বৃষ্টির কারণে জলজট-যানজটে ঢাকা মহানগর গতকাল মঙ্গলবার আবারও অচল হয়ে পড়ে। মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর থেকে যানবাহনের লম্বা লাইন গিয়ে ঠেকেছে আগারগাঁও মোড় পর্যন্ত। বেশির ভাগ এলাকায় যানবাহনের সংখ্যা কমে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে রাজধানীবাসীকে। জলাবদ্ধতার কারণে বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী। চলতি সপ্তাহের বাকি দিনগুলোও থাকবে বৃষ্টিমুখর। এমন আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস।
ভারি বর্ষণে পাহাড়ধসের আশঙ্কা করছেন আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তারা। তাপমাত্রাও থাকবে অপরিবর্তিত। অর্থাৎ ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকবে তাপমাত্রা। অথচ শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহে ছিল ঠিক এর উল্টো চিত্র। তীব্র দাবদাহে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল জনজীবন। গত ৪ শ্রাবণ বছরের উষ্ণতম দিনটি (৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) প্রত্যক্ষ করেছে দেশের মানুষ। নিম্নচাপের প্রভাবে আবহাওয়া অফিস থেকে গত রবিবার আভাস দেওয়া হয়েছিল, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় চলতি সপ্তাহজুড়ে দেশজুড়ে বৃষ্টি ঝরবে। গতকাল চট্টগ্রামে সকাল থেকেই শুরু হয় বৃষ্টি। যদিও ঢাকায় বৃষ্টি নামে দুপুরে। আবহাওয়া অফিসের তথ্য বলছে, দুপুর ১২টা থেকে পরবর্তী তিন ঘণ্টায় ঢাকায় বৃষ্টি হয়েছে ৫৯ মিলিমিটার। গত বছর ঠিক এই সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, এ বছর বর্ষায় জলাবদ্ধতা হবে না। কিন্তু স্থানীয় সরকার বিভাগ, ঢাকা ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ তাদের সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি। ৫৯ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাত্রীদের গাড়িতে বসে থাকতে দেখা গেছে। অনেকে বিরক্ত হয়ে হেঁটে গন্তব্যে রওনা হয়েছে। আবার বৃষ্টিপাতের কারণে রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়ে নগরবাসী। ভারি বর্ষণের কারণে অফিস কিংবা ব্যক্তিগত কাজে বাইরে বের হলে চরম ভোগান্তিতে পড়ে খেটে খাওয়া মানুষ। আবার কেউ কেউ অতি বৃষ্টিতে বাসা থেকে বেরই হয়নি। আবহাওয়া কর্মকর্তা আবদুল মান্নান বলেন, ‘মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় এ সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতেও দেশের প্রায় সব স্থানে হালকা থেকে ভারি বর্ষণ হতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হবে চট্টগ্রাম বিভাগে। সেখানে ভারি বর্ষণের কারণে পাহাড়ধসেরও সম্ভাবনা আছে।’ আবহাওয়া অফিসের তথ্য বলছে, গতকাল সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ২০৮ মিলিমিটার। এরপরে সন্দ্বীপে ৯৮ মিলিমিটার। তা ছাড়া চট্টগ্রামে ৭৫ মিলিমিটার এবং রাজশাহীতে ৭১ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। মেট্রো রেল প্রকল্পের কারণে রাজধানীর মিরপুর সড়ক এমনিতেই সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যেটুকু সড়ক যানবাহন চলাচলের জন্য রাখা হয়েছে, সেটিও এখন খানাখন্দে ভরা। ফলে বর্ষায় চরম দুর্ভোগ আর ভোগান্তিতে পড়তে হয় মিরপুরের বাসিন্দাদের। গতকালও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মিরপুর ১০ নম্বর গোল চক্কর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সারি সারি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সিএনজিচালক আবদুর রহিম জানালেন, কুর্মিটোলা হাসপাতাল থেকে এক রোগীকে শেওড়াপাড়া আনতে তাঁর সময় লেগেছে তিন ঘণ্টা। বিকেল ৪টায় শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে কথা হলো শিকড় পরিবহনের চালকের সঙ্গে। তিনি জানান, আগারগাঁও থেকে শেওড়াপাড়া আসতে সময় লেগেছে দেড় ঘণ্টা। গাড়িতে বসে না থেকে অনেক যাত্রী বৃষ্টিতে ভিজেই ফুটপাত দিয়ে হেঁটে রওনা হয় নিজ নিজ গন্তব্যে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ওমর ফারুক প্রেস ক্লাব থেকে দুপুর আড়াইটায় মোটরসাইকেলে রওনা হন মিরপুরের বিআরটিএ অফিসের উদ্দেশে। শেওড়াপাড়ায় তিনি যখন পৌঁছান, তখন বিকেল সাড়ে ৪টা। অগত্যা বিআরটিএ অফিসে না গিয়ে নিজের অফিসে ফিরে যান তিনি। ভারি বর্ষণে মানিক মিয়া এভিনিউ, রাপা প্লাজা এলাকার সড়কটি পানির নিচে তলিয়ে যায়। ঝিগাতলা থেকে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত সাতমসজিদ সড়কটি ছিল কার্যত অচল। পুরো সড়কটি সারা দিনই যানজটের মধ্যে ছিল। রাজধানীর খামারবাড়ি থেকে বিমানবন্দরে যাওয়ার