জালনোটের কারবারীরা ঈদকে সামনে রেখে তৎপর হয়ে উঠেছে

0
513

রাজধানীসহ সারাদেশে পুলিশ ও র‌্যাবের মাদকবিরোধী অভিযান চলছে। প্রতি রাতেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে এবং মাদক বিক্রেতাদের নিজেদের মধ্যে বিরোধে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের ঘটনা ঘটে চলেছে। পুলিশ ও র‌্যাব মাদকবিরোধী অভিযানে ব্যস্ত থাকায় জালনোটের কারবারীরা ঈদকে সামনে রেখে তৎপর হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ২১০টি চক্র সক্রিয় রয়েছে। আর ৪৬টি চক্র বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় জাল টাকা ছাড়ানোর কাজ করছে। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

 

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সমস্ত ব্যাংকগুলোর ওপর জারী করা এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ঈদের আগে নোট জালকারী চক্রের অপতৎপরতাদ বাড়ে এবং তার জন্য কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সাথে কীভাবে জাল নোট সহজে চেনা যায় -সে সম্পর্কেও নির্দেশনাগুলো নতুন করে মনে করিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পুলিশের সূত্র জানায়, গত বছর মধ্য রমজানের দিকে গোয়েন্দা পুলিশের একটি বিশেষ দল রাজধানীর বেগম রোকেয়া সরণীর একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ছাপা-অর্ধছাপা ৪০ লাখ টাকা মূল্যমানের জালটাকা ও সরঞ্জামা উদ্ধার করে। এ সময় সংঘবদ্ধ জালটাকা প্রস্তুতকারী চক্রের হোতা হাওলাদার সোহেল, তার পাঁচ সহযোগিকে গ্রেপ্তার করে। এরা হলো মাজহারুল ইসলাম, আল আমিন, আরিফ আরমান ওরফে নিপু, শফিকুল ইসলাম ও সোহেল মিয়া। গোয়েন্দা পুলিশ গত বছরের রমজানের প্রথম সপ্তাহে মিরপুরের মনিপুর আদর্শ রোডের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে শফিকুল ইসলাম ওরফে শামিম, সোহাগ অধিকারী, সুমন আহমেদ, বায়েজীদ উদ্দিন, সিদ্দিকুর রহমান ও জেসমিন আক্তার নামে আরো ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল। দুই অভিযানে গ্রেপ্তারকৃত ১২ জনের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু এদের অনেকেই আইনের ফাঁক ফোকরে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছে। এরাই এবার ঈদের মার্কেটে জাল টাকা ছড়ানোর জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। রমজানের প্রথম থেকেই দু’টি চক্রের সন্ধানে গোয়েন্দা পুলিশ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছে। তবে তাদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য গোয়েন্দা পুলিশ পায়নি। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে, সারাদেশে জাল টাকা ছড়ানোর সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হলেও প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৭০ জনই জামিনে বের হয়ে পরবর্তী সময়ে আবারও নিয়োজিত হচ্ছে জাল নোটের ব্যবসায়। ঈদ এলেই তাদের সিন্ডিকেট সারাদেশে সক্রিয় হয়ে ওঠে। গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা, এবার মাদকবিরোধী অভিযানে পুলিশ ও র‌্যাব ব্যস্ত থাকার সুযোগে সিন্ডিকেট জাল টাকা বাজারে ছেড়েছে। র‌্যাবের মিডিয়া উইয়ং-এর পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, জাল নোট নিয়ে র‌্যাব সারাবছর কাজ করে। তবে ঈদকে সামনে রেখে জাল নোট চক্র সারাদেশেই সক্রিয় হয়ে উঠে। এ বিষয়টি সামনে রেখে র‌্যাব সারাদেশেই জাল নোট চক্রের বিরুদ্ধে সক্রিয় রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গ্রেফতারের পর ওই চক্রের সদস্যরা জামিনে বেরিয়ে এসে আবারো একই কাজ করে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে র‌্যাব সক্রিয় রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। জালনোট তৈরি চক্রের কেউ গ্রেপ্তার হলে পুলিশ ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করে। কিন্তু মামলার দুর্বলতায় জালনোট চক্রের সদস্যরা সহজেই জামিন পেয়ে যায়। পুলিশ এসব মামলায় যাদের সাক্ষী করে প্রায়ই তাদের খোঁজ পাওয়া যায় না। ফলে