ব্যাংক অলস টাকা পাচ্ছে

0
3969

দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় চলছে নগদ টাকা বা তারল্যের তীব্র সংকট। তারল্য বাড়াতে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ছুটছে গ্রাহকের দ্বারে দ্বারে। তার পরও ঋণ বিতরণের মতো পর্যাপ্ত আমানত না পেয়ে অনেক ব্যাংকেরই বিনিয়োগ ঝুলে গেছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে। আমানত সঙ্কটে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো হা-হুতাশ করলেও সরকারি ব্যাংকগুলোতে অলস পড়ে আছে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখার বিধান থাকলেও অর্থ মন্ত্রণালয়কে তা ৫০ শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব করছে তাঁরা। অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এ দাবি প্রেক্ষিতে আমানত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ক একসভায় আজ (রোববারই) বিষয়টি চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার (বিএবি) এক বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী জানান, এখন থেকে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ অর্থ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে রাখা হবে। এ বিষয়ে রোববার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।

এদিকে বিনিয়োগের পরিবেশ ফেরাতে এবং বেসরকারি ব্যাংকের তারল্য সঙ্কট নিরসনে বিধানটি সংশোধন জরুরী হলেও একাধিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী পরিচালকদের ব্যাংকে সরকারি আমানতের বড় অংশ চলে যেতে পারে। যা পুরো ব্যাংকিং খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাই প্রভাব খাটিয়ে যেন অধিক আমানত না নিতে পারে সেদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টদের খেয়াল রাখতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা অব্যবস্থাপনা এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এডি রেশিও কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়েই কিছুটা তারল্য সংকটে পড়ছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। তাই সবাই আমানত সংগ্রহে মনোযোগ দিচ্ছে। পাশাপাশি অলস পড়ে থাকা সরকারি আমানত পেলে ঝুলে থাকা বিনিয়োগে মনোনিবেশ করতে পারবে ব্যাংকগুলো।

বেসরকারি এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান তমাল এস এম পারভেজ ইনকিলাবকে বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখার বিধান সেই ১৯৯১ সালের। অথচ প্রায় ৩০ বছর অতিবাহিত হতে চললেও এখনও ব্যাংক কোম্পানি আইনের এই বিধান পরিবর্তন করা হয়নি। বিনিয়োগের স্বার্থে তথা দেশের স্বার্থেই এখন সময় এসেছে এই বিধান পরিবর্তনের। তিনি বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোতে আমানত অলস পড়ে আছে। বিনিয়োগ হচ্ছে না। অথচ বেসরকারি ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের অর্থ পাচ্ছে না। অনেক বিনিয়োগ আটকে যাচ্ছে। তাই এই অলস টাকা বিনিয়োগের জন্য বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