উদ্দেশে প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর শেষে গাড়িতে উঠতে সক্ষম হন আবুল কালাম নামের একজন চাকরিজীবী। আমাদের আরেক প্রতিবেদক রাজধানীর বাংলামটর, পান্থপথ, কারওয়ান বাজার এলাকা ঘুরে দেখেন, বৃষ্টিতে ওই সব এলাকাতেও দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। এতে করে ওই এলাকায় যানবাহনের গতি কমে যাওয়ায় দেখা দেয় তীব্র যানজট। আমাদের আরেকজন প্রতিবেদক সরেজমিন মতিঝিল, গুলিস্তান, কাকরাইল ও কমলাপুর এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখেছেন, বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হওয়ায় এলাকাজুড়ে দেখা দিয়েছে তীব্র যানজট। মালিবাগ-রাজারবাগ মোড় থেকে কমলাপুরগামী সড়কটির একপাশের অর্ধেক কেঁটে চলছে সংস্কার। মাটির নিচে পানি নিষ্কাশন পাইপ বসানো হলেও শেষ হয়নি সংস্কারকাজ। খোঁড়াখুঁড়িতে তৈরি হওয়া খানাখন্দে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক যান চলাচল। গতকাল দিনভর বৃষ্টিতে অনেকটাই অচল হয়ে পড়ে সড়কটি। বেলা সাড়ে ৩টায় শাহজাহানপুর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সামনের সড়কে দেখা যায়, খানাখন্দের মধ্য দিয়ে চলতে গিয়ে আটকে পড়ছে বাস, সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও রিকশা। আর এতে সড়কজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে যানজট। ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। বিকেল সাড়ে ৪টায় বঙ্গভবনের পাশের রাস্তাটিতে গিয়ে দেখা যায়, বেহাল দশা। রাস্তার ওপর হাঁটু সমান পানি। চলতে গিয়ে রিকশার অর্ধেক পানিতে ডুবছে। পানির নিচে খানাখন্দের ভয়ে ধীরে পার হওয়ায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা যানজট সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সরেজমিনে রাজধানীর পল্টন ও প্রেস ক্লাব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ভারি বৃষ্টিপাতের সময় সড়কে পানি জমলেও পরে বেশির ভাগ এলাকার পানি নেমে গেছে। আজিমপুর মোড়, চানখাঁরপুলের নাজিমুদ্দিন রোডে হাঁটু সমান পানি জমে। শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনি ও পীরজঙ্গি মাজার সড়কটি পানির নিচে তলিয়ে যায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই সড়কে পানি থাকতে দেখা গেছে। মাতুয়াইল-সারুলিয়া, দনিয়া, রাজধানীর এ তিনটি এলাকা একসময়ে ছিল ইউনিয়ন পরিষদ। সম্প্রতি এলাকা তিনটি যুক্ত হয়েছে সিটি করপোরেশনে। গতকাল বৃষ্টিতে তৈরি হওয়া জলাবদ্ধতায় নাগরিক ভোগান্তির বিষয়ে জানতে চাইলে ওই সব এলাকার বাসিন্দারা জানায়, তাদের এলাকা সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হলেও এখনো সিটি করপোরেশন পয়োনিষ্কাশন ও সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু করেনি। আবার আগের ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রমও নেই। ফলে পয়োনিষ্কাশনের অভাবে নাকাল হচ্ছে এলাকাবাসী। গতকাল দুপুরে বৃষ্টির সময় দেখা গেছে, মাতুয়াইলের ডগাইর, কোনাপাড়া, বাঁশের পুল এলাকা পানিতে সয়লাব। সড়কে কোমরপানি। পানির স্রোত প্রবেশ করেছে অনেক বাসা-বাড়িতে। ভাঙ্গাবাড়ি থেকে রানী মহলের এক চিলতে সড়কের দুই পাশের অর্ধেকটায় পানি। সামান্য উঁচু অংশে যানবাহনের দীর্ঘ সারি। এ সময় যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহনের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। ডগাইর এলাকার বাসিন্দা ফরহাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা এখন না ইউনিয়ন পরিষদে না সিটি করপোরেশনে। দেখার কেউ নেই। বিশেষ করে পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে। একটু বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হয় বড় জলাবদ্ধতা। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর দৈনিক বাংলা থেকে শাপলা চত্বর পর্যন্ত বড় বড় ড্রেন নির্মাণের কাজ শেষ করে কাঁচা মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়ায় বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। আর এই গর্তে পানি জমে সেখানে মরণ ফাঁদ তৈরি হয়েছে। বৃষ্টিতে ঘটছে দুর্ঘটনা। এদিকে গতকাল আবহাওয়া অফিস থেকে জারি করা সতর্কবাণীতে বলা হয়েছে, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় দেশের আটটি বিভাগের কোথাও কোথাও ভারি বর্ষণ (৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার) হতে পারে। আবার কোথাও কোথাও অতি ভারি (৮৯ মিলিমিটার থেকে ওপরে) বর্ষণ হতে পারে। অতি ভারি বর্ষণের কারণে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে।