সারা দেশে মাদক ব্যবসায়ীদের এবার ‘আত্মসমর্পণ’কৌশল

0
724

অবি ডেস্কঃ আট মাস ধরে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চললেও ইয়াবা আসার সব পথই সচল আছে। সর্বশেষ গত রোববার কক্সবাজারের টেকনাফের সাবরাং থেকে ১ লাখ ২০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। আগের দিনও উদ্ধার হয়েছে ৪০ হাজার ইয়াবা বড়ি। এ অবস্থায় ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে মাদক ব্যবসায়ীরা এই ব্যবসা থেকে অর্জিত সম্পদের বৈধতা পেয়ে যাবেন কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে।

গত বছরের ৪ মে থেকে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানে শুধু কক্সবাজারেই কথিত বন্দুকযুদ্ধে ৩৭ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের ৩৪ জনই নিহত হয়েছেন টেকনাফে। তারপরও টেকনাফে ইয়াবা আসার পথ সচলই আছে। গত মাসে এবং চলতি জানুয়ারি মাসের ১৩ দিনে টেকনাফ থেকে বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর উদ্ধার করেছে ১৪ লাখ ইয়াবা বড়ি। এই পথ দিয়ে আসা ইয়াবা ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। বিজিবির টেকনাফের অধিনায়ক লে. কর্নেল আসাদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, মাদক ব্যবসায়ীরা নানা কৌশলে ইয়াবা নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। শুধু ডিসেম্বর মাসেই বিজিবি টেকনাফ সীমান্ত থেকে ৬ লাখ ৪৬ হাজার ২২১ ইয়াবা বড়িসহ ২৯ জনকে আটক করেছে।

মাদকবিরোধী অভিযানে অংশ নেওয়া বাহিনীর একাধিক পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, আট মাসের সাঁড়াশি অভিযানে তাঁরা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সরবরাহ লাইন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পেরেছেন। তবে ইয়াবা কেনাবেচা বন্ধ করা যায়নি। সীমান্তের ৬০টি স্থান দিয়ে ইয়াবা আসছে। গত বছর বিভিন্ন বাহিনী সাড়ে তিন কোটির বেশি ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করেছে। এ অবস্থায় ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের নানা দিক নিয়ে গভীরভাবে ভাবা হচ্ছে। খুব শিগগির আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। সারা দেশে বিভিন্ন বাহিনীর চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ী আছেন তিন হাজারের বেশি।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আগ্রহের কারণেই তাঁদের আত্মসমর্পণের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন যাঁরা আত্মসমর্পণ করতে চান, তাঁরা কী ধরনের অপরাধী, তার তালিকা তৈরি হচ্ছে। কী প্রক্রিয়ায় আত্মসমর্পণ করবে তা তালিকা হাতে পাওয়ার পরই বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।

তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, সরকার আগপাছ না ভেবেই মে মাসে ইয়াবাবিরোধী অভিযান শুরু করল। এখন আবার আত্মসমর্পণের সুযোগ দিচ্ছে। এতে আইনের চোখে সবাই আর সমান থাকল না। তিনি বলেন, শুরু থেকেই যদি মাদকের মামলা নিয়ে সরকার যত্নবান হতো, ঠিকভাবে তদন্ত করত, তাহলে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।

পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে তালিকাভুক্তদের পক্ষ থেকেই প্রথম আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব আসে। এরপর বিষয়টি পুলিশের পক্ষ থেকে সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানানো হয়। এতে সবুজ সংকেত পাওয়া গেছে। তবে কারা আত্মসমর্পণ করতে চান, সে তালিকা পুলিশের হাতে আসেনি। কতজন আত্মসমর্পণ করবেন তা এখনই বলতে পারেননি পুলিশ কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাসুদ হোসেন বলেন, এ নিয়ে চূড়ান্ত কিছু তিনি জানেন না। তবে আত্মসমর্পণ নিয়ে অনেকে কথা বলছেন। কক্সবাজারের বিতর্কিত সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদি গত শুক্রবার টেকনাফে নিজ বাসায় কর্মীদের উদ্দেশে এক বক্তৃতায় ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। র‍্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, এ ব্যাপারে তিনি কিছু জানেন না। তবে ইয়াবা কেনাবেচা বন্ধ করতে কক্সবাজারে নতুন একটি ব্যাটালিয়ন করবে র‍্যাব। ইয়াবার বিরুদ্ধে র‍্যাবের অভিযান অব্যাহত থাকবে।

তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো কর্মকর্তা বলছেন, এভাবে আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, বড় বড় ইয়াবা ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা নেই। এ কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হবে। আবার ইয়াবা ব্যবসা করে তাঁরা বিপুল পরিমাণ সম্পদ করেছেন। আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হলে তাঁদের সেই সম্পদ বৈধতা পাবে। এসব বিষয় পরিষ্কার না করে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না বলে তাঁরা অভিমত দেন।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মুহা. নুরুল হুদা এ বিষয়ে বলেন, ইয়াবা ব্যবসায়ীরা যদি অপরাধজগৎ ছেড়ে সুস্থ সমাজে ফিরে আসতে চান, তাহলে সেই সুযোগ দেওয়া উচিত। প্রতিবেশী দেশে এমন অনেক উদাহরণ আছে। অনেক অপরাধ আছে যা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, এসব ক্ষেত্রে এ ধরনের সুযোগ বেশ কাজে লাগে। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের মূল সুরও সেটাই।

মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা কত
পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে গত বছরের ১ থেকে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে গডফাদারদের তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল মদদদাতা, সাহায্যকারী ও অর্থলগ্নিকারীদের গ্রেপ্তার এবং যথাযথ তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত এবং মাদক থেকে অর্জিত অর্থ-সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা। এই তালিকার মধ্যে কক্সবাজার জেলাতেই মাদকের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি আছেন ১ হাজার ১৫১ জন। তাঁদের বিরুদ্ধে ৪৯৮টি মামলা রয়েছে। এই আসামিদের মধ্যে মাত্র ৮৬ জন এখন কারাগারে। আর গ্রেপ্তারের পর জামিন পেয়েছেন ২২২ জন। মাদক মামলার ৮৪৩ আসামিই পলাতক।

তালিকায় কক্সবাজারের টেকনাফ থানার আলিয়াবাদ গ্রামের মৃত এজাহার মিয়া কোম্পানির পাঁচ ছেলের নাম রয়েছে। তাঁদের এক ছেলে সাবেক সাংসদ বদি। তিনি ছাড়া আর কেউ এলাকায় নেই। তালিকার শুরুর দিকে থাকা অন্তত ২০ জন এলাকাছাড়া। দ্বিতীয় শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী সাইফুল করিম, আবদুর রহমান বদির বড় ভাই আবদুস শুক্কুর ও তাঁর বোনের দেবর ছৈয়দ হোসেন। তাঁরা বিদেশে আছেন বলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় রাজধানী ঢাকায় শীর্ষস্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৩৭। তাঁদের মধ্যে মো. নাদিম ওরফে পঁচিশ ও নজরুল ইসলাম ওরফে নজু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।

জেলা পুলিশের প্রতিবেদনে কক্সবাজারে ইয়াবার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বর্তমান ও সাবেক জনপ্রতিনিধি আছেন ৩৪ জন। তালিকায় ২৮ নারীর নামও উল্লেখ আছে। এর মধ্যে বদির বড় বোন এবং পুলিশের সাবেক এক পরিদর্শকের স্ত্রী শামসুন নাহারও আছেন। তাঁর ছেলে সাহেদুর রহমানও তালিকাভুক্ত। অভিযান শুরু হওয়ার পর তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন। গত বছরের ২৫ মে কক্সবাজারে বন্দুকযুদ্ধে নিহত সাবরাং ইউনিয়নের সদস্য আক্তার কামাল শামসুন নাহারের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। কামালের ছোট ভাই শাহেদ কামালও ইয়াবা ব্যবসায়ী। তাঁর বিরুদ্ধে মানব পাচারের মামলা আছে।

