গোপালগঞ্জের পোনা মাদ্রাসার কোটি টাকা আত্মসাতকারী হাফেজ মুসা ফেঁসে যাচ্ছে

0
829

বিশেষ সংবাদদাতাঃ
গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার পোনা আরাবিয়া শামচুল উলুম কওমিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে ফেঁসে যাচ্ছেন বহুল বিতর্কিত মুহাতামিম হাফেজ মো. মুছা। অভিযোগ তদন্তে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উপজেলা প্রানিসম্পদ অফিসের ভেটেরিনারী সার্জনকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করলেও কার্যক্রম থেমে গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছে। কথিত জঙ্গী মুসার বিরুদ্ধে মাদ্রাসার একজন এতিম ছাত্রকে নৃশংশভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার প্রায় দুযুগ পর তদন্তে নামছে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঐতিহ্যবাহী পোনা মাদ্রাসা এবং এতিমখানার নামে আদায়কৃত সাহায্যের সিংহভাগ বছরের পর বছর আত্মসাত করে চলেছেন হাফেজ মো. মুছা। কোরবানির চামড়, জাকাত, ফেতরা, বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অনুদান এবং সরকারী ত্রাণের চালসহ লাখ লাখ টাকা আত্মসাত করে চলেছেন গত ৪০ বছর ধরে।

 

