কর্মবিরতির নামে দেশজুড়ে পরিবহন শ্রমিকদের নৈরাজ্য

0
531

মৌলভীবাজারের বড়লেখা সদরের অজমির গ্রামের দুবাইপ্রবাসী কুটন মিয়া গতকাল রবিবার সকাল ৭টার দিকে তাঁর সাত দিনের অসুস্থ শিশুকন্যাকে বড়লেখা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসেন। শিশুকন্যাটির অবস্থার অবনতি দেখে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন।

উদ্বিগ্ন বাবা দ্রুত একটি অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করে সিলেটের উদ্দেশে রওনা হন। তখন থেকে শুরু হয় এক নির্মম অধ্যায়। কুটন মিয়া জানান, পথিমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় ধর্মঘটি শ্রমিকরা অবরোধ করে তাঁদের অ্যাম্বুল্যান্স থামায়। প্রথমে বড়লেখা-চান্দগ্রাম সড়কের দাসের বাজার নামক স্থানে শ্রমিকরা তাঁদের অ্যাম্বুল্যান্সের গতিরোধ করে, গাড়ির চালককে মারধর করে এবং একজন শ্রমিক অ্যাম্বুল্যান্সের চালকের কাছে ৫০০ টাকা দাবি করে। কুটন মিয়া তাঁর মেয়ের শারীরিক অবস্থার কথা জানিয়ে অনুনয়-বিনয় করার পর কোনোক্রমে সেখান থেকে ছাড়া পান। কিন্তু চান্দ্রগ্রাম নামক স্থানে আবার অ্যাম্বুল্যান্সের গতিরোধ করা হয়। প্রায় দেড় ঘণ্টা সেখানে আটকে রাখা হয় অ্যাম্বুল্যান্স, চালকের ওপর দ্বিতীয় দফা মারধর চলে। অসহায় বাবার কোলে এ সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে তাঁর কন্যা। কুটন মিয়া জানান, তিনি বিশ্বাস করতে চাননি তাঁর মেয়ে চলে গেছে। দুপুর ২টার দিকে পার্শ্ববর্তী বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেয়েকে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তাঁর কন্যা বেঁচে নেই বলে জানান। সড়ক পরিবহন আইনের কিছু ধারা সংশোধন চেয়ে আট দফা দাবিতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন-শ্রমিক ফেডারেশন সারা দেশে তাদের ভাষায় ৪৮ ঘণ্টার কর্মবিরতি শুরু করেছে গতকাল রবিবার সকাল থেকে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, অন্য যারা গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিল তাদেরও বাধা দিয়েছে। তাদের বাধা থেকে রেহাই পায়নি অ্যাম্বুল্যান্সসহ ব্যক্তিগত গাড়ি, অটোরিকশাও। অনেক স্থানে তারা রাস্তায় নামা গাড়ির চালককে মারধর করেছে। অনেকের মুখে মাখিয়ে দিয়েছে পোড় মবিলের কালি। এ রকম অবস্থায় এক অমানবিক ও দুর্বিষহ সময় পার করেছে রাজধানীর মানুষসহ সারা দেশবাসী। ধর্মঘটি শ্রমিকদের কর্মকাণ্ডে কার্যত জিম্মি হয়ে পড়েছিল সারা দেশের মানুষ। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ সময়ে অসহায় যাত্রীদের পাশে এসে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। আজও রয়েছে শ্রমিকদের ডাকা এই আতঙ্কের ধর্মঘট।

