মাকে গলা কেটে ও ছেলে রবিউল ইসলাম রূপমকে শ্বাসরোধে হত্যা

0
1205

সিলেট মিরাবাজারের মিতালি আবাসিক এলাকায় তিন তলা ভবনের নিচ তলার ফ্ল্যাটে মা ও ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। মা রোকেয়া বেগমকে গলা কেটে ও ছেলে রবিউল ইসলাম রূপমকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। ঘটনার সময় ওই বাসাতেই ছিল পাঁচ বছরের মেয়ে রাইসা বেগম। গতকাল দুপুরে আত্মীয়স্বজন এবং পুলিশ দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে রাইসাকে জীবিত উদ্ধার করে। এ সময় তারা দুটি কক্ষে মা ও ছেলের লাশ দেখতে পায়।

সিলেটের আলোচিত এ জোড়া খুনের ঘটনায় কারা জড়িত পুলিশ উদঘাটন করতে পারেনি। তবে, পুলিশ খুনিদের গ্রেপ্তারে তদন্ত চালাচ্ছে। রোকেয়া বেগমের বয়স ৪২ বছর, ছেলে রবিউল ইসলাম রূপমের বয়স ১৬ বছর। রোকেয়া বেগম নগরীর মিরাবাজার এলাকায় একটি বিউটি পার্লার চালু করার প্রক্রিয়ায় ছিলেন। আর রূপম চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থী। রোকেয়া বেগমের স্বামী হেলাল আহমদের বাড়ি জগন্নাথপুর উপজেলার কলকলি এলাকায়। প্রায় দুই বছর ধরে রোকেয়া বেগমের সঙ্গে বসবাস করছেন না হেলাল আহমদ। তিনি তার দ্বিতীয় স্ত্রী তান্নার সঙ্গে নগরীর বারুদখানা এলাকায় বসবাস করছিলেন। প্যারালাইজড রোগে আক্রান্ত হওয়ায় বর্তমানে প্রায় শয্যাশায়ী। রোকেয়া বেগমের স্বামী হেলাল আহমদ বছরখানেক তাদের মিরাবাজারের খাঁপাড়া এলাকার মিতালী আবাসিক এলাকায় ১৫ নম্বর বাসা ভাড়া নিয়ে স্ত্রী, সন্তানদের তুলে দেন। এরপর থেকে রোকেয়া বেগম ছেলে রূপম ও মেয়ে রাইসাকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাটে বসবাস করছিলেন। তাদের বাসায় একটি কাজের মেয়ে ছিল। মাসখানেক আগে ওই কাজের মেয়েকে মারধরের ঘটনায় বিরোধ দেখা দেয়। এ নিয়ে এলাকার মানুষ বিষয়টি মীমাংসা করে দেন। রোকেয়া বেগমের ভাই জাকির হোসেন মানবজমিনকে জানিয়েছেন, তাদের মূল বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দিতে। তারা দীর্ঘদিন ধরে সিলেটেই বসবাস করছেন। ১৭ বছর আগে হেলাল আহমদের সঙ্গে তার বোনের বিয়ে হয়। ভালোবেসে তারা একে অপরকে বিয়ে করেন। এরপর থেকে তারা সিলেট নগরীতেই বসবাস করছিলেন। বছরখানেক আগে স্ট্রোক করার পর শারীরিক অক্ষমতার কারণে আর ওই বাসাতে আসতে পারেননি। শুক্রবার থেকে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা রোকেয়া বেগমের মোবাইল ফোনে কল দিচ্ছিলেন। কিন্তু মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। শনিবার ব্যস্ততার কারণে তিনি বোনের খোঁজ নিতে পারেননি। গতকাল বেলা ১১টার দিকে তিনি আসেন বোনের বাসায়। এসে দেখেন দরজা ভেতর থেকে লক করা। ডাকাডাকি করেও তাদের কোনো সাড়া মেলেনি। এরপর তিনি বাসার মালিককে বিষয়টি জানান। বাসার মালিক এসে ডাকাডাকি করেন। কিন্তু তাদের কোনো সাড়া মিলেনি। পেছনের দিকে গিয়ে বেডরুমের দরজার ফাঁক দিয়ে ডাক দিলে সাড়া দেয় তার পাঁচ বছরের ভাগ্নি রাইসা। এ সময় বাসার ভেতর থেকে পচা দুর্গন্ধ আসছিল। তার উপস্থিতি টের পেয়ে রাইসা ভেতর থেকে কান্না শুরু করে। জাকির জানান- ঘটনার পর তিনি ও বাসার মালিক দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখেন