আরহাবের বাগধারা শেখা

1
1535

এম এ বার্ণিক: সেবার আরহাবের ‘ব্যাকরণ শিক্ষক’ ঘোষণা দিলেন যে, এবার ‘বাগধারা’ শেখার জন্যে আমরা শিক্ষা-সফর করবো। একদম হাতে কলমে শেখাবো যাতে করে কেউ বাগধারা প্রয়োগে ভুল না করে। অন্যান্যদের সাথে আরহাবও চাক্ষুশ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বাগধারা শেখার জন্য শিক্ষা-সফরে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিল। অবশ্য ব্যতিক্রমধর্মী এই শিক্ষা-সফরের খবরে অনেকে হাসাহাসি করলো। কিন্তু ব্যাপারটি যেহেতু ব্যাকরণ শেখার একটি ব্যবহারিক ক্লাস, সেহেতু সৈয়দ ওমর আজম তাঁর পুত্র আরহাবকে সফরে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।

 

নির্দিষ্ট দিনে শিক্ষা-সফর শুরু হলো। তিনটে দোতালা বাস সফরের বাহন। বাস দ্রুত গিয়ে পদ্মাপাড়ে দাঁড়ালো। এমন সময় এক মহিলা কাঁদো কাঁদোভাবে বাসবহরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো, “বাবারা, পদ্মানদী আমার সব কেঁড়ে নিয়েছে। একবার একূলের জমিতে নিজের বাড়ি করলাম, সেটা নদী ভেঙ্গে নিয়ে গেল। আবার ওকূলে বাড়ি তুললাম, আজ সেটাও শেষ। এখন আমি একূল ওকূল দুকূল হারা হতভাগিনী। তোমরা আমাকে সাহায্য কর।’’ অমনি ব্যাকরণের শিক্ষক বলে ওঠলো, বুঝেছো শিক্ষার্থীরা ‘একূল ওকূল দুকূল হারা’ মানে আশ্রয় হারিয়ে নিঃসম্বল হওয়া।

শিক্ষকের বক্তব্য শোনার পর আরহাব জানতে চাইলো যে, ‘কূল’ বানানটি যদি ‘উ-কার দিয়ে হয় অর্থাৎ ‘কুল’ হয়, তবে একুল ওকুল দুকুল হারা শীর্ষক বাগধারার কি অর্থ দাঁড়াবে। শিক্ষক জবাব দিলেন, “আরহাব, তুমি ঠিকই বলেছো। এর একটা ইতিহাস আছে। কৃষ্ণের প্রেমে মজে রাধা কুলত্যাগ (বংশত্যাগ) করেছিলো, পরে কৃষ্ণের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে রাধার দুকুল গেল। তাই এই বাগধারাটির অর্থ দাঁড়ায় সর্বদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত।’’ শিক্ষক প্রসঙ্গত, শ্যাম রাখা কি কুল রাখা শীর্ষক অপর একটি বাগধারা বর্ণনা করে বলেন, “শ্যামের সাথে অবৈধ প্রণয়ে সায় দিলে সতীত্বধর্ম ও কুল নষ্ট হয় আবার কুলধর্ম রক্ষা করতে গেলে শ্যামকে প্রত্যাখ্যান করতে হয়। রাধিকার মতো এমন অবস্থায় যারা পড়েন তাদের জন্য বাগধারাটির প্রায়োগিক অর্থ উভয়সংকট।”

এবার শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নিবেশ করে বলেন, “ওই দেখ, কতগুলো গড্ডলিকা বা ভেড়া লাইন ধরে হেঁটে যাচ্ছে। সামনেরটি সর্দার। পেছনের ভেড়াগুলো সর্দার বা সর্দারিনী ভেড়াকে অনুসরণ করে চলে। সর্দারিনী উঁচুতে উঠলে পেছনেরগুলোও উঁচুতে যায়, সর্দারিনী নিচুতে গেলে সবাই নিচে যায়, সর্দারিনী কাদায় গেলে সকলে কাদায় যায়। বাগধারায় এটাকে বলে ‘গড্ডলিকা প্রবাহ’, যার অর্থ হলো- ভালো-মন্দে বিচার-বিবেচনা না করে অন্যের অন্ধ অনুসরণ।’’