রাজধানীর চিত্র

রাজধানীর শনির আখড়ার বাসিন্দা নাঈমুদ্দিন। তাঁর খালা সালমা বেগম বারডেম হাসপাতালে ভর্তি। তাঁকে সেবা করার জন্য যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু সকালে বাসা থেকে বেরিয়েই বেকায়দায় পড়েন তিনি। কোনো বাস না পেয়ে অবশেষে একটি ভ্যানগাড়িতে কয়েকজনের সঙ্গে চড়েন। যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত আসতেই তাঁকে গুনতে হয় ৩০ টাকা। যাত্রাবাড়ী মোড়ে এসে রিকশা খুঁজতে থাকেন। রিকশা ভাড়া চাওয়া হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। সকাল সাড়ে ১০টায় যাত্রাবাড়ী মোড়ে নাঈমুদ্দিন  বলেন, ‘হাসপাতালে খালাকে আমি দেখাশোনা করি। হাসপাতালে তিনি একা এখন। আমি জানতাম না যে আইজ বাস বন্ধ। এখন আইসা বাস না পাইয়া ঝামেলায় পইড়া গেছি। পকেটে বেশি টাকাও নাই। কী যে করুম।’ সকাল ৯টার পর যাত্রাবাড়ী সায়েদাবাদ এলাকা থেকে শত শত মানুষকে হেঁটে মতিঝিলের দিকে যেতে দেখা যায়। যাত্রাবাড়ী মোড়ে তাঁরা রিকশা, ভ্যান থেকে ধরে কোনো গাড়ি পাননি। পরিবহন শ্রমিকদের কর্মবিরতিতে সারা দেশের যাত্রীরা জিম্মি হয়ে পড়ে। রাজধানীতে গণপরিবহন বন্ধ থাকে। দূরপাল্লার যান চলাচলও বন্ধ থাকে। রাজধানীতে যাত্রীরা বাহন না পেয়ে হাঁটতে থাকে। অনেকে জরুরি যাত্রা বাতিল করতে বাধ্য হয়। বন্ধ হয়ে যায় তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্য পরিবহন। পরিবহন শ্রমিকরা বিভিন্ন স্থানে অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল, এমনকি প্রাইভেট কার চলতে বাধা দেয়। বাস না চলায় ট্রেনে ট্রেনে যাত্রীর বাড়তি চাপ ছিল। নৌপথেও ছিল যাত্রীদের প্রচণ্ড চাপ। সকাল ৮টার দিকে পোস্তগোলায় গিয়ে দেখা গেছে, কোনো বাস-ট্রাক চলছে না। পরিবহন শ্রমিকরা মোটরসাইকেলে দুজন যাত্রী থাকলে তাদের একজনকে নামিয়ে দিচ্ছে। জানতে চাইলে ট্রাক হেলপার শহীদুলবলেন, ‘আমরা আন্দোলন করতাছি। আমরা চাই সবাই আমাগো লগে যোগ দিক।’ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের পেট আছে। আমরা গাড়ি না চালাইলে উপাস থাকতে হইব। তাই যারা মোটরসাইকেল চালায়া যাইতাছে তাদের না চালানোর অনুরোধ করতাছি।’ এ সময় পোস্তগোলায় ব্রিজের ওপর ও এর নিচে বহু যাত্রীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তারা মাওয়া, নারায়ণগঞ্জ, গুলিস্তানসহ বিভিন্ন স্থানে বাসে যাওয়ার জন্য এসেছে। বাস দিয়ে মাওয়া যাওয়ার জন্য ১০ বছরের নাতি হানিফকে নিয়ে কদমতলী এলাকা থেকে পোস্তগোলা এসেছিলেন শেফালী বেগম। বাস না পেয়ে তিনি আফসোস করছিলেন। তিনি  জানান, মাওয়া না গিয়ে বাসায় ফিরে যাবেন। দুপুর ১২টায় চীন-মৈত্রী-১ সেতুর দুই পাশ দিয়ে বুড়িগঙ্গা সেতু পার হয়ে কেরানীগঞ্জ ও পোস্তগোলায় চলাচল করছিল মানুষজন। শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে সেতু পারাপারে সিএনজি সেবাও ছিল বন্ধ। ছোট-বড় কোনো বাহনও না চলায় অগত্যা হেঁটেই গন্তব্যে চলছিল সব বয়সী মানুষ। স্কুলফেরত শিশুরাও পেছনে ব্যাগ জুলিয়ে বাসায় ফিরছিল। দুপুর সোয়া ১২টায় মধ্যবয়সী তরুণরা