তার বোনের ক্ষতবিক্ষত লাশ খাটের উপরে পড়ে আছে। অপর কক্ষে গিয়ে দেখেন ভাগিনা রূপমের লাশও পড়ে আছে। এ সময় তিনি দৌড়ে গিয়ে রাইসাকে ধরেন। জাকির জানান, প্রায় মাসখানেক আগে তার বোন বলেছিল ওই এলাকায় থাকা যাবে না। ওখানের লোকজন ঝামেলা করে। বাসা পাল্টানোর তাগিদ দেন তিনি। এদিকে, ঘটনার খবর পেয়ে সেখানে যায় কোতোয়ালি থানা পুলিশ। ছুটে আসেন এলাকার মানুষ। সিলেট সিটি করপোরেশনের স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর দিনার খান হাসু মানবজমিনকে জানান, কয়েক দিন আগে কাজের মেয়ের সঙ্গে ঝামেলা হয়েছিল। সেটি এলাকার মানুষ বসে মিটমাট করে দিয়েছেন। তিনি ধারণা করেন, পাঁচ বছরের শিশু রাইসার গলায়ও আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। রাইসাকেও খুনিরা গলাটিপে ধরেছিল। পরে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ায় হয়তো তাকে মৃত ভেবে খুনিরা চলে গেছে। বেলা দুইটার দিকে ঘটনাস্থলে যান সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার পরিতোষ ঘোষ। তিনি এ সময় সাংবাদিকদের বলেন, ব্যবসায়ীক কিংবা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে এ ঘটনা ঘটতে পারে। পুলিশ বিষয়টির তদন্ত করছে। তিনি বলেন, মা রোকেয়া বেগমের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। রূপমকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হতে পারে বলে ধারণা করেন তিনি। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার জানান, লাশ দেখে মনে হচ্ছে শুক্রবার বিকালে কিংবা সন্ধ্যার দিকে এ ঘটনা ঘটতে পারে। কিছুটা দুর্গন্ধও ছড়িয়েছে। তবে, তদন্তের পর সব জানা যাবে বলে জানান তিনি। দুপুরে পুলিশ রাইসাকে তার এক আত্মীয়সহ হাসপাতালে ভর্তি করেছে। রাইসা খুনের ঘটনা সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে, একজন পুরুষ ও একজন মহিলা তার মা ও ভাইকে মেরেছে। তাকেও মেরেছে। এর বেশি সে কিছু জানাতে পারেনি। এদিকে, সিআইডির ক্রাইমসিন সদস্যরা গিয়ে আলামত সংগ্রহ করেছেন। রোকেয়ার ঘরের ভেতরে রক্ত পাওয়া গেছে। এ সময় রোকেয়ার শরীরের কাপড়ও অনেকখানি সরানো ছিল। ধস্তাধস্তি করেই তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করে পুলিশ। বিকালে পুলিশ মা ও ছেলের লাশ উদ্ধার করে হাসপাতালের মর্গে পাঠিয়েছে। এদিকে, রোকেয়ার স্বামী হেলাল আহমদ এগারো বছর আগে পারিবারিকভাবে বালাগঞ্জের মোহাম্মদপুর গ্রামের সুলতানা জাহান তান্নাকে বিয়ে করেন। ওই স্ত্রী ও ১০ বছরের সন্তানকে নিয়ে তারা বসবাস করতো নগরীর বারুদখানার উত্তরণ আবাসিক এলাকায়। গতকাল বিকালে কথা হয় তার দ্বিতীয় স্ত্রী সুলতানা জাহান তান্নার সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে জানান, প্রথম বিয়ে সম্পর্কে হেলালের পরিবারের কেউ অবগত ছিলেন না। তিনিও জানতেন না। তার ভাইরা লন্ডনে থাকেন। গতকালই তিনি প্রথম জেনেছেন হেলালের আরো একটি সংসার রয়েছে। তিনি বলেন, তার স্বামী হেলালকে ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানানো হয়নি। তিনি স্ট্রোক করে নিজ বাসাতেই শয্যাশায়ী রয়েছেন। এই খবর শুনলে হয়তো তিনি আবার স্ট্রোক করতে পারেন। এ কারণে তাকে বিষয়টি জানানো হয়নি।

