বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস ২০১৮ এর সার্থকতা হতে পারে তামাকজাত দ্রব্য বিপণনে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা

0
1023

প্রতি বছর ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস হিসাবে পালন করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিবছর একটি করে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই দিবসটি উদযাপিত হয়। মূলত, বিশ্বের তামাক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়কে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে দেশের সরকারি বেসরকারি পর্যায়ের তামাক বিরোধী কার্যক্রমকে বেগবান করার উদ্দেশ্যে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস-এর ঘোষণা আসে। ২০১৮ এর প্রতিপাদ্য হচ্ছে “তামাক করে হৃৎপি-ের ক্ষয় স্বাস্থ্যকে ভালবাসি তামাককে নয়” বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ তামাকজাত দ্রব্যর ব্যবহার। বাংলাদেশে ৪৩ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৪ কোটি ১৩ লক্ষ (এঅঞঝ, ২০০৯) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক সেবন করেন, যার মধ্যে ২৩% (২ কোটি ১৯ লক্ষ) ধূমপানের মাধ্যমে তামাক ব্যবহার করেন এবং ২৭.২% (২ কোটি ৫৯ লক্ষ) ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করেন। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের হার নারীদের মধ্যে অনেক বেশি।

 

বাংলাদেশে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সের প্রায় ৭% (এণঞঝ, ২০১৩) কিশোর-কিশোরী তামাকপণ্য ব্যবহার করে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার (ওঐগঊ, ২০১৬) মানুষ অকাল মৃত্যু বরণ করে। তামাক উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ব্যবহারসহ সকল পর্যায়ে স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং পরিবেশের জন্য মারাত্বক ভীতিকর, তার কারণে তামাকের ক্ষতিরোধে তামাক নিয়ন্ত্রণের কোন বিকল্প নেই। আরো সুস্পষ্টভাবে বলা যায়,বাংলাদেশে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের (এসডিজি) লক্ষমাত্রা অর্জনে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার যদি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয় তবে এসডিজি-৩ (সকল বয়সের সকল মানুষের জন্য সুস্থ্য জীবনের নিশ্চয়তা ও জীবনমান উন্নয়ন) এবং ৮ (স্থিতিশীল,অর্ন্তভূক্তি মূলক ও টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন) অর্জন বাধাগ্রস্থ হবে। তার কারণে তামাক নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই।
এ কথা এখন সবারই জানা যে, ধূমপান শুধু ব্যবহারকারীদের ক্ষতিগ্রস্থ করে না, উপরন্ত যারা তাদের আশে-পাশে থাকে তারাও এর ক্ষতির প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। তারা না চাইলেও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে, স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। পরোক্ষ ধূমপান সংক্রামক ও অসংক্রামক উভয় রোগ সৃষ্টি করে, বিশেষভাবে শিশু, নারী ও নারীর গর্ভের সন্তান ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বর্তমানে দেশে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ফলে যে ভয়বহ স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি তৈরী হচ্ছে তার কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় স্পীকারদের সম্মেলনে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ তামাক মুক্ত করার ঘোষনা দেন। একই রকম ভাবে আমরা লক্ষ করি, এসডিজি-৩.ক. এ বলা হচ্ছে, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সকল দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের বাস্তবায়ন জোরদার করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসি এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট গাইড লাইন দিচ্ছে, যার মধ্যেমে স্বাক্ষরকারী দেশগুলি সরকারীভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি গ্রহন করতে পারে। বাংলাদেশ প্রথম এফসিটিসি স্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে এখানকার পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে তামাকজাত দ্রব্যের সহজলভ্যতা কমিয়ে এনে অর্থাৎ তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কমিয়ে আনতে পারে। এসডিজি-৩- এর লক্ষমাত্রা অর্জনে এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা কার্যকরের মাধ্যমে। আমরা জানি সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের মতো প্রতিষ্ঠান গুলি স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান। ব্যবসা-বানিজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান গুলি ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়িক লাইসেন্স প্রদান করে থাকে তাদের আইন ও বিধিমালা অনুসরণ করে। বর্তমানে দেখা যায়, মুদি দোকান থেকে শুরু করে ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোরে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় হচ্ছে। যখন একটি লাইসেন্স প্রদান করা হয়ে থাকে তখন সুনির্দিষ্টভাবে কোন ব্যবসার লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে সেটি উল্লেখ করা থাকে। যিনি রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করার জন্য লাইসেন্স গ্রহন করছেন নিশ্চয় তিনি এ লাইসেন্সের আওতায় মুদি দোকানের ব্যবসা করতে পারেন না আইন অনুসারে। একই রকম ভাবে যিনি মুদি ব্যবসার জন্য লাইসেন্স নিচ্ছেন সেখানে তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবসা করতে পারেন না। এক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে আইন লঙ্ঘন ঘটে। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় যদি তার আওতাধীন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান গুলিকে এ মর্মে নির্দেশনা প্রদান করে যে, তারা যে লাইসেন্স গুলি প্রদান করেছে সেটি সঠিক ভাবে তদারকি করার জন্য, তাহলে তামাকজাত দ্রব্য যত্রতত্র বিক্রয় অনেকাংশ কমে আসবে। তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে ও বিপণনের জন্য বাংলাদেশে কোন সু-নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। এমনকি তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের সাথে সম্পৃক্তদের নির্ধারিত কোন ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণের ব্যবস্থা নাই। যে কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রের আশেপাশের এলাকা, ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর, খাবারের দোকান, রেষ্টুুরেন্টসহ বিভিন্ন স্থানে অনিয়ন্ত্রিতভাবে তামাকজাত পণ্য বিক্রয় করা হচ্ছে। সহজ লভ্যতা ও সহজ প্রাপ্যতার কারণে যত্রতত্র তামাকজাত পণ্যের বিপণন কেন্দ্র গড়ে উঠছে। উৎকন্ঠার বিষয় এ সকল দোকানের সংখ্যা দিনদিন ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে এর বিক্রয়ে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা প্রণয়ন করে এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের বাস্তবতায় এফসিটিসি বাস্তবায়নে একটি কার্যকারী পদক্ষেপ হতে পারে এই লাইসেন্সিং ব্যবস্থা। মদ বিক্রয়ের জন্য যেমন লাইসেন্স গ্রহণ করতে হয় তেমনি তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের জন্য বিশেষ লাইসেন্স গ্রহন করতে হবে। এবং বিদ্যমান স্থানীয় সরকার (সিটি করর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ এর তৃতীয় তফসিল (ধারা-৪১ ) সিটি করর্পোরেশনের বিস্তারিত কার্যাবলীর ১.১ ও ৫ অনুসারে সিটি কর্পোরেশন এলাকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য দায়ী থাকবে এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নতির বিধানকল্পে প্রয়োজনীয় অন্য যে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। এছাড়া খাদ্য ও পানীয় দ্রব্যাদী ১১.১ অনুসারে, সিটি করর্পোরেশন খাদ্য ও পানীয় দ্রব্যাদী বিক্রয়ের উপর লাইসেন্স আরোপ ও ভ্রাম্যমান বিক্রয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টিও এই আইনে উল্লেখ করা হয়েছে। একই ভাবে স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯ এর দ্বিতীয় তফসিল (ধারা ৫০-৭১ দ্রষ্টব্য) পৌরসভার বিস্তারিত কার্যাবলীর ১ ও ৭ এবং খাদ্য পানীয় দ্রব্যাদি ১৯ অনুসারে উল্লেখিত বিষয়ের প্রতি অনুরুপ নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ এসডিজি-৩ লক্ষ্য অর্জনে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাকজাত পণ্য ক্রয়-বিক্রয়,সেবনে নিরুৎসাহিত করণে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার (সিটি করর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ এবং স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন, ২০০৯ এর বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা গ্রহণে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এইড ফাউন্ডেশন ২০১৫ সাল থেকে অদ্যাবধি কাজ করছে। এই প্রতিষ্ঠানটির এ্যাডভোকেসির কারণে উপরোক্ত আইনের আলোকে দেশের বিভিন্ন পৌরসভায় তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের জন্য আলাদা লাইসেন্স ইসু করেছে এবং বর্তমানে করছে। কিন্তু জাতীয় ভাবে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে লাইসেন্সিং ব্যবস্থার ক্ষেত্রে তারা মনে করছেন,স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয় কতৃক কেন্দ্রীয় ভাবে দেশের সকল সিটি করর্পোরেশন, পৌরসভায় তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের জন্য পৃথক লাইসেন্স গ্রহনের জন্য শুধুমাত্র একটি নির্দেশনা বা পরিপত্র জারি করে তবে বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি ঘটবে একই সাথে প্রধানমন্ত্রীর ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষনা বাসÍবায়নে কার্যকারী ভূমিকা রাখবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

seventeen + 10 =