সেতু আটকে রেখে কোনো গাড়ি প্রবেশ করতে দিচ্ছিল না। কেউ যেতে চাইলেও তর্ক-বিতর্কের পর পেছনে ফিরতে হয়েছে। শ্রমিকরা শরীরে টি-শার্ট ও জিন্স প্যান্ট, কেউ কেউ লুঙ্গি পরেও যোগ দেয়। জরুরি কাজে যেতে হবে বলতেই সেতুর প্রবেশপথে সড়ক অবরোধ করা শ্রমিকের বাজে মন্তব্য শুনলেন রাজধানী মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা হেলাল আহমেদ। আশপাশ থেকে ৮-১০ জন মধ্যবয়সী শ্রমিক গাড়ির চারপাশ ঘিরে ধরল। তিনি শ্রমিকদের বোঝাতে চেষ্টা করলেও কেউ শুনল না, গাড়ি যেতে দেবে না এমন কথা বারবার বলছে শ্রমিকরা। পেছনে না ফিরলে গাড়িতে ও মুখে পোড়া মবিল দেওয়ারও হুমকি দেয় কেউ কেউ। বাধ্য হয়ে পিছু হটলেন তিনি, রাস্তার পাশেই গাড়ি পার্কিং করলেন।  পরিচয় দেওয়ার পর তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা তিনি। জরুরি কাজে মাওয়া যেতে হবে। অবরোধ শুনলেও ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বের হতে হয়েছে। যেতে না দিলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। কিন্তু শ্রমিকরা কোনোমতেই বুঝছে না।’ ১০-১৫ মিনিট পর বৃষ্টি নামলে শ্রমিকরা রাস্তা ছেড়ে দেয়। আর তখনই তিনি গাড়ি চালিয়ে সেতু পার হন। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গাড়ি চলতে বাধা দেওয়ায় কেউ তর্ক করলে তাদের শ্রমিকদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে। সিএনজি থেকে অসুস্থ মানুষকেও তারা নামিয়ে দিয়েছে। অ্যাপভিত্তিক পাঠাও, উবার ও সহজ সার্ভিসের যাত্রীকেও নেমে যেতে বাধ্য করেছে শ্রমিকরা।গীত সংগীত সিনেমা হল থেকে ৫০ মিটার দক্ষিণে একটি ব্যারিকেড দেয় শ্রমিকরা। দুপুর ১টার দিকে সিএনজি করে আসছিলেন একজন নারী ও তাঁর সঙ্গে পঞ্চাশোর্ধ্ব পুরুষ যাত্রী। সেখানে সিএনজি থামিয়ে প্রথমে চালককে ধমকানোর  পর বাইরে টেনে নামানো হয়। পরে যাত্রীকেও বেরিয়ে যেতে বলে শ্রমিকরা। অসুস্থ পুরুষের সঙ্গে থাকা রাবেয়া নামতে অস্বীকার করলে সিএনজি ধরে ধাক্কাধাক্কি করতে থাকে তারা। বাধ্য হন দুজনেই নামতে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে রাবেয়া  বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর বাসায় ফিরছেন তাঁরা। এটা কোন ধরনের অবরোধ! একটা অসুস্থ মানুষকে যেতে দিচ্ছে না। এখন হেঁটে যাব কেমনে?’বেলা দেড়টায় পোস্তগোলার হানিফ ফ্লাইওভার থেকে নামার মুখে ২০-২৫ জন শ্রমিক দাঁড়িয়ে প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল ও সিএনজি ফিরিয়ে দিচ্ছে। একটা প্রাইভেট কারকেও যেতে দিচ্ছে না। পাঠাও সার্ভিস মোটরসাইকেলে যাত্রীকে নামতে বাধ্য করছে। নামতে না চাইলে কারো কারো ওপর চড়াও হচ্ছে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ধর্মঘট করার কারণ জিজ্ঞেস করলে ১২-১৪ বছর বয়সী এক কিশোর  বলে, ‘আমি কিছু জানি না। মালিকের গাড়ি চালাই, আজকে কাজে যেতে দেয়নি। রাস্তায় গিয়ে সবার সঙ্গে গাড়ি আটকাতে বলেছে।’ কী কারণে এমন নির্দেশ দিয়েছে জানতে চাইলে সে বলে, আইন-ফাইন নিয়ে নাকি ঝামেলা হয়েছে। সেটার জন্যই বলেছে।’

