ব্যাংকের এই অদক্ষতার প্রায় পুরোটাই দুর্নীতি ও অনিয়ম থেকে উৎসারিত

0
781

ব্যাংক খাতের অদক্ষতায় বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশের সমপরিমাণ ক্ষতি হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জিডিপি বিবেচনায় এ ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকার সমান বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। সানেম এ হিসাব করেছে জেনারেল ইকুইলিব্রিয়াম মডেল নামের একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে। তারা বলছে, এ পদ্ধতিটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত। আর ব্যাংকের এই অদক্ষতার প্রায় পুরোটাই দুর্নীতি ও অনিয়ম থেকে উৎসারিত। তাই বলা যায়, দুর্নীতির কারণেই জিডিপির এ ক্ষতি হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির ত্রৈমাসিক পর্যালোচনা শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে গতকাল বুধবার এ হিসাব তুলে ধরা হয় সানেমের পক্ষ থেকে।

রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান। জানতে চাইলে সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, কোনো অর্থনৈতিক ঘটনার প্রতিক্রিয়া অর্থনীতিতে কী হতে পারে, তা হিসাব করতে জেনারেল ইকুইলিব্রিয়াম মডেল ব্যবহার করা হয়। দেশের ষষ্ঠ ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও প্রভাব বিশ্লেষণে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। কী কী কারণে ক্ষতি হয় জানতে চাইলে সেলিম রায়হান বলেন, ব্যাংক খাতে এখন খেলাপি ঋণের (এনপিএল) হার মোট ঋণের ১০ শতাংশের মতো। যেসব ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়েছে, নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তার অনেকটাই আদায় হবে না। এসব বিবেচনায় নিলে খেলাপির পরিমাণ আরও বাড়বে। খেলাপির কারণে ব্যাংকের ক্ষতি হয়, ব্যবসায়ী ও গ্রাহকদের কাছ থেকে বেশি হারে সুদ আদায় করতে হয়, অনেক মানুষ ঋণ পান না, আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকায় ব্যাংকগুলো সম্প্রসারণে যেতে পারে না-এসব নানা কারণে সম্মিলিতভাবে অর্থনীতির ক্ষতি হয় জিডিপির ১ শতাংশ। তিনি বলেন, এ ক্ষতি না হলে আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার আরও বাড়ত। উল্লেখ্য, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ হবে বলে সাময়িক হিসাবে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস), যা গত বছর ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ ছিল। বিবিএসের হিসাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে স্থির মূল্যে দেশের ভেতরে উৎপাদিত পণ্য ও সেবার মূল্য বা জিডিপির আকার ছিল প্রায় ৯ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাব সম্পর্কে জানতে চাইলে আরেক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, আমার মতে ক্ষতির পরিমাণটা আরেকটু বেশি হওয়ার কথা। কারণ, দেশে ব্যাংকে যে ধরনের অনিয়ম চলছে, তার কারণে উদ্যোক্তা ও ভোক্তাদের যে ব্যয় বহন করতে হয়, তা অন্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি। তিনি বলেন, বছরের হিসাবে জিডিপির ১ শতাংশ ক্ষতি হয়তো ঠিক আছে, কিন্তু এর ক্রমপুঞ্জিত নেতিবাচক প্রভাব অনেক বেশি। সাম্প্রতিক ব্যাংকিং খাতের সংকট অনেক দিন ধরে চলমান কাঠামোগত সমস্যার ফল বলে উল্লেখ করা হয় সানেমের পর্যালোচনায়। এতে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতের একের পর এক কেলেঙ্কারি সামনে আসছে। এর ফলে ব্যাংকের প্রতি অনেক মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। আবার সাম্প্রতিক সময়ে কিছু বেসরকারি ব্যাংক অত্যধিক মাত্রায় ঋণ দিয়েছে। এতে তাদের ঋণ ও আমানতের অনুপাত (এডিআর) ৯০ শতাংশের ওপরে দাঁড়িয়েছে। এই ঋণের একটা বড় অংশ অপচয় হচ্ছে। সানেম আরও বলেছে, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ এবং পর্যবেক্ষণ ব্যাংকিং খাতের একটা বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দ্বারা সমর্থিত অনিয়মের কোনো দৃশ্যমান শাস্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারায় এ সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। হোটেলে সভা করে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চাপে বাধ্যতামূলক নগদ জমা (সিআরআর) এবং রেপো সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে সেলিম রায়হান বলেন, ‘বর্তমান সময়ে অনেক ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে পাশ কাটিয়ে। এটা বাংলাদেশ ব্যাংককে সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে যে তার ভূমিকাটা কী? এই দুটি সিদ্ধান্তই সঠিক উপায়ে নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি নির্ধারণের জন্য একটি ইউনিট আছে। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে, এখানে আমরা কিন্তু তা দেখিনি।’ সেলিম রায়হান আরও বলেন, যেসব ব্যাংক এখন খারাপ করছে, তাদের আবার টাকা দেওয়া হলে সেই টাকার অপব্যবহার হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। উন্নয়নশীল হলে রপ্তানি আয় কমবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটলে ২০২৭ সালের পর বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত ও চীনের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা বা জিএসপি হারাবে। সানেমের হিসাবে, এতে মোট রপ্তানি আয় ১১ শতাংশ কমে যেতে পারে, যার পরিমাণ হতে পারে ৬০০ কোটি ডলার। সানেম বলেছে, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে দেশের ভাবমূর্তির ইতিবাচক পরিবর্তন হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সি ভালো রেটিংয়ের কারণে দেশে বড় আকারের বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে। তবে আগামী ৯ বছরে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করা, রপ্তানি আয় বাড়ানো, প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো মজবুত করার দিকে নজর দিতে হবে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সানেমের চেয়ারম্যান অধ্যাপক বজলুল হক খন্দকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সায়েমা হক।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

2 × 4 =