ডাক বিভাগের আধিপত্য ও ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে যে কোন সময়ে ভয়াবহ সংঘর্ষের আশঙ্কা

0
1236

মামুন ইবনে হাতেমী:

ডাক বিভাগে আধিপত্য ও ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে যে কোন সময়ে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আর তা সৃষ্টি হতে পারে মতিঝিল পিএন্ডটি কলোনী পোস্টাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনকে কেন্দ্র করে। শতভাগ শিক্ষিত লোকের বসবাস মতিঝিল পিএন্ডটি কলোনী। মূলতঃ বিটিসিএল এবং পোস্টাল কর্মচারী-কর্মকর্তাদের নিয়ে পিএন্ডটি কলোনী গঠিত। এর একাংশে গঠিত হয়েছে মতিঝিল পোস্টাল কলোনী।

এখানে বসবাসরত পোস্টাল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যে সংগঠন তা পিএন্ডটি পোস্টাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন নামে পরিচিত। সম্প্রতি এই এসোসিয়েশনকে দুটি পক্ষ নিজেদের বলে দাবী করছে এবং একই নামে এরা পাল্টাপাল্টি কমিটি ও কর্মসূচি নিয়মিতভাবে অব্যাহত রেখেছে। একপক্ষ নিজেদেরকে যেমন বৈধ ও অন্যপক্ষকে সম্পূর্ণ অবৈধ বলে দাবী করছে তেমনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঢাকার প্রানকেন্দ্র মতিঝিল পিএন্ডটি কলোনীর দুটি ফ্লাটও এরা নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে। প্রায়ই দলবল নিয়ে এই দুই গ্রুপ কলোনীতে শক্তি প্রদর্শন ও মহড়ায় বের হয়। ইতিমধ্যে, ডাক বিভাগের সদর দপ্তর নামে পরিচিত পল্টনের জিপিও অফিসে এই দুই গ্রুপের মাঝে হাতাহাতি, চেয়ার ছোঁড়াছুড়ি, জুতা নিক্ষেপের মতন ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রতিপক্ষের উভয়ই বিরোধী পক্ষের উপর বিস্তর সব অভিযোগ এই প্রতিবেদকের কাছে করে। যেমন, টাকার বিনিময়ে বদলি ও পদোন্নতির বাণিজ্য, সারাদেশে বিভিন্ন কমিটি ও সাব কমিটি তৈরীর নামে চাঁদাবাজি, অর্থের বিনিময়ে জিপিওতে সরকারী চাকুরীতে নিয়োগ প্রদান এবং অর্থের বিনিময়ে সরকারী কোয়ার্টার বরাদ্দের মত গুরুতর সব অভিযোগ। এছাড়াও সঞ্চয়পত্র জালিয়াতদের মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে নিজেদের দলে লালন-পালন করা হয় বলে একপক্ষ আরেকপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। এই অভিযোগও আছে, সুয়োগ পেলে বিরোধী পক্ষের সমর্থকদের চক্রান্তের মাধ্যমে সরকারী চাকুরী থেকে বিতাড়ন করা নিয়মিত বিষয় এবং ইতিমধ্যে অনেকেই এই ষড়যন্ত্রের শিকারও হয়েছেন বলে জানা গেছে। বর্তমানে এরা নামে-বেনামে আছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ, ব্যাংক ব্যালেন্স ও আলীশান এপার্টমেন্টের মালিক। দেশের শীর্ষস্থানীয় নীতি-নির্ধারক মহল, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং দুদকসহ বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে এখনই এই বিষয়ে তদন্তে এগিয়ে আসা উচিৎ।