রিকশায় বাড়তি ভাড়া

অন্য কোনো বাহন না থাকায় বাড়তি ভাড়াতেও রিকশায় চলতে হয়েছে জনগণকে। কেউ কেউ বলেন, ২০ টাকার ভাড়া ১০০ দিয়েও যেতে হয়েছে। জুরাইন থেকে গুলিস্তান স্বাভাবিক সময়ে ভাড়া ৭০-৮০ টাকা, কিন্তু ১৫০-২০০ টাকার নিচে কেউ যেতে চায় না। বাধ্য হয়েই যেতে হয়েছে। রাজধানীর গাবতলী-ফার্মগেট এলাকাও ছিল গণপরিবহন শূন্য। সকাল থেকেই কোনো গণপরিবহন রাস্তায় নামেনি। ফলে এই এলাকায় পথচারীদেরও ভোগান্তি ছিল চরমে। পুরো রাস্তায় ছিল বেগতিক অবস্থায় পড়ে হেঁটে চলা মানুষের ঢল। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হয়েছে রোগী, নারী, শিশু, স্কুলগামী শিশু ও বয়স্ক মানুষ। তবে এই এলাকার রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেলের উপস্থিতি ছিল সারা দিন। সকাল সাড়ে ৮টায় গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনালে দেখা যায় হাজারো মানুষের ভিড়। তাদের বেশির ভাগই জানত না ধর্মঘটের কথা। ৭৩ বছরের আফছার আলী দিনাজপুর যাওয়ার জন্য সকাল ৬টায় গাবিতলী পৌঁছান। আট দিন আগে রাজধানীর কলাবাগানে ছেলের বাসায় এসেছিলেন। এখন তিনি গাবতলী থেকে ছেলের বাসায় ফিরতে পারছেন না আবার দিনাজপুরে যাওয়ারও কোনো ব্যবস্থা নেই। তিনি  বলেন, ‘আমি বয়স্ক অসুস্থ মানুষ। দীর্ঘদিন ডায়াবেটিসে ভুগছি। আড়াই ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি, কোনো গাড়ি পাচ্ছি না কলাবাগান যাওয়ার জন্য। হেঁটে যাওয়াও সম্ভব নয়। ছেলেকে ফোন দিয়েছি, ছেলেও একই সমস্যায় পড়েছে। সেও আমাকে নেওয়ার জন্য আসতে পারছে না।’গাবতলী বাস টার্মিনাল, শাহ আলীর মোড় ও টেকনিক্যাল মোড়ে কয়েক শ পরিবহন শ্রমিক ধর্মঘট পালনে সকাল থেকেই অবস্থান নেয়। সকালের দিকে রাস্তায় কোনো রকম মোটরচালিত যান চলাচল করতে দেয়নি। সকাল ৮টার পর থেকে মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলায় কোনো বাধা দেয়নি। টেকনিক্যাল মোড়ে অবস্থান নেওয়া গাড়িচালক মুহিবুর রহমান  বলেন, ‘আমাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে আমরা ধর্মঘট পালন করছি। আট দফা দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আমরা কাজে যোগ দেব না। অথবা নেতাদের পরবর্তী ঘোষণা ছাড়া কাজে যোগ দেব না।’ তবে আট দফা দাবির মধ্যে কী কী রয়েছে, এই প্রশ্নের জবাবে বেশির ভাগ শ্রমিক এক-দুটি দাবির কথা বলতে পারলেও পুরো দাবি বলতে পারেনি কেউ। হৃদরোগে আক্রান্ত দেড় বছরের শিশু নাইমকে নিয়ে বগুড়া থেকে কল্যাণপুরে এসেছেন মা-বাবা। সকালে পৌঁছার পর জানতে পারেন এই বেগতিক অবস্থার কথা। অসহায় মা-বাবা সন্তানকে নিয়ে অপেক্ষা করছেন কল্যাণপুরের টিআর পরিবহন কাউন্টারে। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অ্যাপয়েনমেন্ট আছে সকাল ১০টায়। তখন সকাল পৌনে ১০টা। কোনো সিএনজি বা পরিবহন পাচ্ছেন না রাজধানীর শান্তিনগর পৌঁছার  জন্য। এদিকে সন্তানের অবস্থাও বেশ গুরুতর। বাবা আহসান হাবীব  বলেন, ‘আজ ডাক্তার দেখাতে পারব কি না সন্দেহ আছে। আজ না পারলে আবার এক সপ্তাহ পর সিরিয়াল নিতে হবে। এদিকে বাচ্চার অবস্থা খুবই গুরুতর। বাচ্চার হার্টে ফুটো ধরা পড়েছে। দ্রুত চিকিৎসা না করাতে পারলে, বাচ্চার আশা ছেড়ে দিতে হবে।’ বিআরটিসির গাবতলী ডিপো থেকে বাস ছাড়লেও, সেগুলো রাস্তায় চলাচল করতে দেয়নি পরিবহন শ্রমিকরা। এই ডিপোর ব্যবস্থাপক মনিরুজ্জামান জানান, এখান থেকে বিভিন্ন রুটে কয়েকটি বাস ছাড়লেও বিভিন্ন জায়গায় সেগুলো আটকে দেয় পরিবহন শ্রমিকরা। এদিকে পরিবহন ধর্মঘটের সুযোগে লাগামহীন হয়ে উঠেছে রাজধানীর অ্যাপভিত্তিক পরিবহনগুলো। তারা নির্দিষ্ট ভাড়ার পরিবর্তে, অ্যাপ বাদ দিয়ে ইচ্ছামতো ভাড়া নিচ্ছে বলে অভিযোগ করছে ব্যবহারকারীরা। কল্যাণপুর থেকে মতিঝিলগামী ব্যাংক কর্মকর্তা সাঈদ আহমেদ  বলেন, ‘প্রায় এক ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি উবার ও পাঠাও এর একটি মোটরবাইকের জন্য। কোনো রাইডে সারা পাচ্ছি না। এর মধ্যে ছয়জন অ্যাপভিত্তিক মোটরবাইক সামনে এসে দাঁড়িয়ে ইচ্ছামতো ভাড়া চেয়েছে।