মা ও ভাইয়ের লাশের পাশে দুইদিন রাইসা

মা ও ভাইয়ের লাশ পড়ে আছে বিছানায়। একা ঘরের ভেতরে রাইসা। বয়স আর কত হবে তার। সাড়ে ৪ কিংবা ৫। কী বুঝে ফুটফুটে এই মেয়েটি! হয়তো মায়ের মৃতদেহের পাশে বসে মা-মা বলে ডেকেছিল। সাড়া মিলেনি। দুই লাশের পাশে অবুঝ এই শিশুটি টানা দুইদিন কাটালো ঘরের ভেতরে। গতকাল দুপুরে যখন মামা জাকির হোসেন ডাকছিল তখন রাইসা ভেতরে অঝোরে কাঁদছিলো। মামার গলা শুনে আরো জোরে জোরে কাঁদছিলো। মামা জাকির তখন রাইসার কান্না শুনে পাগলপ্রায়। কীভাবে যে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকেছেন জানেন না। বুকে ঝাপটে ধরেন রাইসাকে। পরক্ষণে চোখ পড়ে বোন রোকেয়া ও ভাগ্নে রূপমের লাশের দিকে। গতকাল দুপুরে সিলেটের মিরাবাজারে ঘটে হৃদয় বিদারক দৃশ্যটি। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার পরিতোষ ঘোষ ধারণা করলেন- লাশে কিছুটা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় ঘটতে পারে ঘটনাটি। এ ধারণা গতকাল তিনি জোড়াখুনের বাসা পরিদর্শন করে এসে সাংবাদিকদের জানালেন। তাহলে শুক্রবার রাত থেকে দুই রাত এক দিন মা ও ভাইয়ের লাশের পাশে কেটেছে অবুঝ শিশু রাইসার। কিভাবে কাটলো এই সময় সেটি অবশ্য বলার বয়স হয়নি তার। এখনো ভালোভাবে কথাও বলতে পারছে না। তবে- স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর দিনার খান হাসু বললেন- রাইসাও এ ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছে। তার গলায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তিনি ধারণা করেন- রাইসাকে খুন করতে গলায় ঝাপটে ধরেছিল খুনিরা। এতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল রাইসা। কিন্তু মারা যায়নি। পরে রাইসার জ্ঞান ফিরে। রাইসাকে নিয়ে আপসোসের অন্ত ছিল না গতকাল মিরাবাজারে। দুপুরে যখন রাইসাকে কোলে করে বাসার সামনে দিয়ে গাড়িতে তোলা হয় তখন হাজারো চোখ তার দিকে। সাংবাদিকদের ক্যামেরা ঘিরে ধরেছে তাকে। রাইসা নির্বাক। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কিছু বুঝতে পারছে না। মুখ ফুটেও কিছু বলছে না। যখন তাকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য গাড়িতে তোলা হয় তখন সে মা-মা বলে ডাক দেয়। তার মা-যে আর বেঁচে নেই সেটি তাকে কে বোঝাবে। রাইসার মামা জাকির বিকালে জানিয়েছেন- ঘটনাকালীন সময়ের কথা রাইসাকে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন। সে বলেছে- এক আন্টি ও আঙ্কেল ছিলেন। তারা মা ও ভাইকে মেরেছে। এর বেশি সে কিছু বলতে পারেনি। পুলিশ হেফাজতে রাইসাকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সঙ্গে রয়েছেন আত্মীয়রাও। তবে- হাসপাতালে ভর্তি থাকা রাইসা খুঁজে ফিরছে মাকে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

5 × 2 =