তমাল এস এম পারভেজ বলেন, অব্যবস্থাপনার কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলো তারল্য সঙ্কটে ভুগছে। বড় বড় প্রকল্পে বিনিয়োগ করায় বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তিনি জানান, দেশের অর্থনীতির ৭০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে। অথচ সরকারি আমানতের মাত্র ২৫ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকগুলোতো রাখা হচ্ছে। এই হারকে ৫০ শতাংশ করা দরকার। অথচ উল্টো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ তুলে নিচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকারি আমানতের অন্তত অর্ধেক অর্থ পাওয়া গেলে বিনিয়োগ আরও গতিশীল হবে বলে উল্লেখ করেন নতুন প্রজন্মের প্রতিশ্রæতিশীল এনআরবিসি ব্যাংকের এই চেয়ারম্যান। সূত্র মতে, দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট এখন চরমে। ঋণ বিতরণের মতো পর্যাপ্ত আমানত না পেয়ে অনেক ব্যাংকেরই বিনিয়োগ ঝুলে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে শেয়ারবাজারে, ব্যক্তি খাতের ঋণ প্রবাহে পড়েছে ভাটা। প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যেও। এ অবস্থায় আমানত সংগ্রহে হন্য হয়ে বেড়াচ্ছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। আমানতের সুদের হার বাড়িয়েও কাজ হচ্ছে না। উপায়ান্তু না পেয়ে সরকারি আমানত চায় বেসরকারি ব্যাংকগুলো। যা বর্তমানে ২৫ শতাংশের বেশি রাখার নিয়ম নেই। এ প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি রাজধানীর গুলশানে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবি’র সাথে বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বেঠকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ও ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এ ব্যাপারে মৌখিক দাবিও জানায় বিএবি ও শীর্ষ ব্যবস্থাপকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। বিষয়টি নিয়ে গভর্নরসহ সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে আলোচনার পর বিনিয়োগ বাড়াতে এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোর তারল্য সঙ্কট নিরসনে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ প্রদানে একমত হয় অর্থমন্ত্রীসহ নীতিনির্ধারকরা। আর তাই তারল্য সঙ্কটের কারণে ব্যাংকগুলোর দাবি প্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে শেষ পর্যন্ত সরকারি আমানতের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেসরকারি ব্যাংকে রাখা হতে পারে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতে দেশে বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। ব্যাংকে তারল্য কম থাকায় আমানতের সুদ হার বেড়েছে। ফলে ঋণের সুদের হারও বেড়েছে। এ অবস্থায় সরকারি আমানতের ৪০ ভাগ বেসরকারি ও ৬০ ভাগ সরকারি ব্যাংকে রাখার চিন্তা করা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলেই সার্কুলার জারি করা হবে। এতে ঋণ হার বৃদ্ধিসহ চাঙা হবে শেয়ারবাজার।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বৈঠক সম্পর্কে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকের (বিএবি) সভাপতি ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার জানান, বৈঠকে ব্যাংক খাতের এ সঙ্কটকালীন মুহূর্ত কীভাবে দূর করা যায় সেই ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ কোটি টাকা সরকারি আমানত। বাকি ৮ লাখ কোটি টাকাই বেসরকারি আমানত।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী, সরকারি আমানতের ৭৫ শতাংশ তথা দেড় লাখ কোটি টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় জমা থাকার কথা। বাকি ৫০ হাজার কোটি টাকা জমা থাকার কথা দেশের ৪০টি বেসরকারি ব্যাংকে। তবে ঠিক কী পরিমাণ সরকারি আমানত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় জমা আছে, সে সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যান নেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে।

এদিকে তারল্য সঙ্কটের কারণ হিসেবে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া এডি রেশিও (ঋণ ও আমানতের অনুপাত) বাস্তবায়ন, কয়েক মাস ধরে আমানতের সুদ হার কমে যাওয়ায় গ্রাহকদের অর্থ তুলে নেয়াসহ নানা অব্যবস্থাপনার কারণে তারল্য সংকটে পড়েছে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। অথচ কয়েক মাস আগেও এই পরিস্থিতিটা ছিল ঠিক উল্টো। তখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মনোযোগ ছিল ঋণ প্রদানে প্রতিযোগিতা করা। আমানত সংগ্রহে আগ্রহ ছিল কম। ফলে স্প্রেডসীমা (ঋণ ও আমানতের সুদ হারের ব্যবধান) ৫ শতাংশ থাকার নিয়ম থাকলেও অনেক ব্যাংকেরই এই হার ছিল ৫ শতাংশের নিচে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অর্থবছরের শুরু থেকেই ঋণ প্রবাহ অনেক বেশি মাত্রায় বাড়তে শুরু করেছে। গড়ে প্রতিমাসে ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কিন্তু আমানত বেড়েছে মাত্র ৯ থেকে ১১ শতাংশ। আমানতের তুলনায় ঋণ প্রবাহ বেড়েছে ৯ শতাংশ বেশি। এসব কারণে তারল্যে টান পড়ছে। স¤প্রতি এডি রেশিও কমিয়ে সাধারণ ব্যাংকের জন্য সর্বোচ্চ ৮৩ দশমিক ৫০ ও ইসলামী ধারার ৮৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যা জুনের মধ্যেই বাস্তবায়ন করতে হবে।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, ঋণের তুলনায় আমানত কিছুটা কমেছে। ব্যাংকগুলোতে কিছুটা সমস্যা বিরাজ করছে। তাই সরকারি আমানত থেকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ আমানত সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আলোচনা চলছে। অর্থমন্ত্রীসহ সকলেই এক্ষেত্রে পজিটিভ। আশাকরছি বেসরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য একটি পজিটিভ সিদ্ধান্তই আসবে।’

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

2 × 3 =