরিপানা পরিষ্কারের কাজ করতে আমাদের নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এছাড়াও এ কাজে রয়েছে নানা জটিলতা। যে কারণে আনিকরা এই জলাশয়গুলো পরিষ্কার করতে চায় না। রাজধানীর কল্যাণপুর, মিরপুর, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, ভাটারা, বাড্ডা, বনশ্রী, গোড়ান, খিলগাঁও, বাসাবো, মুগদাপাড়া, শনির আখড়া, দোলাইরপাড়, মোহাম্মদপুর, আদাবর এলাকার জলাশয়গুলোকে ‘মশার খামার’ বলে স্থানীয়রা উল্লেখ করেছেন। মশার প্রজনন চলছে উত্তরা, গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি লেক এবং হাতিরঝিলেও। ঢাকার ২৬টি খালেরও বেশির ভাগ জায়গায় পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এসব স্থানেও মশার বংশ বিস্তার হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় উন্নয়নকাজের জন্য খোলা, ভাঙাচোরা নর্দমাগুলোতে হরদম মশার বংশবৃদ্ধি চলছে। রাজধানীর মিরপুর পাইকপারা (বউবাজার) এলাকার খালের পাশেই নিজের বাড়িতে বসবাস করেন সাইদুর রহমানের। তিনি বলেন, এ খালে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে আছে অনেক দিন আগে থেকেই। এখন এখানে জমে থাকা ময়লা আবর্জনাযুক্ত পানিতেই মশা বংশ বিস্তার করছে। কিন্তু এ জায়গা পরিষ্কার ও মশা মারার ওষুধ ছিটানো হয়নি কখনোই। ফলে এলাকার ওয়ার্ডগুলোতে মশা নিধন কর্মীরা ওষুধ ছিটিয়ে গেলেও মশার উৎপাত কমছে না। রাজধানীর প্রাণ কেন্দ্র মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনের ঝিলে কখনও মশার ওষুধ ছিটানো হয়েছে বলে কেউ বলতে পারেনি। এটি পরিষ্কারও করা হয় না বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। এই ঝিল ‘মশার খামার’ বলে মন্তব্য করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজী মোহাম্মদ সুলতান মিয়া। ঝিল পরিষ্কার করলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে জানান তিনি। মাঝে মাঝে কর্পোরেশনের অস্থায়ী কর্মীরা কিছু কিছু কচুরিপানা পরিষ্কার করেন। আর আমাদের মশক নিধন কর্মীরা সকাল বেলায় লার্ভিসাইডিং করে। কিন্তু এটা সাফিসিয়েন্ট না। গতকাল শুক্রবার কমলাপুর স্টেশন থেকে মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, সড়কের দুই পাশে ফুটপাত নর্দমার উন্নয়ন কাজ চলছে। নির্মাণাধীন নর্দমায় পানি জমে আছে। আর তাতে জন্মেছে মশা। এই সড়কের ফুটপাতের দোকানদার শামছুল ইসলাম জানান, এসব মশা সারাদিনই কামড়ায়। দ্যাখেন, কী মশা হইছে ড্রেইনে। মশার কামড়ের চোটে এইখানে বইসা থাকন যায় না। এইখানে কেউ মশার ওষুধও ছিডায় না। রাজধানীর মধ্য বাড্ডার চেয়াম্যান বাড়ি এলাকার খালে দেখা গেছে, খাল এবং খালের দুই পাশের নিচু জমিতে পানি জমে আছে। ডোবাগুলো ময়লা, আবর্জনা ও কচুরিপানায় ভর্তি। কচুরিপানার ফাঁকে পানিতে ভাসছে মশা, লার্ভা। ডোবানালা পরিষ্কার না করায় মশার উপদ্রব বেড়েছে জানিয়ে ঐ এলাকার বাসিন্দা আবদুস রহমান বলেন, এগুলো কোনোদিন পরিষ্কার করা হয় না। মশার ওষুধও ছিটানো হয় না। খিলক্ষেত, কুড়িল, জোয়ারসাহারা এলাকার ডোবাগুলোও অপরিষ্কার। বদ্ধ পানিতে জন্মাচ্ছে মশা। এলাকায় মশার ওষুধ ছিটানো হয় প্রায়ই, তবে মশার উৎপত্তিস্থলে হাত