মামলার নিষ্পত্তি অসম্ভব হয়ে পড়ে। জালনোট প্রতিরোধে ২০১১ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক এমন অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের সুপারিশ করে আইন মন্ত্রণালয়ে একটি সুপারিশ পাঠায়। এছাড়া জালনোট ব্যবসায় জড়িতদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমেও শাস্তি দেয়ার প্রস্তাব করে। কিন্তু জালনোটে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড সুপারিশের বিরোধীতা করা হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে। এরপর সেই সুপারিশ আর আলোর মুখ দেখেনি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) মো. মাসুদুর রহমান জানান, প্রতি বছরের মতো এবারও ঈদকে সামনে রেখে জালটাকা বাজারে ছাড়ার সঙ্গে জড়িত চক্রের ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এরা সিন্ডিকেট করে তাদের বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে জাল টাকা বাজারে ছাড়ে। রাজধানীতে জাল টাকা তৈরির সঙ্গে জড়িত কয়েকটি সিন্ডিকেট রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। পুলিশ সদরদফতর সূত্রে জানা গেছে, জালনোট তৈরির সঙ্গে জড়িত চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গত বছরের ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের শুরুতে ঢাকায় বাংলাদেশ ও ভারতের জালনোট সংক্রান্ত যৌথ টাস্ক ফোর্সের বৈঠক হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে টাস্ক ফোর্স এক সঙ্গে কাজ করাসহ গোয়েন্দ তথ্য বিনিময়ের সিদ্ধান্ত নেয়। উভয় টাস্ক ফোর্স নিজ নিজ দেশের জালনোট তৈরির সঙ্গে জড়িত চক্রের তালিকা বিনিময় করে। পুলিশের সূত্র জানায়, জালনোট তৈরির চক্রের সদস্যরা সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন খুচরা পণ্যের ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে বাড়ি ভাড়া নিয়ে কর্মকান্ড করছে। এমন চক্রের সংখ্যা ৪৬টি। কেউ যাতে সন্দেহের চোখে দেখতে না পারে এজন্য তারা পরিবার নিয়ে ওইসব বাসায় ভাড়া থাকছে। তাদের বাসা ভাড়া করে দেয়া এবং জালনোট তৈরির রসদ সরবরাহে ঢাকা ও জেলা পর্যায়ের জাল টাকার চক্রের সদস্যরা সহযোগিতা করছে। সূত্র আরো জানায়, লালমনিরহাটের বুড়িমারী সীমান্তের মন্ডলপুর, সফিপুর এবং যশোর জেলারএলাকায় জালনোট তৈরির সদস্যরা সক্রিয় রয়েছে। এ ছাড়াও চুয়াডাঙ্গার দর্শনার সীমান্তের ওপারের ভারতের সীমান্ত এলাকার মেদিনীপুর, রামকৃষ্টপুর, বহরমপুর ও উড়িষাবাড়ি এলাকায় ভারতীয় চক্রের সদস্যরা সক্রিয় রয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ওপারে ভারতের সীমান্ত এলাকায় গড়ে উঠেছে জাল টাকা তৈরির গোপন কারখানা। ওই কারখানায় ১০০০, ৫০০, ১০০ ও ৫০ টাকার জাল নোট ছাপানো হয়। সেখানে রয়েছে শক্তিশালী একটি নেটওয়ার্ক। তাদের সাথে বাংলাদেশী টাকা জালিয়াতি চক্রের রয়েছে যোগাযোগ। চাহিদা অনুযায়ী এই জাল টাকা সীমান্ত পথ গলিয়ে এই চক্রের কাছে পৌঁছে যায়। পরে সীমান্ত এলাকা থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন হাট-বাজারসহ সারাদেশে জাল টাকা ছড়িয়ে দেয়া হয়। এজন্য জালিয়াত চক্রের রয়েছে বহু মাঠকর্মী। মাঠকর্মীরা ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে শহর ও হাট-বাজারে নানা কৌশলে জাল টাকা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এসব মাঠকর্মী টাকা জালিয়াত চক্রের কাছ থেকে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ কমিশন পায়। এদিকে টাকা জালিয়াত চক্রের সঙ্গে একশ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যোগসাজস থাকে। জালিয়াত চক্রের মাঠকর্মীরা কখনো হাতেনাতে ধরা পড়ে গণপিটুনির শিকার হলে উক্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাদের ছাড়িয়ে নেয়াসহ পুলিশের কাছে সোপর্দ করতে বাধা দেয়। তা ছাড়া মাঝে-মধ্যে এই চক্রের দুই একজন সদস্য পুলিশের হাতে আটক হলেও তারা কিছুদিন জেল খেটে বেরিয়ে এসে আবার টাকা জালিয়াতির কাজে নেমে পড়ে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

five × 4 =