পদ্মানদীর পাড়ে এক খুপরি ঘরের কাছে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হলো। আরহাব দেখলো, খুপরি ঘরে একটা লোক শুয়ে আছে। লোকটার বেশ গোঁফ রয়েছে। সে খিদের জ্বালায় ছটফট করছে। শিক্ষক তার গোঁফের উপর একটা খেজুর রাখলেন, কিন্তু সে খাচ্ছে না। বরং বলছে, খিদে থাকলেও খেজুরটা হাতে ধরে মুখে দেয়ার মতো কষ্ট করতে আমার ভালো লাগে না। অগত্যা আরহাব এগিয়ে গিয়ে খেজুরটা গোঁপের উপর থেকে মুখে ঢুকিয়ে দিলো। এবার শিক্ষক বললেন, “এই হলো গোঁফ খেজুরে বাগধারার চরিত্র, যে নাকি আলসতার জন্য খেজুরটি গোঁফের উপর থেকে মুখে নিতে চায় না, অর্থাৎ নিতান্ত অলস।

শিক্ষার্থীদের পদ্মা নদীর চরে এক ধরনের বালি দেখিয়ে শিক্ষক বললেন, “এই বালি বাইরে থেকে শক্ত মনে হলেও তার উপর পা পড়লে নিচের তলতলে কাদার মধ্যে মানুষ বা জীবজন্তু তলিয়ে যায়। এ ধরনের বালিকে চোরাবালি বলা হয়। তাই বালির উপর চলার সময় সাবধানে চলতে হয়। চোরাবালি একটা বাগধারা, যার অর্থ হলো ‘শক্ত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত নয় এমন কাজ বা সংগঠন। আরহাব, তুমি চোরাবালি দিয়ে একটি বাক্য বল?” আরহাব বললো, “চোরাবালির কোয়ালিশন সরকার বেশিদিন স্থায়ী হবে বলে মনে হয় না।” শিক্ষক বললেন, “ঠিক আছে। তবে চোরাবালির আরো একটি অর্থ আছে এবং সেটি হলো ‘অভাবিত গোপন বিপদ’। আরহাব সেই অর্থ প্রয়োগ করে আরেকটি বাক্য বললো, “শেয়ার বাজারের চোরাবালিতে পা দিয়ে লোকটা বিরাট লোকসান দিয়েছে।”

পরিব্রাজক দল জানতে পারলো যে, অনতিদূরে একজন বড়লোক শখের বশবর্তী হয়ে ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাত খাওয়ার প্রয়োজনে নিজ বাড়িতে ঢেঁকিশাল স্থাপন করেছে। তারা সেটি দেখার জন্য সেখানে গেল। শিক্ষক বললেন, “ঁেঢকির নিজের কোন বুদ্ধি নেই, অন্যের পায়ের লাথি খেয়ে কার্যক্ষম থাকে। সে কারণে বাংলা ভাষায় বুদ্ধির ঢেঁকি নামে একটা বাগধারার প্রচলন হয়েছে, যার অর্থ হলো ‘অতিশয় নির্বোধ’। এই ঢেঁকি যদি আমড়া গাছ দিয়ে তৈরি করা হয় , তখন তা দিয়ে ধান ভানা সম্ভব নয়, কারণ আমড়া কাঠ টেকসই নয়। সে কারণে বাংলাভাষায় আমড়া কাঠের ঢেঁকি নামে অন্য একটি বাগধারার সৃষ্টি হয়েছে, যার অর্থ অকেজো লোক।