সারা দেশের চিত্র

মৌলভীবাজারের বড়লেখায় শিশুটির মৃত্যুর পর তার বাবা কুটন মিয়া বড়লেখা থানাকে বিষয়টি মৌখিকভাবে অবহিত করেন। তিনি এ নিয়ে পরে মামলা করবেন বলে জানান। ধর্মঘটিদের সঙ্গে গতকাল বড়লেখা কানলী ব্রিজ এলাকায় বরযাত্রীবাহী গাড়ির যাত্রীদের সঙ্গে সংঘর্ষও হয়। এতে উভয় পক্ষের ১০ জন আহত হয়। বড়লেখা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. জসিম উদ্দিন জানান, বড়লেখা কানলী ব্রিজে বরযাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় তিনি ঘটনাস্থলে রয়েছেন। তিনি সাত দিনের এক শিশুকন্যার মৃত্যুর ঘটনা শুনেছেন। এ ঘটনায় নিহতের পরিবার মামলা করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সাভার-আশুলিয়ার মহাসড়ক পরিস্থিতি

ঢাকা-আরিচা, নবীনগর-চন্দ্রা ও বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর মহাসড়কে কোনো যান চলাচল করতে দেখা যায়নি। দু-একটি যানবাহন চালানোর চেষ্টা হলেও বাধার মুখে পড়েন চালকরা। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে শুধু ব্যাটারিচালিত কিছু অটোরিকশা চলতে দেখা গেছে। গাড়ি না থাকায় যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়ে। বাড়তি ভাড়া আদায় করে অটোরিকশার চালকরা। সকালে কিছু লেগুনা এবং লোকাল বাস যাত্রীদের চাপে পড়ে চলাচলের চেষ্টা করলেও পরিবহন শ্রমিকরা সেগুলো চলাচলে বাধা দেয়। কিছু কিছু জায়গায় ভাঙচুরও করা হয় চলাচল করা পরিবহন। ঢাকা জেলা ট্রাফিক পুলিশের ইন্সপেক্টর আবুল হোসেন বলেন, সকালে কিছু অটোরিকশা এবং ইজি বাইক মহাসড়কে উঠে এলেও শ্রমিকরা সেগুলো চলাচল বন্ধ করে দেয়। তবে রোগী নিয়ে আসা ইজি বাইক ও অটোরিকশাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। শিমরাইল মোড়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবের গাড়ি বাধা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল মোড়সহ মহাসড়কের সাইনবোর্ড, সানারপাড়, সিদ্ধিরগঞ্জ পুল ও কাঁচপুর পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে শ্রমিকরা সব ধরনের পরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেয়। রিকশা, অটোরিকশা ও রোগীবাহী অ্যাম্বুল্যান্সও আটকে দেয় তারা। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শিমরাইল মোড় এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসানের গাড়ি আটকে দেয় পরিবহন শ্রমিকরা। প্রায় আধাঘণ্টা পর নারায়ণগঞ্জ ট্রাফিক পুলিশের টিআই (প্রশাসন) মোল্যা তাসলিম হোসেন শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর গাড়িটি ছাড় করাতে সক্ষম হন। শিমরাইল মোড়ে সকালে দেখা যায়, গাড়ির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে গার্মেন্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিসগামীসহ সাধারণ কয়েক হাজার মানুষ। কেউ কেউ কাভার্ড ভ্যান ও ভ্যানে চড়ে কর্মস্থলে যায়। গার্মেন্টকর্মী সাহেরা আক্তার বলেন, ‘গাড়ি না পেয়ে হেঁটেই কারখানায় যাচ্ছি।’ শনির আখড়া থেকে আসা মনির মিয়া নামের এক যাত্রী বলেন, ‘আমার এক আত্মীয় মদনপুর এলাকায় গতকাল রাতে মারা গেছেন। তাঁকে দেখতে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে শিমরাইল মোড়ে এসে আটকা পড়েছি। আত্মীয়র লাশ দেখতে পারব কি না, এ নিয়ে চিন্তায় আছি।’ যাত্রী শেফালী আক্তার বলেন, পরিবহন শ্রমিকদের এই কাজ আসলে অমানবিক।

বেনাপোলে বন্দরে পণ্য পরিবহনও বন্ধ

বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে কোনো পণ্য পরিবহন করতে পারছেন নাবন্দর ব্যবহারকারী সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা। পণ্য চালানের সরকারি শুল্ক পরিশোধ করার পরও ট্রাক ধর্মঘটে বন্দর থেকে খালাস নিতে পারছেন না তাঁরা। ফলে বন্দরে ভয়াবহ পণ্যজট দেখা দিয়েছে। বন্দরের অভ্যন্তরে পণ্য রাখার জায়গা খালি না হওয়ায় ভারত থেকে আমদানি করা পণ্য নিয়ে কয়েক শ ট্রাক বন্দর ও বন্দরের আশপাশের সড়কে দাঁড়িয়ে আছে পণ্য খালাসের অপেক্ষায়। পচনশীল পণ্য পরিবহন করতে কয়েকটি ট্রাক বন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেও তারা পণ্য লোড করতে সাহস পাচ্ছে না। এতে মাছ, পেঁয়াজ, পানপাতাসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে বিপাকে পড়েছে ব্যবসায়ীরা। বেনাপোল থেকে আন্ত জেলা, ঢাকাসহ দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। যাত্রীরা স্ট্যান্ডে এসে ফিরে যায়। যশোর-বেনাপোল সড়কের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে ধর্মঘটের সমর্থনকারী শ্রমিকরা গণপরিবহন চলাচলেও বাধা দিচ্ছে। ভারত থেকে আসা কয়েক শ মানুষ বাস না পেয়ে বিভিন্ন আবাসিক হোটেল এবং অনেকে বাস কাউন্টারেই অপেক্ষা করছে। যাত্রীরা অভিযোগ তুলেছে, জরুরি প্রয়োজনে যারা গন্তব্যে ফিরতে চাইছে তাদের কাছ থেকে তিন থেকে চার গুণ বেশি ভাড়া দাবি করছে প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসের চালকরা।