এ অর্থে তিনি এখন অর্ধশত কোটি টাকার মালিক হয়ে ধরাকে সরা মনে করছেন। কাশিয়ানী এবং তার পৈত্রিক এলাকা নগরকান্দায় অন্তত ২০ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক তিনি। কাশিয়ানী থানা সদরের ৩৫ নম্বর পোনা মৌজায় তিনি প্রায় ৩৫ বিঘা জমি কিনেছেন। কাশিয়ানী মৌজায় আছে তার তিনটি প্রাসাদোপম বাড়ি। এ সম্পত্তির বাজার মূল্য প্রায় ২৫ কোটি টাকা।
কাশিয়ানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবেও আছে তার এবং ছেলের নামে মোটা অংকের অর্থ। তবে মজার ব্যাপার মুসা কোন আয়কর দেননি কোন দিন। ভুয়া ভাউচার এবং বিলের মাধ্যমে এতিমের টাকা লুন্ঠন এবং মাদ্রাসায় জঙ্গীবাদের প্রশিক্ষণের খবর প্রকাশের পর গণবিক্ষোভের মুখে তাকে এলাকা ছাড়তে হয়েছিল। জঙ্গী মনোভাপন্ন মুছা এতিমখানার লুটের টাকায় বিভিন্ন ব্যক্তিকে ম্যানেজ করে মাদ্রাসায় অনু প্রবেশের সুযোগে ফের অপকর্মে মেতে উঠেছেন। এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। মাদ্রাসায় চাকরীর পর একজন এতিম ছাত্রকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার পর তার সন্ত্রাসী চরিত্রের প্রকাম ঘটে। তার দাপটে নিহতের মা আপোস করতে বাধ্য হন।
গহরডাঙ্গা মাদ্রাসার ছাত্র মুসা ১৯৬৬ সালে কাশিয়ানীতে পৌছে আস্তানা গাড়েন। ১৯৭১ সালে পোনা আরাবিয়া শামচুল উলুম কওমিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানায় চাকরী লাভের ফলে তার হাতে আলাদ্বীনের চেরাগ উঠে। শুরু থেকে গত প্রায় চারযুগ ধরে মুহাতামিম আছেন হাফেজ মো. মুছা। এ সময় মাদ্রাসার আয় ব্যয়ের হিসাব কাউকে দেননি। এ মাদ্রাসার একজন এতিম ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার পর তিনি এলাকায় জঙ্গী সমসা হিসেবে পরিচিতি পান। কৌশলী এ ব্যক্তি এরাকায় আধিপত্য বিস্তারের লক্ষে সংঘবদ্ধ মাফিয়াগোষ্ঠী গড়ে তোলেন। তাদেও নানা সুবিধা প্রদান এবং অন্যদেও ভয়ভীতি দেখিয়েই মাফিয়া সা¤্রাজ্য অটুট রাখতে সক্ষম হয়েছে।
এদিকে মুসার সিরিজ দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর তথ্য একের পর এক প্রকাশ পাওয়ায় এলাকার লোকজন বিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছেন। মুসার অপকর্ম ফাসঁ হয়ে পড়ায় বিক্ষুব্ধ বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে পোনা মাদ্রাসা ও এতিম খানার সভাপতি মো. বাকলেচুর রহমানসহ এলাকার বিশিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী কর্সকর্তার নিকট অভিযোগ দাখিল করেছেন। তবে অভিযোগের শুনানীতেই বিপত্তি ঘটেছে মুসার অপকর্মের প্রত্যক্ষদর্শী একজন সাবেক শিক্ষককে অপহরণের পরও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায়।
অভিযোগের শুনানীর নির্ধারিত দিনে গত ২০ মার্চ সকাল সাড়ে ১০ টায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট বক্তব্য প্রদান করতে যেয়ে হাফেজ মুসার লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীদের ন্যাক্কারজনক হামলার শিকার হয়েছেন অভিযোগ নামায় স্বাক্ষরকারী পোনা মাদ্রাসার প্রতিবাদী সাবেক শিক্ষক মো.রহমত উল্লাহ খান। পোনা মাদাসা ও এতিমখানার সভাপতি মো.বাকলেচুর রহমানসহ আন্যান্য অভিযোগকারীকে এদিন নির্বাহী কর্মকর্তা শুনানীতে হাজির হবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তাদের হাজির হবার জন্য ১১ মার্চ ২০১৮ পত্র দেয়া হয়েছিল (স্বারক নং-০৫.৩০. ৩৫৪৩.০০০.১৮.০০৭.১৬-২১১)।
মোঃ রহমত উল্লাহ খান কাশিয়ানী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট এক অভিযোগ নামায় উল্লেখ করেছেন যে, গত ২০ মার্চ নির্ধারিত দিনে তার দপ্তরে স্বাক্ষ প্রদান করতে যেয়ে হাফেজ মুসার লোকজনের দ্বারা অপহৃত হন। তারা তাকে জোরপূর্বক একটি মোটর সাইকেলে করে নিয়ে যায়। তারা একটি কক্সে আটকে রেখে অভিযোগ প্রত্যাহার করতে বলেন। কয়েকটি সাদা কাগজে তার সই নেয়া হয়। এ অভিযোগ তদন্তের জন্য ভবিষ্যতে ইউএনও ডাকলে আসতে নিষেধ করে দেয়া হয় প্রতিবাদী শিক্ষক রহমত উল্লাহকে। তিনি উপস্থিত হলে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে জঙ্গী মামলায় ফাসিয়ে দেয়া হবে বলে তারা হুমকি দিয়েছে। ২০ মার্চ ইউএনওকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন লাঞ্ছিত শিক্ষক।
তবে জেলা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করে মুর্তিমান আতংক হাফেজ মুছার হুমকিতে প্রতিবাদকারীরাই এখন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছেন। একজন প্রতিবাদী শিক্ষককে অপহরণ ও প্রাণনাশের হুমকির পরও প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নেয়ায় এলাকায় আতংক বিরাজ করছে। অন্যান্য প্রতিবাদকারীরাও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অভিযোগ প্রত্যাহার না করলে তাদের পিটিয়ে হেদায়েত করা ছাড়াও বিভিন্ন মামলায় ফাঁসিয়ে সর্বশান্ত করার হুমকি অব্যাহত রেখেছেন হাফেজ মুছা এবং তার পক্ষাবলম্বনকারী চিহ্নিত কিছু লোকজন। ধুরন্ধর মুসা অপকর্ম জায়েজ করতে কমিটির মধ্যে বিরোধ বাধিয়ে রাখেন কুটকৌশলে। কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে পকেট কমিটি গঠনে তিনি পারঙ্গম।
মুসার বিরুদ্ধে মাদ্রাসার ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা আত্মসাতসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসক কাশিয়ানী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। নির্বাহী কর্মকর্তা এ, এস, এম, মাঈন উদ্দিন গত ১১ মার্চ উপজেলা প্রানিসম্পদ অফিসের ভেটেরিনারী সার্জন শঙ্কর কুমার দে কে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন: উপজেলা সমাজ সেবা অফিসার এবং উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার। ১৫ এপ্রিলের মধ্যে তাদের মতামতসহ প্রতিবেদন দাখিলের সময় বেধে দেয়া হয়েছে। তবে এখনও তারা প্রতিবেদন দাখিল করেননি।
দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, পোনা মাদ্রাসা ও এতিমখানার সভাপতি বাকলেচুর রহমানসহ এলাকার বিশিষ্ট ছয় ব্যক্তি গত ৫ ফেব্রুয়ারী হাফেজ মুছার বিরুদ্ধে মাদ্রাসা ও এতিমখানার সরকারি দানের টাকাসহ সরকারী খয়রাতী চাল আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযোগে বলা হয়: পোনা মাদ্রাসায় চাকরীর শুরু থেকে একচেটিয়াভাবে হাফেজ মুসা জালিয়াতি করে এতিমের ধন লুণ্ঠনজজ্ঞে মেতেছেন। ভুয়া বিল ভাউচারের খরচ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ব্যাংক স্টেটমেন্ট এবং ক্যাশ বইয়ের সঙ্গে আয় ব্যয়ের মিল নেই। ব্যাংক হিসাব থেকে একতিয়ার বহির্ভুতভবে লাখ লাখ টাকা উঠিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে লোন দেয়ার নামে আত্মসাত করেছেন মুছা।
অপরদিকে মাদ্রাসার আয় ব্যয়ের অডিট করানো হয়না। গত ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত রশিদ বইএবং ক্যাশ বই যাচাইসহ অডিট করলে পিলেচমকানো দুর্নীতির প্রমান মিলবে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন। এ অভিযোগ আমলে নিয়ে দুদক তদন্ত এবং মুছা ও তার পোষ্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিগগিরই তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে বলে দুদক সচিব জানিয়েছেন। গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসক এবং কাশিয়ানী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট মুছার বিরুদ্ধে দাখিলকৃত অভিযোগ তদন্ত না করা এবং অভিযোগকারীকে উল্টো অপহরণ প্রচেষ্ঠার কারন তদন্ত করা হবে বলে সচিব মন্তব্য করেছেন। এদিকে বাংলাদেশ রেলওয়ে পোনা মাদ্রাসার জমি অধিগ্রহণ করে ১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা প্রদান করেছে। মাদ্রাসার অবশিষ্ঠ জমিতে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়নি। রেল কর্তৃপক্ষ যে কোন সময় এ জমির দখল নিলে প্রায় ৪০০ এতিমকে খোলা আকাশের নিচে থাকতে হবে। হাফেজ মুসা ব্যক্তিগত লাভের কথা বিবেচনা করেই কাশিয়ানী বাজারে ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে মাদ্রাসার নামে ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ জমি কিনেছেন। জমির অর্থ আদান প্রদানের আড়ালে তিনি মোটা অংকের বাণিজ্য করেছেন বলে সন্ধেহ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

15 − eight =