আরহাব জানতে চাইলো, “ঢেঁকি দিয়ে কি আর কোনো কাজ হয় না?” শিক্ষক বললেন, “না, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে।” আরহাব বললো, “বুঝলাম না।” শিক্ষক বললেন, “যার যা স্বভাব তা মরলেও সে ছাড়তে পারে না। হ্যাঁ, অনুরোধে ঢেঁকি গেলা বলেও একটি বাগধারা আছে, যার অর্থ হলো – অসম্ভব কর্ম।”

ঢাকা থেকে শিক্ষার্থীদের আগমন বার্তা শুনে কিছু সংখ্যক পথশিশু তাদের সামনে এলো। শিক্ষক এদের দেখেই বলে উঠলেন, “দেখ, দেখ, এই ছেলে-মেয়েরা ক-অক্ষর গোমাংশ।” আরহাব বললো, “ক অক্ষর কিভাবে গোমাংশ হয়?” শিক্ষক বললেন, “গোমাংশ যেমন হিন্দুর নিকট সর্বদা পরিত্যাজ্য, সেরূপ বিদ্যাশিক্ষাকেও যে এড়িয়ে চলে তাকে বোঝাবার জন্য ক অক্ষর গোমাংশ বাগধারাটি ব্যবহৃত হয়। আরহাব বললো, “গো-মাংস তো হিন্দুদের খেতে দেয়া অপরাধ। তাই বলে পথশিশুদের শিক্ষার আলো দেয়াও কি সেরকম অপরাধ?” শিক্ষক বললেন, “না, শিক্ষা সকলের মৌলিক অধিকার। তাদেরকে শিক্ষার আলো না দিতে পারাটাই আমাদের অপরাধ। এক্ষেত্রে বাগধারার অর্থ প্রযোজ্য হবে না।

গাড়ির বহর তীর্থের কাক বাগধারার অর্থ শেখার জন্য গয়াভিমুখে রওয়ানা হলো। সেখানে গিয়ে দেখে হাজার হাজার কাক স্থানে স্থানে বসে আছে। তীর্থ যাত্রীরা কখন নৈবেদ্যাদি ছড়াবে তার জন্য কাকদের অপেক্ষা। অনেক কাক না খেয়ে অলসভাবে দু’একদিন অপেক্ষা করছে। শিক্ষক আরহাবদের লক্ষ্য করে বললেন, “এ কাকগুলো পরানুগ্রহপ্রত্যাশী লোভী। এরা নিজেরা কাজ করে খাবে না, কেবল পরেরটা খাওয়ার অপেক্ষা করছে। তাই ‘তীর্থের কাক’ বাগধারার অর্থ হবে ‘পরানুগ্রহপ্রত্যাশী লোভী ব্যক্তি’।

গয়াতে গোবরের তৈরি একটা গণেশমূর্তি রয়েছে। আরহাব সেটা দেখে শিক্ষককে জিজ্ঞেস করলো, “এটা কি?” শিক্ষক বললেন, “গোবর গণেশ। আমাদের সমাজে অকর্মণ্য ব্যক্তিত্বশূন্য ও বুদ্ধিহীন ব্যক্তিদের দেখলে মানুষ এ মূর্তির সাথে তুলনা করে গোবর গণেশ বলে”।

গয়া থেকে ফেরার সময় বাসে ওঠতে গিয়ে আরহাব পা কেটে ফেলে। শিক্ষক তার কাটা জায়গাটিতে একটু নুন (লবন) ছিটিয়ে দিলেন। আরহাব ‘উ’ করে কষ্ট প্রকাশ করলো। শিক্ষক বললেন, “কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়া মানে কষ্টের উপর কষ্ট দেয়ার মতো অবস্থা দেখলে এই বাগধারাটি ব্যবহার করবে।”

গাড়ির বহর চলছে। পাশাপাশি একটা চিনি বোঝাই গাড়ি বলদ গরু টেনে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা গেল। শিক্ষক বলেলেন, “দেখ, দেখ, বলদ মহাজনের চিনি বহন করছে, অথচ চিনির স্বাদ আস্বাদনে করতে পারছে না। যারা পরের ভার বয়, কিন্তু ফলভোগের মালিক নয়, তাদের বোঝাবার জন্য আমরা চিনির বলদ বাগধারাটি ব্যবহার করি।