দেওয়া হয় না বলে জানান খিলক্ষেতের হাজীপাড়ার বাসিন্দা কুদরত আলী। তিনি বলেন, মাঝে মাঝে দেখি ধোঁয়া দিয়া যায়। এ এলাকায় অনেক ডোবানালা রয়েছে। কিন্তু এই ডোবা নালার ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করতে কোনো সময় দেখি নাই। এছাড়া ১০০ ফুট খাল খননের জন্য পানি প্রবাহ বন্ধ থাকায় এবার মশার উপদ্রব কিছুটা বেশি বলে জানান ডিএনসিসির ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিন্নাত আলী। তিনি বলেন, ১০০ ফুট খালের খননের জন্য খালে বাঁধ দিয়ে মাটি তুলছে, তাই পানি প্রবাহ থমকে আছে। জমে থাকা পানিতে ডিম দিচ্ছে মশা। এ কারণে খালটি মশার একটা বড় প্রজননকেন্দ্র হয়ে গেছে। লোকবলের ঘাটতি থাকলেও এসব প্রজননকেন্দ্র ধ্বংসের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান এই কাউন্সিলর। কল্যাণপুর, পাইকপাড়া, বিশিল, মাজার রোড, গাবতলী এলাকার নিচু জমি এবং ঝিলের পানিতে জন্ম নেওয়া মশার কারণে দুর্ভোগে আছেন ওই এলাকার মানুষ। কেউ অভিযোগ না করলেও মশার উৎপাত আগের চেয়ে বেড়েছে বলে জানান ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, আমি নিজেও অনুভব করি, একমাস আগের চেয়ে এখন এলাকায় অনেক বেশি মশা। অফিসে বাসায় সব জায়গায় মশা। এজন্য আমরা বিশেষ অভিযান করছি। ঢাকার পরিবেশ মশার প্রজননের জন্য খুবই উপযোগী বলে জানান রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নুজহাত নাসরিন। তিনি বলেন, আমাদের চারপাশে যে সব ডোবানালা রয়েছে, সেগুলো ঠিকমতো পরিষ্কার করা হয় না। আবার সরকারি মালিকানার যেগুলো আছে সেগুলোও হয়তো প্রোপারলি পরিষ্কার করা হয় না। ওপেন ড্রেনগুলোতেও পানি জমে আছে। বদ্ধ পানিতে কিউলেক্স মশা বংশ বিস্তার করতে পারে সহজেই। পানি যদি ড্রেন হয়ে নদীতে চলে যেত তাহলে হয়ত এতো মশা হত না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শেখ সালাহউদ্দীন ইতোমধ্যে কিছু ডোবা পরিষ্কারের কাজ শুরু করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, খাল এবং অন্যান্য জলাশয় ওয়াসাসহ অন্য কয়েকটি সংস্থার। সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণও তারাই দেখে। যে কারণে আমাদের কোনো বাজেট থাকে না। তারপরও আমরা চেষ্টা করি ডোবানালা পরিষ্কার করে দিতে যেন মশা ডিম পাড়তে না পারে। জনগণের দুর্ভোগ যেন কিছুটা কম হয়। একই কথা বলেছেন, উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর আবদুর রাজ্জাকও। তিনি বলেন, গুলশান, বনানী এবং উত্তরার কয়েকটি লেকের মালিক রাজউক। গৃহায়ন ও গণপুর্ত অধিদপ্তর, রেলওয়েরও জলাশয় আছে। খালগুলোর মালিক ঢাকা ওয়াসা। বিমানবন্দর এলাকায় লেকগুলোর মালিক সিভিল এভিয়েশন। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচ্ছন্ন করার দায়িত্ব তো তাদের। প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানই ইনডিপেনডেন্ট। তারা যদি এগুলো পরিষ্কার না করে তাহলে সিটি কর্পোরেশনের সেখানে কী করার থাকে? সিটি কর্পোরেশন তাদের কাজে সাহায্য অবশ্যই করবে। কিন্তু জায়গাটা যার নিয়ন্ত্রণে, উদ্যোগটা তাদেরই নিতে হবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

one + thirteen =