মাদক পরিস্থিতি
দেশের মাদক পরিস্থিতি বিশেষ করে ইয়াবার কেনাবেচা এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ইউএনওডিসির মতে, বাংলাদেশে উদ্ধার হওয়া মাদকের পরিসংখ্যান অনুসারে বছরে শুধু ইয়াবা বড়িই বিক্রি হয় ৪০ কোটির বেশি, যার বাজারমূল্য প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা (প্রতিটি দেড় শ টাকা হিসাবে)। ইয়াবা বড়ির পেছনে মাদকসেবীদের বছরে যে খরচ, তা বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির বার্ষিক বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ, আর পুলিশের বাজেটের প্রায় অর্ধেক। সরকারিভাবেই বলা হয়, দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা কমবেশি ৭০ লাখ।

ইয়াবার ভয়াবহতা দেশজুড়ে ছড়ালেও এত দিন তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগ খুব বেশি ছিল না। সর্বশেষ গত বছরের ৪ মে থেকে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করে বিভিন্ন বাহিনী। আট মাসের এই অভিযানে এ পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধে সারা দেশে ২৮৩ জন নিহত হয়েছেন। শুধু র‍্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৯৫।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. জামালউদ্দীন বলেন, এই অভিযানের সফলতা হলো, গডফাদারদের কেউ স্বস্তিতে নেই। আবার মাদকদ্রব্য কেনাবেচাও কমে গেছে। মাদক এখন আর সহজলভ্য নয়।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন মূলত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও মাদক আনা-নেওয়ার কাজে যুক্ত ব্যক্তিরা। তালিকাভুক্ত গডফাদারদের মধ্যে মাত্র একজন কারাগারে ও দুজন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। তবে এই অভিযান প্রশ্নের মুখে পড়ে গত বছরের ২৬ মে টেকনাফের কাউন্সিলর একরামুল হক হত্যার পর পরিবারের পক্ষ থেকে একটি অডিও প্রকাশের পর। একরামুল হকের স্ত্রী আয়েশা বেগম স্বামীর মৃত্যুর জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়ী করেন। পরে কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ঘটনাটি তদন্তের কথা বলা হলেও এখনো সেই তদন্ত প্রতিবেদনের কাজ শেষ হয়নি।

মাদকবিরোধী অভিযানে সম্পৃক্ত সূত্রগুলো বলছে, আট মাসের অভিযানের ফল হতাশাজনক। এর কারণ হিসেবে তারা বলছে, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সব বাহিনীর একযোগে কাজ করা এবং কাজের মূল্যায়ন হওয়ার কথা ছিল। সেটা হয়নি। দ্বিতীয়ত, গডফাদারদের প্রায় শতভাগকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, গডফাদারদের জিম্মায় ইয়াবা পাওয়া যাচ্ছে না বা তাঁরা সরাসরি ইয়াবা ব্যবসা করছেন এমনটাও প্রমাণ করা যাচ্ছে না। অথচ তাঁদের প্রত্যেকের অর্থবিত্তের উৎস খুঁজে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল। তৃতীয়ত, পুলিশ প্রায় তিন মাস নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত ছিল। ফলে ‘মাদক নির্মূল’ তাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় ছিল না। এখন মাদক ব্যবসায়ীরা সতর্ক হয়ে গেছে, তাদের আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক নেহাল করিম বলেন, ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া মানে ছেড়ে দেওয়া। যা হচ্ছে সব লোক দেখানো। দেশের সব মানুষ জানেন ইয়াবার সঙ্গে বদির পরিবারের সম্পৃক্ততা কী রকম। সরকারি সংস্থা এই তালিকা করেছে। অথচ এবারও বদির স্ত্রীকে মনোনয়ন দেওয়া হলো। তিনি মনে করেন, ইয়াবা বন্ধে আসলেই সরকারের সদিচ্ছা নেই। কারণ, কে ইয়াবা আনে, আর কে ভাগ পায়, তার সবই সরকার জানে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

13 + eighteen =