অমনি আরহাব বলে উঠলো, “স্যার, তা হলে কলুর বলদ কি?” শিক্ষক বললেন, “চল আমরা দেখে আসি।” তারা পাশের গ্রামে ঢুকলেন। সেখানে কাঠের কল বা ঘানির সাহায্যে তৈলবীজ ভাঙ্গানো হয়। কাঠের কল বা ঘানিকে কলু বলা হয়। একব্যক্তি কলটি ঘুরাচ্ছেন বা ঘানি টানছেন। শিক্ষক বললেন, “লোকটি সত্যিকারের বলদ নয়, একসময় বলদ দিয়েই ঘানি টানা হতো, এখন তা মানুষ দিয়েই করা হয়, তবে মানুষটি পুরোপুরি পরাধীন। অন্যের ইচ্ছানুযায়ী অমানুষিক পরিশ্রম করাই তার কাজ। এমন কাজ যারা করেন, তাদেরকে বোঝাবার জন্য ‘কলুর বলদ’ বাগধারাটি ব্যবহৃত হয়।

এখান থেকে ফেরার পথে আরহাব লক্ষ্য করলো, একটা লোক অন্য আরেকটা লোককে মইয়ের সাহায্যে গাছে উঠতে সাহায্য করছে। লোকটি গাছে ওঠা মাত্রই অন্য লোকটি মইটি সরিয়ে ফেললো। এতে নিরুপায় লোকটি গাছে বসেই উচ্চবাচ্য করছে। শিক্ষা-সফরের সকলেই ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করলো। এবার শিক্ষক বললেন, “দেখ, গাছে তুলে মই কাড়া শীর্ষক একটি বাগধারা রয়েছে। অনেক লোক রয়েছে যারা কোন মানুষকে সাহায্যের ছলে অনুরূপভাবে কোথাও পৌছে দিয়ে নিজে বাহনসহ কেটে পড়ে, এটাকেই বলে ‘গাছে তুলে মই কাড়া’, যার অর্থ হলো- অন্যকে কাজে নামিয়ে বিপদে ফেলে চলে আসা।”

পরিভ্রমণকারী দলের শিক্ষার্থীরা জানতে পারলো যে, লোকটি গাছে ওঠার আগেই গোঁফে তেল মাখছিলো। কারণ গাছে ওঠে সে কাঁঠাল খাওয়ার সময় যাতে গোঁফে কাঁঠালের কশ না লাগে। এতে মই বহনকারী লোকটি ভেবেছে, ‘ও আমাকে না দিয়েই খেয়ে ফেলবে, তবে মই কেড়ে নিয়ে ওকে মজা দেখাই! এটাই গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল বাগধারাটির মর্মার্থ। তবে এক্ষেত্রে গাছে না উঠতেই এক কাঁদি বলে আর একটি বিষয়ও রয়েছে। লোকটি গাছে ওঠার আগেই এক কাঁদি (কাঁধে যতটুক বহন করতে পারে ততটুকু) ফল নিয়ে যাওয়ার বায়না ধরেছিলো। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সঙ্গের লোকটি মইটি কেড়ে নেয়। তাই আমরা ‘গাছে না উঠতেই এক কাঁদি’ বাগধারাটি ‘কাজ শুরু করার আগেই ফলভোগের হাস্যকর প্রত্যাশা’ বোঝাবার জন্য ব্যবহার করে থাকি।

