পোশাক খাতে অর্থায়ন করতে গিয়ে নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে ব্যাংক

0
595

রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক খাতে অর্থায়ন করতে গিয়ে নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে ব্যাংক। এ খাতে বাণিজ্য সুবিধা দিতে গিয়ে লিলিপুটের মতো ভণ্ড বিদেশি ক্রেতা যেমন দেখা গেছে, তেমনি হলমার্ক-বিসমিল্লাহ টাওয়েলস গ্রুপের মতো স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতির ঘটনা দেখেছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। এর ফলে সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারক যেমন পথে বসছে তেমনি ব্যাংকে খেলাপি ঋণের বোঝা বাড়ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, কিছু ঝুঁকি সৃষ্টি হয় ইচ্ছাকৃতভাবে এবং কিছু ঝুঁকি সৃষ্টি হয় জ্ঞানের স্বল্পতা বা দক্ষতার অভাবে। এভাবে রপ্তানিকারক এবং তাদের বিদেশি ক্রেতারা ব্যাংক, ব্যবসায়ী এবং সর্বোপরি দেশকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। গতকাল মিরপুরে বিআইবিএম অডিটরিয়ামে ‘তৈরি পোশাক খাতে ব্যাংকের বাণিজ্য সুবিধা প্রদাণের ঝুঁকি এবং তা নিরসনের কৌশল’ শীর্ষক কর্মশালায় ওই গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধূরী। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের  দ্বিতীয় সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘৬৫ শতাংশ রপ্তানি নির্দিষ্ট সময়ে করা সম্ভব হয় না। এটি বড় চ্যালেঞ্জ। পোশাক খাতের দক্ষ শ্রমিক সংকটের কারণে এমনটা হচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘পোশাক খাতে শুধু হলমার্ক-বিসমিল্লাহর ঋণ কেলেঙ্কারিই শেষ নয়, এমন আরো ১৪-১৫টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিদিনই পত্রিকা হাতে নিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকি কখন আবার কোন প্রতিষ্ঠানের নাম চলে আসে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দুই থেকে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে।’ কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে বিআইবিএমের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) ড. শাহ মো. আহসান হাবীব বলেন, ‘গ্রাহকদের ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্য সেবার মান আগের চেয়ে ভালো। তবে পুরোপুরি কমপ্ল্যায়েন্স মানার বিষয়টি বিশ্বব্যাপী উদ্বিগ্নের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তৈরি পোশাক খাতের ওপর। এ জন্য সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি নিয়ে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।’ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬৬ শতাংশ ব্যাংকারের ধারণা পোশাক খাতের অর্থায়নে বড় বাধা দেরিতে জাহাজীকরণ। আবার রপ্তানিকারকরা সঠিক কাগজপত্র উপস্থাপন না করার কারণে অর্থায়নে জটিলতা তৈরি হয় বলে মনে করেন ৫৩ শতাংশ ব্যাংকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলী বলেন, বিশ্বব্যাপী এখন চলছে ট্রেড ওয়্যার বা বাণিজ্য যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের যে বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে তাতে অচিরেই চীন থেকে কিছু ব্যবসা বাংলাদেশের মতো দেশে চলে আসবে। বিআইবিএমের চেয়ার প্রফেসর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. বরকত-এ-খোদা বলেন, ব্যাংক খাতের রপ্তানিকেন্দ্রিক জালিয়াতি কমাতে ব্যাংকারদের প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে বিজিএমইএর মতো বিআইবিএমকেও নতুন কোর্স চালুর সুযোগ রয়েছে। এবিবি চেয়ারম্যান এবং ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান পোশাক খাতের রপ্তানি প্রক্রিয়া পুরোপুরি অটোমেশনের মধ্যে নিয়ে আসার পরামর্শ দেন। মাস্টার এলসির বিপরীতে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খোলার সময় ব্যাংকগুলোকে আরো বেশি সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যাংককে সঠিকভাবে নজরদারি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটি কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডার করা যেতে পারে। তা ছাড়া ক্রেডিট রিপোর্ট এবং সিআইবি রিপোর্ট দ্রুত সময়ে প্রাপ্তি এ খাতে অর্থায়নের ঝুঁকি কমাতে পারে।’ সমাপনী বক্তব্যে বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধূরী বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ব্যাংক কর্মকর্তাদের আরো দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। আবার গ্রাহকদেরও সচেতন করার উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যানশিয়াল স্ট্যাবিলিটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৭ সালে ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের মধ্যে পোশাক খাতের ঋণের স্থিতি ছিল ৯৩ হাজার কোটি টাকা, যা ২০১৬ সালে ছিল ৭৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। একই বছরে এ খাতের খেলাপি ঋণও বেড়েছে দুই হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। ২০১৬ সাল শেষে পোশাক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল সাত হাজার ৮৫০ কোটি টাকা, যা ২০১৭ সাল শেষে বেড়ে হয়েছে ১০ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

12 + three =