গতবছর মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে এই দুই গ্রুপ কলোনীতে বিশাল সব প্যান্ডেল টাঙ্গিয়ে আলাদাভাবে ২৬শে মার্চ উদযাপন, সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান ও ব্যান্ড শো’র আয়োজন করে। কে কত বেশী খরচে ও আয়োজনে এগিয়ে যেতে পারবে তা নিয়ে ছিল প্রতিযোগীতা। এই সময় কলোনীতে এক ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করে। উভয়পক্ষ দলবল নিয়ে কলোনী ও এর আশে পাশে জড়ো হতে থাকে। একপর্যায়ে সংঘর্ষ যাতে না ঘটে এবং প্রতিপক্ষের উপর হামলা ও প্যান্ডেল যাতে ভাঙ্চুর না হয় এই জন্য মতিঝিল থানার পুলিশ ব্যাটেলিয়ন নিয়ে একপক্ষের অনুষ্ঠানে প্রটেকশন দেয়। এক গ্রুপের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে আসেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান এমপি ও বর্তমান ডাক বিভাগের ডিজিসহ উর্ধ্বস্তন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। অন্য গ্রুপের প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় এমপি ও সাবেক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ও লোকাল কাউন্সিলর ও সাবেক ছাত্রনেতা মুনসুর আহমেদ, স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপিত নওশের আলী, মহিলা কাউন্সিলর মিনু রহমানসহ প্রমুখ। একপক্ষের আয়োজনে দর্শক সমাগম ছিল বেশী অন্যপক্ষ খরচের দিক দিয়ে ছিল এগিয়ে। ছোট এই কলোনীতে পাশাপাশি বিশাল সব আকৃতির সাউন্ডবক্স সহকারে দুই পক্ষ আলাদাভাবে যে সাংস্কৃতিক আয়োজন করে তাকে তান্ডব ছাড়া কিছুই বলা যায় না। উপস্থিত কলোনীর এক বাসিন্দা রসিকতা করে বলেন, এদের একপক্ষ যদি হয় বাংলাদেশের আওয়ামীলীগের শীর্ষস্থানীয় একজন নেতার আশীর্বাদপুষ্ট ও ডাক বিভাগের বর্তমান ডিজির বরপুত্র তবে বিপরীতপক্ষ মতিঝিলের লোকাল এমপি ও লোকাল কাউন্সিলরের মানসপুত্র। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, এই দুই গ্রুপের মাঝে আধিপত্য ও ভাগবাটোয়ারা নিয়ে জিপিও অফিসে বা পিএন্ডটি কলোনীতে যে কোন সময় বড় ধরণের সংঘর্ষ বেধে যেতে পারে। এতে বড় ধরণের হতাহতের ঘটনা ঘটবে।

জানা গেছে, ডাক বিভাগের প্রধান দফতর হিসাবে পরিচিত ঢাকা জিপিও গুলিস্তান থেকে শেরেবাংলা নগরে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ২০১৪ সালে ৫৪ কোটি ৭২ লক্ষ টাকায় ২৫ তলার ভিত্তিসহ ভবন নির্মাণের যে প্রকল্পটি একনেকে পাশ হয় তা বর্তমানে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯১ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা, প্রায় দ্বিগুন এবং কাজ এখনো অসমাপ্ত। এখন নেয়া হয়েছে আরো একটি বিশাল প্রকল্প। বর্তমানে পোস্টাল কলানীতে নতুন করে চলছে সুউচ্চ ২০ তলাবিশিষ্ট ৮টি ভবন নির্মাণ প্রকল্প। সরকারের এটি একটি মেগা প্রকল্প। প্রায় ২৫৫ কোটি ব্যায়ে এই প্রকল্পের ব্যয় ভবিষ্যতে যে আরো বাড়বে তা শতভাগ নিশ্চিন্ত বলে সূত্র দাবী করে। এসব প্রকল্প যারা প্রণয়ন করেন তাদের সক্ষমতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠে তেমনি কি কারণে বার বার দেশের প্রকল্পগুলোর ব্যয় বাড়ে তার জন্য নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করা প্রয়োজন। বর্তমানে কলোনীর পুরাতন ২২টি ভবন পর্যায়ক্রমে ভেঙ্গে ফেলার কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ৮ টি ভবন ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। অভিযোগ আছে, এখানকার অনেকগুলো বহুতল ভবন প্রায় নতুন ১৫/২০ বছর আগের তৈরী। অপরিপক্কতা আর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারণে ডুবতে বসেছে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব এই প্রতিষ্ঠান ডাক বিভাগ। প্রতিবছরই নেয়া হচ্ছে সরকারী কোষাগারের টাকা অপচয় করে শত শত কোটি টাকার নিত্য নতুন প্রকল্প কিন্তু দীর্ঘদিনেও প্রকল্পগুলো আলোর মুখ দেখছে না। ফলে সরকারী ডাক বিভাগ মানুষকে আশার আলো দেখাতে পারছে না। বছরের পর বছর লোকসানের পর লোকসান দিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন পত্রিকার সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ বছরে ডাক বিভাগ লোকসানের বৃত্ত হতে বের হয়ে আসতে পারে নাই। ডাক, টেলিযোগযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এই বিভাগে যা আয় হচ্ছে, ব্যয় হচ্ছে তার দ্বিগুণ। গত সাত অর্থবছরে সরকারী এ প্রতিষ্ঠানের লোকসানের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের ডাক বিভাগে বছরে ২২ শতাংশ হারে লোকসান বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, আধুনিকায়নের লক্ষ্যে ডাক বিভাগের অধীনে বিভিন্ন প্রকল্প এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। এই অবস্থায় একটি লোকসানী প্রতিষ্ঠানের পেছনে জাতীয় কোষাগার থেকে বিশাল অংকের অর্থ ব্যয়ের আগে ভালভাবে লাভক্ষতির হিসাব করা জরুরি বলে সকলের অভিমত। অথচ এসব দেখার নেই কেউ, চাইলেও এর জবাব মেলে না। ডাক বিভাগের কর্মকর্তাদের উচ্চাভিলাষী ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমণ, উদাসীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বিভাগটি ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। পোস্ট অফিস ডিজিটালাইজেশন বা আধুনিকায়ন করার উদ্দ্যোগ বহুবার নেয়া হলেও এক শ্রেনীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী কখনোই চায় না এই উদ্দ্যোগ সফল হোক। কারণ এতে তাদের দুর্নীতি করার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ ডাকবিভাগের অধীনে ৯ হাজার ৮৮৬ টি ডাকঘর আছে এবং এসকল ডাকঘরের প্রতিটিতেই ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু আছে। এর মধ্যে ৮ হাজার ৪৬০টি গ্রাম পর্যায়ে বাকি ১ হাজার ৪২৬টি বিভাগীয় ও জেলা সদরে। তাই বলা যায়, বাংলাদেশে অর্থনীতিতে ডাক বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিদ্যমান।

অন্যদিকে ডাক বিভাগের মূল যে কাজ, বর্তমান সময়ে সাধারণ চিঠির চেয়ে পার্সেল পাঠানোর চাহিদা বেশি। বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসগুলো এই ব্যবসা লুফে নিয়েছে। ডাক বিভাগের ক্রমাগত লোকসান ও সেবার মান যখন নিচের দিকে তখন বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবসা লাভজনক পর্যায়ে রয়েছে। বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই ডাক বিভাগ আধুনিকায়ন করা হচ্ছে না এমন অভিযোগও আছে। বর্তমানে ডাক বিভাগ ও ডাক ব্যাংকের দুর্বলতা ও দুর্নীতি সারা দেশব্যাপী আমাদের আরো গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান অব্যাহত আছে। পরবর্তীতে সময়ে তা প্রকাশ করা হবে। দুদকসহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে এখনই এই সরকারী প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির তদন্তে এগিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছি। হতে পারে, বড় কোন ধরণের আর্থিক দুর্ঘটনার আগেই এ সেক্টরটিকে হয়তো বাঁচানো সম্ভব হবে।

mrmamun.moon25@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

five × four =