আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অলসতা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতিতে শরীয়তপুরের নড়িয়ায় বড় ধরনের বিপর্যয়

0
551

আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অলসতা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতিতে শরীয়তপুরের নড়িয়ায় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটেছে বলে মনে করেন পানিসম্পদমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। সমস্যার সমাধানে প্রকৃত প্রকল্প না নিয়ে রাজনৈতিক প্রকল্প হাতে নেওয়া ও বাস্তবায়নের ঝোঁককেও সমস্যার কারণ বলে মনে করেন তিনি। সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে এসব কথা জানান বর্ষিয়ান এ রাজনীতিক।

২০১৬ সাল থেকে পদ্মা নদীর ভাঙনে শরীয়তপুরে কমপক্ষে ২০ হাজার পরিবার গৃহহীন হয়েছে। বিলীন হয়েছে জনপদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার ও চিকিৎসা কেন্দ্র। পানিসম্পদমন্ত্রী মন্ত্রী বলেন, তিনটার মতো প্রকল্প কয়েক বছর আগে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্প তিনটা শেষও হয়েছে। তারপরও এটা ঠেকানো যায়নি। প্রকল্পের পরিচালকরা আছেন, প্রকৌশলীরা আছেন, তাদের জবাবদিহিতা করতে হবে। তারা কাজ করেননি। তিনি বলেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ভাঙনরোধে ৯০০ মিটার বাঁধের কাজ করেছে। পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে ২ কিলোমিটারের বাঁধের কাজ হয়েছে। এ প্রকল্পগুলো ২ বছর আগের। তার মানে কাজগুলো হয়নি, ঠিকমতো হয়নি কিছুই। পিডি আছে, প্রকৌশলী আছে, তারা কাজ করেননি, করেন না! আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, কেন কাজ করেননি, তা সবাই জানে। আমি প্রধানমন্ত্রীকে সব বলেছি। এগুলো সব রাজনৈতিক প্রকল্প। এখন প্রধানমন্ত্রী প্রকল্প নিয়েছেন। বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প আসছে। এবার কাজ হবে। স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বাঁধ দিয়ে, চর কেটে ভাঙন রোধ করা যাবে না। একপাশে ড্রেজিং করবেন, বাঁধ দেবেন, অন্য পাশে ভাঙবে। তাই আমরা আপাতত হাট-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জনবসতি, বাঁধ, পোল্ডার রক্ষা করব। ‘সি লেভেল উচুঁ হয়ে গেছে। রিভার বেড ভরাট হয়ে গেছে উজান থেকে আসা বালুতে। এখন বাঁধ উঁচু করতে হবে। নদীগুলোর ড্রেজিং করতে হবে। হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ লাগবে। পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা যেখান থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছে, সেখান থেকে দুই পাড় পাথর দিয়ে উঁচু করে বাঁধ দিতে হবে। স্থায়ী দেয়াল দিতে হবে। যেমনটা ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা দিয়েছে। এতে টাকার অপচয় হবে। দুর্নীতি হবে। তারপরও তা করতে হবে। তবেই সমাধান হবে বন্যা ও নদী ভাঙনের’, বলছিলেন পানিসম্পদমন্ত্রী। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য মতে, ভাঙনরোধে শরীয়তপুর জেলার জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলায় পদ্মা নদীর ডান তীর রক্ষা সুরেশ্বর খাল পুনঃখনন ও নিষ্কাশন পাইলট প্রকল্প নেওয়া হয় ১৯৯৯ সালে। যা কাগজে কলমে শেষ হয় ২০০১ সালে। এরপর প্রকল্প নেওয়া ২০১৬ সালে। যা শেষ হওয়ার কথা ছিলো ২০১৯ সালে। প্রকল্পের আওতায় ৮ দশমিক ৯০ কিলোমিটার নদী তীর সংরক্ষণ ও ৯ দশমিক ৯৭৫ কিলোমিটার ড্রেজিং কাজ সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর আওতাধীন প্রতিষ্ঠান খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড (খুশিলি) দিয়ে বাস্তবায়ন করবে। খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড ২৬ আগস্ট ২০১৮, দর প্রস্তাব দাখিল করে। দর প্রস্তাব পাওয়ার পর তা মূল্যায়ন/নেগোশিয়েট করে চূড়ান্ত দর প্রস্তাব সিসিজিপি-তে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। সিসিজিপিতে অনুমোদনের পর খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেডকে এনওএ দিয়ে চুক্তি সইয়ে কাজ শুরু করা হয়। আগামী নভেম্বর থেকে এ কাজ শুরু হওয়ার কথা। এ প্রকল্প শুরু করার কথা ছিলো ২০১৬ সালের ১ জুলাই। ৩০ জুন, ২০১৯ এ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিলো প্রকল্প প্রস্তাবনায়। চলতি বছরের ২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনীতি পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। ২৯ জানুয়ারি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রকল্পটির প্রশাসনিক অনুমোদন জারি করে। ১ হাজার ৭৭ কোটি ৫৮ লাখ ৪৯ হাজার টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে (১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮) অর্থনৈতিক ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। এরইমধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় বাড়ানো হয়েছে এক বছর। কেবল অনুমোদনেই ২ বছর গেলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়। ২০১৬ সালের ওই প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা হয়- কেবল ওই বছরই বর্ষা মৌসুমে নড়িয়া ও জাজিরা উপজেলায় ১৫টি গ্রাম সম্পূর্ণ, ১০টি গ্রাম আংশিকভাবে, ৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২টি উচ্চ বিদ্যালয়, ১টি মাদ্রাসা, ১০টি মসজিদ, হাট-বাজার, রাস্তাঘাট, ফসলি জমি, অন্যান্য ধর্মীয় উপানসালয়, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়। ওই বছর সরকারি হিসেবে (বেসরকারি হিসেবে আরো অনেক বেশি) ৪ হাজার পরিবার ঘরবাড়ি সহায় সম্বল হারিয়ে সম্পূর্ণ গৃহহীন হয়ে পড়ে। স্থানীয়দের মতে, ২০১৭ সালে জাজিরা, নড়িয়ায় পদ্মার ভাঙ্গনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২০১৬ সালকেও ছাড়িয়ে যায়। আর চলতি বছরে এখানে পদ্মার ভাঙন সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। এরইমধ্যে সরকারি হিসেবে গৃহহীন হয়েছে ৬ হাজারের বেশি পরিবার। বিলীন হয়েছে একের পর এক জনপদ। শত শত বছরের বাজার, ব্যবসাকেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসাকেন্দ্র হারানো মানুষের আর্তনাদে আর্দ্র হয়ে উঠেছে পদ্মার পাড়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়মতো প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হলে গত কয়েক বছরে অন্তত ২০ হাজার পরিবার বেঁচে যেতো সহায়-সম্বল হারানোর হাত থেকে। পানিসম্পদ মন্ত্রী বলছেন, এখন কাজ হবে। কারণ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার নিজেই দায়িত্ব নিয়েছেন। প্রকল্প গ্রহণ থেকে বাস্তবায়ন সবই তিনি দেখভাল করবেন। তবে যাদের অবহেলায় এই বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটছে, তাদেরও জবাদিহিতার মধ্যে আনা হবে। মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বুধবার পাস হওয়া হাজার কোটি টাকার বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাস্তবায়নাধীন ‘শরীয়তপুর জেলার জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলায় পদ্মা নদীর ডান তীর রক্ষা’ প্রকল্পের আওতায় ৮ দশমিক ৯০ কিলোমিটার নদী তীর সংরক্ষণ কাজ ৯ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার ড্রেজিং, শূন্য দশমিক শূন্য ৮৯ কিলোমিটার ইন্ড টার্মিনেশন এবং ৮টি আরসিসি পাকা ঘাট নির্মাণ কাজ সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে বাস্তবায়ন হবে। এক হাজার ৭৭ কোটি ৫৮ লাখ ৪৯ হাজার টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিডেট। ভাঙন থেকে রক্ষায় পূর্ব প্রস্তুতি না নেওয়ায় এবং ভাঙনের কারণে ওই এলাকার মানুষের দুর্ভোগের সময় পাশে না থাকায় সোমবারের মন্ত্রিসভার বৈঠকে মন্ত্রী-এমপিদের ভর্ৎসনা করেন। প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো এবং ভাঙনরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার নির্দেশ দেন। তার নির্দেশনাতেই দ্রুত এ প্রকল্পের জট খুলেছে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

20 + 18 =