হরলিক্স নিয়ে প্রতারণার শেষ নেই: ডিএসসিসি’র মামলায় আমদানিকারক আজিম উদ্দিন আহামেদ আদালতে

0
1308

মো: আহসানউল্লাহ হাসানঃ শিশু খাদ্য হিসেবে হরলিক্স আমাদের দেশের আপামর জনসাধারনের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হওয়ায় এই পন্যটির চাহিদা দীর্ঘকালে। চাহিদার কারনে দামের পরিমানটাও অনেক বেশী। আমাদের দেশে উৎপাদিত হরলিক্স পন্যটি ভেজালযুক্ত হওয়ায় বিদেশেী হরলিক্সের প্রতি চাহিদা অনেক বেশী। আর কারনে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে গুনগত মানহীন এই পন্যটি আমদানি করে লাগামহীন মুল্যে রাষ্ট্রীয় নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেদারছে খোলা বাজারে বিক্রি করে চলছে।

খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসটিআই কর্মকর্তারা অসাধু ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে অনৈতিকভাবে আর্থিক সুবিধা গ্রহন করে বছরের পর বছর নিরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। কিন্তু মাঝে মধ্যে কোন সচেতন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কারনে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। এবার হরলিক্সের ক্ষেত্রেও ঘটেছে ঠিক তাই। হরলিক্সের প্যাকেটের গায়ে লেখা উপাদান গুলোর সঠিক মানে আছে কিনা সন্দেহ হওয়ায় জণৈক ক্রেতা পন্যটি পরীক্ষার জন্য বিসিএসআইআর এর দাড়স্থ হন। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (এনালাইটিক্যাল সার্ভিস সেল) ড. হোসনে আরা বেগমের পর্যবেক্ষনে আসল রহস্য। তিনি বলেন, মাস দু’য়েক আগে জনৈক ব্যক্তি হরলিক্সের মান যাচাই করতে (স্বপ্রণোদিত) বিসিএসআইআর-এ আসেন। ওই পরীক্ষায় জানা গেছে, হরলিক্সের মোড়কে লেখা নানা উপাদানের কথাগুলো স্রেফ ছেলেভোলানো গল্প। এতেই নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই)। যার সুত্র ধরে ১৮ সেপ্টেম্বর-১৮ ইং তারিখে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রসিকিউটিং অফিসার কামরুল হাসান বাদী হয়ে গ্ল্যাক্সো স্মিথক্লাইনের (জিএসকে) পণ্য হরলিক্স বাংলাদেশে বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে অনুমোদন না থাকায় বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে মামলা করা করেন। একইসঙ্গে লেবেলিং নীতিমালা ভঙ্গ করে মিথ্যা বিজ্ঞাপন প্রচারের অভিযোগও আনা হয়েছে পণ্যটির প্রস্তুতকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনুমোদন ছাড়া গ্ল্যাক্সো স্মিথক্লাইনের (জিএসকে) পণ্য হরলিক্স বাংলাদেশে মোড়ক ও বাজারজাতকরণের দায়িত্বে নিয়োজিত মিউচ্যুয়াল ফুড লিমিটেডের চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন আহামেদকে বয়সের কথা বিবেচনায় এনে জামিন দিয়ে পরবরতী তারিখে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতের বিচারক ও স্পেশাল মেট্রপলিটান ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদি পাভেল সুইট। আদালত একই দিনে বিএসটিআই’এর একজন যোগ্য প্রতিনিধিকে আদালতে উপস্থিত থাকার জন্য নির্দেশ দেন।
মামলার বিবিরণে জানা যায়, গ্ল্যাক্সো স্মিথক্লাইনের (জিএসকে) পণ্য হরলিক্স বাংলাদেশে বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে অনুমোদন না থাকায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ রোববার বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে এসব অভিযোগে মামলা করে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। একইসঙ্গে লেবেলিং নীতিমালা ভঙ্গ করে মিথ্যা বিজ্ঞাপন প্রচারের অভিযোগও আনা হয়েছে পণ্যটির প্রস্তুকারক ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
মামলার বাদী কামরুল হাসান বলেন, মুড়ির মত পণ্যের অনুমোদন-মানের বিষয়েও দেখে বিএসটিআই। কিন্তু হরলিক্স প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে এত দিন ধরে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ছাড়া বাজারজাত করছে তা বোধগম্য নয়। তাদের পণ্যের মানের বিষয়ে কোনো জবাবদিহি নেই। খাদ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সহায়তায় আমরা এ ধরনের অপরাধীকে নিয়মিত বিচারের মুখোমুখি করতে বদ্ধপরিকর।
হরলিক্স প্যাকেটে দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম কখনও প্রস্তুতকারক, কখনও বাজারজাতকারী হিসেবে লেখা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ‘হরলিক্স ক্লাসিক মল্ট, মাদারস হরলিক্স বিশ্বের কোনো উন্নত দেশ কর্তৃক স্বীকৃত অথবা অনুমোদিত তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়া হরলিক্সের বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়েছে। এসবই ক্রেতা আকৃষ্ট করার মিথ্যা বিজ্ঞাপনী ভাষা। এসব মিথ্যা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ এবং মোড়কাবদ্ধ খাদ্য লেবেলিং প্রবিধানমালা ২০১৭ লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।’
হরলিক্সের প্যাকেটের গায়ে লেখা উপাদান গুলো শুধুই গল্পকথা