শিক্ষকের কাছ থেকে প্র্যাকটিক্যালভাবে বাগধারার জ্ঞান অর্জনের পর আরহাব প্রশ্ন রাখলো, “কাজ শুরু করার পূর্বে কেউ ‘গাছে না উঠতেই এক কাঁদি’র দাবি কিংবা ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল’ মাখতেই পারে, সেটা হাস্যকর হলেও অপরাধ নয়; কিন্তু ‘গাছে তুলে মই কেড়ে নেয়া’টা অপরাধ বটে।” এবার শিক্ষক বলে ওঠলেন, “শাবাশ, আরহাব শাবাশ! আমাদের শিক্ষা-সফর সফল হয়েছে। তুমি যে জবাব দিয়েছো তা যথার্থ।”

এক পর্যায়ে শিক্ষক তার সফরসঙ্গী শিক্ষার্থীদের অনতিদূরে জলাশয়ের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একটি সাদা বক দেখিয়ে বললেন, “দেখ, দেখ, একটি বক মাছ শিকারের জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখলে মনে হয়, সাদা পোশাকধারী কোন ঋষি যেনো ধ্যান করছে। মাছেরাও তাই ভাবে এবং দলে দলে কাছে ভিড়ে। অমনি বকটি খপ করে মাছকে ধরে গপগপ করে গিলে ফেলে।” আরহাব বললো, “বুঝলাম, তবে এটা থেকে আমরা কি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।” শিক্ষক বললেন, “পৃথিবীতে কিছু লোক ধার্মিক বেশে মানুষের কাছে যায় এবং তার ক্ষতি সাধন করে, যা দেখলে ওই বকটির মতোই মনে হবে, এদেরকে বক ধার্মিক আখ্যায়িত করে একটি বাগধারার সৃষ্টি হয়েছে, যার অর্থ হলো ভন্ড।”

শিক্ষক ইশারা দিয়ে আরহাবকে একটা বিড়াল দেখিয়ে বললেন, “ওই যে, বাগানের পাশে গর্তের কাছে একটা বিড়াল বাসা আছে, সেটিও দেখতে মনে হয় যেনো এক তপস্বী ধ্যান করছে। আসলে সে ইঁদুর ধরার জন্য ভান করে বসে আছে। দুষ্ট মানুষ যখন সাধুর বেশে ভন্ডামি করে তখন সেই মানুষকে বিড়াল তপস্বী বলা হয়।

ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশ দিয়ে ফেরার পথে শিক্ষক তার সফরসঙ্গী ছাত্রছাত্রীদের লক্ষ্য করে বললেন, “এই মাঠে একসময় ঘোড়দৌড় নিয়ে জুয়া বা বাজি খেলার বাতিক ছিলো, গরিব লোকও বেশি টাকা উপার্জনের আকাংক্ষায় এই খেলায় অংশগ্রহণ করতে। কালে এটাকে বলা হতো গরিবের ঘোড়ারোগ। এটি এখন বহুল প্রচলিত বাগধারা।

গাড়িবহর যখন টিএসসি মোড়ে পৌঁছতে শুরু করলো, তখন হঠাৎ করেই গোলাগুলির আওয়াজ শোনা গেল। গুড়–ম গুড়–ম শব্দে শিক্ষাথীরা মুহূর্তের মধ্যে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর গোলাগুলি থামলো। তখন শিক্ষক বললেন, “দেখ, একটু আগে আমরা গুড়–ম গুড়–ম শব্দে আক্কেল হারা হয়ে পড়েছিলাম। মানুষ যখন কোন পরিস্থিতির কারণে আতংকে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে, তখন তাকে বলে আক্কেল গুড়–ম।” এমন সময় আরহাব এ বাগধারাটি প্রয়োগ করে বাক্য আওড়ালো, “টিএসসি’র পরিস্থিতিতে আমরা আক্কেল গুড়–ম হয়ে পড়ি। কিন্তু ওই সময় ছুটোছুটির মধ্যে আমার মানিব্যাগটা হারিয়ে যায়।’’ এবার শিক্ষক বললেন, “এটাই তোমার আক্কেল সেলামি।’’ আরহাব বললো, “বুঝলাম না।’’ শিক্ষক বললেন, “তুমি আক্কেল খাটিয়ে নিজের অর্থ সামলাতে না পেরে যে খেসারত দিয়েছো, এমন কাজকে বোঝাবার জন্য ‘আক্কেল সেলামি’ বাগধারাটি ব্যবহৃত হয়।’’