খুলনায় আন্দোলনে শিশুদের ব্যবহার

শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটে খুলনা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যমুখী যাত্রীরা যেমন বিড়ম্বনায় পড়েছে, তেমনি দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ভোরে খুলনার সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালসহ অন্যান্য স্থানে পরিবহন থেকে নেমে পড়তে হয়েছে ভোগান্তিতে। খুলনার মহেশ্বরপাশা এলাকায় আন্দোলনরত শ্রমিকরা শিশু-কিশোরদের নামিয়ে ইজিবাইক, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল চালকদের মুখে পোড়া মবিল মাখিয়ে দিয়েছে। অনেক গাড়ির কাচ ও চালকের পোশাকও নষ্ট করেছে। পোড়া মবিল দিয়ে লেপটে দেওয়া থেকে বাঁচতে অনেকে ধস্তাধস্তি করেও রক্ষা পায়নি। মহানগরীর সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালসহ শিববাড়ীর মোড় ও রয়্যাল মোড় থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস চলাচল করেনি। প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, পিকআপ, ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল ব্যবহার করে জরুরি প্রয়োজনে যাত্রীরা গন্তব্যে ছুটছে। এর জন্য গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা।

বাঘাবাড়িতে জ্বালানি তেল উত্তোলন হয়নি, অচল নৌবন্দরও

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর বাঘাবাড়ি নৌবন্দর থেকে সারসহ কোনো ধরনের পণ্যবাহী ট্রাক মালামাল নিয়ে দেশের কোথাও যেতে পারেনি। এ ছাড়া বাঘাবাড়ি অয়েল ডিপো থেকেও কোনো জ্বালানি তেল পরিবহন হয়নি। বাঘাবাড়ি বন্দর লেবার হ্যান্ডলিং এজেন্টের প্রতিনিধি আবুল হোসেন ও বাঘাবাড়ি ট্রাক বন্দোবস্ত এজেন্ট সূত্রে জানা গেছে, বাঘাবাড়ি নৌবন্দর থেকে প্রতিদিন সারসহ বিভিন্ন মালামাল নিয়ে শতাধিক ট্রাক উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে তা বন্ধ রয়েছে। শাহজাদপুরে মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে যন্ত্রচালিত কোনো যানবাহনই চলেনি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জে চরম দুর্ভোগ

সকাল থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাস টার্মিনালগুলো থেকে কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। ফলে দূরদূরান্ত থেকে আসা যাত্রীরা পড়েছে বিপাকে। সোনামসজিদ স্থলবন্দরে আটকে পড়েছে কাঁচাপণ্যসহ বিপুল পরিমাণ আমদানি পণ্য। জেলা সদর থেকে আন্তজেলা বা দূরপাল্লার কোনো রুটে বাস, ট্রাক, ট্যাংকলরি ও কাভার্ড ভ্যান ছেড়ে যায়নি। সোনামসজিদ স্থলবন্দর পরিচালনার দায়িত্বে থাকা পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেডের ডিপুটি ম্যানেজার মঈনুল ইসলাম জানান, পণ্য খালাসের কাজ যথারীতি চললেও পরিবহন ধর্মঘটের কারণে দেশের অভ্যন্তরে পণ্য পরিবহনের কাজ বন্ধ রয়েছে। এতে করে ৪৮ ট্রাক পিঁয়াজসহ প্রায় ৩০০ ট্রাক পণ্য বন্দরে আটকা পড়েছে।