রাষ্ট্রীয় আইনানুযায়ী বাজারে যে কোনো ধরণের খাদ্যপণ্য কিংবা সম্পূরক খাদ্যপণ্য বিক্রি করতে হলে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশনের (বিএসটিআই) অনুমোদন নেয়ার তোয়াক্কাও করেনি হরলিক্স প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গ্লাসকো স্মিথক্লাইন (জিএসকে) এবং বাজারজাতকারী মিউচুয়াল ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড। আর আইন না মানার কারণে ঠকছেন পণ্যটির ক্রেতারাও।
২০১৩ সালের শিশুখাদ্য বিপণন নিয়ন্ত্রণ আইন ও ২০১৭ সালের মোড়কবদ্ধ খাদ্য লেবেলিং প্রবিধানমালার একাধিক ধারা লঙ্ঘন করে বাজারে এখনও দেদারসে বিক্রি হচ্ছে হরলিক্স। পণ্যটির বিক্রি বাড়াতে নানা সময়ে প্রচার করা হয়েছে মিথ্যা বিজ্ঞাপন। সম্প্রতি দেশের বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত হরলিক্সের লাগাম টেনে ধরতে পণ্যটির প্রস্তুতকারী ও বাজারজাতকারী দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে কর্তৃপক্ষ।
মামলার এজাহার অনুযায়ী, হরলিক্স বিশ্বের কোন উন্নত দেশ কর্তৃক স্বীকৃত? অথবা অনুমোদিত? তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়া হরলিক্সের বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়েছে।
উল্লেখিত মামলার বাদি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রসিকিউটিং অফিসার কামরুল হাসান জানান, হরলিক্স নিয়ে মারাত্মক অনিয়ম লক্ষ্য করা গেছে। হরলিক্স বাজারজাতকারীরা ২০১৩ সালের শিশুখাদ্য বিপণন নিয়ন্ত্রণ আইনের বেশ কয়েকটি ধারা সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে। পণ্যটি ২০১৭ সালের মোড়কবদ্ধ খাদ্য লেবেলিং প্রবিধানমালাও মানে নাই। এর মোড়কের কোনোটিতে প্রস্তুতকারী হিসেবে গ্লাসকো স্মিথক্লাইন (জিএসকে) আবার কোনোটির মোড়কে মিউচুয়াল ফুড প্রোডাক্টসের নাম পাওয়া গেছে। তাহলে প্রশ্ন হলো হরলিক্স তৈরি করছে কারা? একইসাথে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, সম্পূরক খাদ্যপণ্য হিসেবে এটি কতটা নিরাপদ? আর এটি নিয়ন্ত্রণের দায় কি সিটি করপোরেশনের নাকি অন্য কোনো সংস্থার?
তিনি বলেন, হরলিক্স বিপণনে ২০১৩ সালের শিশুখাদ্য বিপণন নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা ৩১, ৩২ (খ), ৪২ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে তদারকি সংস্থা কার্যকর না হলে সাধারণ ক্রেতারা ঠকবেন।
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (এনালাইটিক্যাল সার্ভিস সেল) ড. হোসনে আরা বেগম মাস দু’য়েক আগে জনৈক ব্যক্তি হরলিক্সের মান যাচাই করতে (স্বপ্রণোদিত) বিসিএসআইআর-এ আসেন। ওই পরীক্ষায় জানা গেছে, হরলিক্সের মোড়কে লেখা নানা উপাদানের কথাগুলো স্রেফ রূপকথার গল্প।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করা হলো বিসিএসআইআর’এর খাদ্য বিজ্ঞান প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড.বরুন কান্তি সাহার জানান, হরলিক্সের মোড়কে ডিএইচএ উপাদান থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গবেষণায় সে উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া যায় নাই।
হরলিক্সের বিজ্ঞাপন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিজ্ঞাপনগুলো ক্রেতা আকৃষ্ট করার মিথ্যা বিজ্ঞাপনী ভাষা। বিজ্ঞাপনগুলো দেখে আপনার মনে হতে পারে ভিটামিন এবং মিনারেল খুবই দুর্লভ বস্তু এবং আপনাকে এই ভিটামিন এবং মিনারেল বিশাল পরিমানে ফুড সাপ্লিমেন্ট (খাবারের সম্পূরক) আকারে নিতে হবে। তথ্য গুলো ভুল। আসলে ভিটামিন মিনারেল আমাদের চারপাশে নানান ধরণের প্রাকৃতিক খাবারে বিদ্যমান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিএইচএ একটি ওমেগা-৩ প্রাইমারি অ্যামিনো এসিড। এটি মানুষের মস্তিষ্ক, ত্বক এবং চোখের রেটিনা গঠনের অন্যতম উপাদান।
হরলিক্সের মতো সহস্রাধিক পণ্য মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে বিপণন চালাচ্ছে বলে দাবি করছে বিএসটিআই। সংস্থাটির উর্দ্ধতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসব পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিএসটিআই’য়ের কাছে নথি থাকলেও জনবল সংকটসহ নানা প্রতিকূলতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া আইনের ফাঁকফোকর তো রয়েছেই। যেমন হরলিক্সের মতো পণ্যগুলো হলো পরিপূরক খাদ্য (ফুড সাপ্লিমেন্ট)। বিএসটিআই এ ধরণের খাদ্যপণ্যের অনুমোদন দেয়না বলেই জানালেন ওই কর্মকর্তা।
বিএসটিআই’য়ের দায়সারা গোছের উত্তরে খুশি নন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষক প্রফেসর ড. খালেদা ইসলাম। এগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বাংলাদেশে একটি কার্যকর সংস্থা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন তিনি। উল্লেখ্য, চলতি মাসের ৩১/১০/২০১৮ তারিখ হরলিক্সের মামলাটির পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতের বিচারক মেহেদী পাভেল সুইটের আদালতে এ মামলা চলমান রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

three × two =