আরহাব বললো, “আমি যদি একটু ভান করতাম, তাহলে চোরটা ধরে ফেলতে পারতাম।’’ শিক্ষক বললেন, “চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।’ এটা একটা বাগধারা, যার অর্থ – সুযোগ হাতছাড়া হলে মাথায় নানা ফন্দি ফিকির আসে।’’ আরহাব বললো, “আমার একজনকে সন্দেহ হয়। তাকে একটু অনুরোধ করে মানিব্যাগটা উদ্ধার করার চেষ্টা করতে চাই।’’ শিক্ষক বললেন, “চেষ্টা করতে দোষ নেই।’’

আরহাব সন্দেহভাজন লোকটার কাছে গেল। একপর্যায়ে আরহাব তাকে ধর্মীয় উপদেশ দিয়ে ব্যাগটা ফেরত চাইল। লোকটা স্বীকার করলো, কিন্তু মানিব্যাগটা তাকে দেখিয়েও ফেরত দিতে রাজি হয় না। ব্যাপারটা দেখে শিক্ষক বললেন, “চোর না শুনে ধর্মের কাহিনী। এটাও একটা বাগধারা, যার অর্থ অসতকে সৎপথে আনার সদুপদেশ দেয়া বৃথা। আরহাব ও শিক্ষকের কথা শুনে পাশে বসা আরেক চোর মানিব্যাগ চুরি করা চোরটাকে চোর না বলে ঠাট্টাচ্ছলে বললো, “আরে, আমার ভাইটা তো তোমার সাথে দুষ্টুমি করে মানিব্যাগটা নিয়েছে। এটা চুরি হলো নাকি?” অমনি শিক্ষক বলে ওঠলেন, “চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। এটাও একটা বাগধারা, যার অর্থ হলো- চোর বা অনুরূপ অন্যায়কারী পরস্পর বন্ধুভাবসম্পন্ন। তবে চোরা বেটারা এখন যা বলছে সেটা হলো, চোরের মার বড় গলা, যার অর্থ হলো- পৃথিবীতে যত অসৎ মানুষ আছে, সবাই সাধুতার ভান করতে পটু অথবা অপরাধীদের উপর তম্বি করে।”

হঠাৎ করে দেখা গেল যে, চোরা বেটার কাছ থেকে মানিব্যাগটা আর একজন ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে শিক্ষক বলে ওঠলেন, “এরই নাম চোরের উপর বাটপাড়ি। এটা আরেকটা বাগধারা, যার অর্থ হলো অন্যায়করীকে টেক্কা দিয়ে চুরি করা দ্রব্যাদি আত্মসাৎ।”

সফর শেষে শিক্ষক বললেন, “বাগধারার ব্যাপারে এতোদিন তোমরা ‘অন্ধকারে থাকা’র (অজ্ঞাত থাকা) বিষয়টি আমি জানতাম। তাই প্রত্যেককে এ বিষয়ে হাতে কলমে (প্রত্যক্ষভাবে) শিক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে আমাদের এই শিক্ষা সফরের আয়োজন। আমরা বিষয়ের গভীরতায় যাওয়ার চেষ্টা করেছি। আশা করা যায়, আমরা লক্ষ্যে পৌছতে সক্ষম হয়েছি। কাল পরীক্ষা নেব। এখানেই সফরের যবনিকা পাত (পর্দা পতন অর্থাৎ সমাপ্তি) ঘোষণা করছি।

আরহাব বললো, “বিদায়, বন্ধুরা আজকের মতো বিদায়। দায় কিন্তু রয়ে গেলো। কেননা, কাল বাগধারার পরীক্ষা।”

[লেখক: এম এ বার্ণিক, সভাপতি, ইতিহাস গবেষণা সংসদ]

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

11 + two =