ইবির ১৩টি পরীক্ষা স্থগিত

ধর্মঘটের কারণে স্থবির হয়ে পড়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও  প্রশাসনিক কার্যক্রম। স্থগিত করা হয়েছে বিভিন্ন বিভাগের মোট ১৩টি পরীক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ কে আজাদ লাভলু বলেন, ‘আমাদের ১৪টি কোর্স ফাইনাল এবং সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা ছিল। শুধু মার্কেটিং বিভাগে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাড়া করা কোনো গাড়ি ক্যাম্পাসে আসেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিবহন প্রশাসক অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের ইচ্ছা ছিল ক্যাম্পাস গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক রাখার। অল্পসংখ্যক বাসের জন্য মালিক সমিতির সঙ্গে কথা বললেও তারা দেয়নি।’ আমাদের সিলেট অফিস জানায়, গতকাল সকাল থেকে মহানগরের বিভিন্ন রাস্তায় মারমুখী অবস্থান নেয় পরিবহন শ্রমিকরা। যাত্রীদের গাড়ি থেকে জোর করে নামিয়ে দেওয়া, প্রতিবাদকারীদের হুমকি-ধমকি, হালকা যানবাহনের চালকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে দিন পার করেছে তারা। কুমিল্লার সড়কগুলোতে যানবাহন নামতে দেখলেই চালকদের কাছ থেকে চাবি কেড়ে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে চালকদের মুখে পোড়া মবিল লাগিয়ে দেয় শ্রমিকরা। ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী কিংবা রোগীরাও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। ঠাকুরগাঁওয়ে দুপুরে শহরের বিভিন্ন সড়কে রিকশা ও ভ্যানের চাকার হাওয়া ছেড়ে দেয় পরিবহন শ্রমিকরা। একই সঙ্গে চালকসহ যাত্রীদের শরীরে গাড়ির পোড়া মবিল মাখিয়ে দিয়ে উল্লাস করে। সদর হাসপাতালে আসা রোগীরাও তাদের রোষানলের শিকার হয়। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদীর পাঁচদোনা মোড়ে চালকদের মুখে কালি মেখে কান ধরে উঠবোস করায় পরিবহন শ্রমিকরা। একই সঙ্গে যাত্রীদের গাড়ি থেকে নামিয়ে নানাভাবে হেনস্তা করা হয়েছে। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে সকাল থেকেই বিভিন্ন স্থানে পিকেটিং করে আন্দোলনকারীরা। দুপুরে উপজেলার মিরপুরে বরযাত্রীবাহী একটি মাইক্রোবাসের চালককে মারধর করা হয়। বগুড়ার মহাসড়কে রিকশা, ভ্যান ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন দেখা যায়নি। মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে পরিবহন শ্রমিকরা লাঠি হাতে অবস্থান নেয়। এ সময় তাদের হাতে যাত্রী, চালকদের অনেকেই হেনস্তার শিকার হয়। রাজবাড়ী শহরের বড়পুল এলাকায় জোর করে যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে ঢাকা থেকে আসা হানিফ পরিবহনের একটি বাস আটকে রাখে পরিবহন শ্রমিকরা। এতে মর্জিনা বেগম নামের এক নারী তাঁর শিশু সন্তানকে নিয়ে চরম বিপাকে পড়েন। টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে সকাল থেকে বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নেয় শ্রমিকরা। রিকশা কিংবা সিএনজি দেখলেই তারা থামিয়ে দিয়ে যাত্রী ও চালকদের নানাভাবে হয়রানি করে।

 

 

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

10 − four =