নারীদের দিয়ে বিত্তশালীদের ফাঁদে ফেলে একটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছিল লাখ লাখ টাকা

0
1066

ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপ, ইমোসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নারীদের দিয়ে বিত্তশালীদের ফাঁদে ফেলে একটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছিল লাখ লাখ টাকা।

 

গত পাঁচ বছরে ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবীসহ অর্ধশত ব্যক্তিকে অপহরণ, জিম্মি করে এমন কাজ করে যাচ্ছিল চক্রটি। সামাজিক অবস্থানের কারণে ভুক্তভোগিরা বিষয়টি গোপন রাখায় এতদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল এ প্রতারক চক্র। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। চক্রের ৫ সদস্যকে আটক করার পর বেরিয়ে আসে এসব তথ্য। গতকাল দুপুরে নগরীর মোমিন রোডে নগর পুলিশের দক্ষিণ জোনের উপ কমিশনার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ধৃত চক্রটির অপরাধ সর্ম্পকে এসব তথ্য জানানো হয়। পুলিশ জানিয়েছে, চক্রটির নারী সদস্যরা প্রথমে ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপ, ইমোসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিত্তশালীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন, পরে সাজানো-গোছানো ভাড়া বাসায় নিমন্ত্রণ দেন। এই ফাঁদে পা ফেলে কেউ যোগাযোগ করতে গেলে তাকে জোরপূর্বক ওই নারীর সাথে আপত্তিকর অবস্থায় কিংবা ইয়াবাসহ ছবি তুলে থাকে। পরে তা দিয়ে বিত্তশালীদের কাছ থেকে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়ে থাকে। আবার পুলিশ কিংবা সাংবাদিক পরিচয়েও অনেক সময় তাদের তুলে নিয়ে এ ধরণের প্রতারণা করছে। এভাবে চক্রটি অন্তত অর্ধশত বিত্তশালীর কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। গত পাঁচ বছর ধরে নীরবে চক্রটি এমন অপরাধ কর্মকাণ্ড করে বেড়ালেও চক্ষু লজ্জার ভয়ে ভুক্তভোগীরা এ ব্যাপারে কোন আইনি সহায়তায় নেননি। তবে ইমরান নামে কোতোয়ালী থানাধীন নুপুর মার্কেটের এক ব্যবসায়ী তার সাথে ঘটে যাওয়া প্রতারণার ব্যাপারে পুলিশের কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। ওই অভিযোগের প্রেক্ষিতে পরে চক্রটির সন্ধান পেয়ে অভিযান চালিয়ে হোতাসহ পাঁচজনকে আটক করা হয়। আটককৃতরা হলেন, নোয়াখালী জেলার হাতিয়া পৌরসভার রফিকুল মাওলার ছেলে দিদারুল ইসলাম দিদার (৩৫), কঙবাজার জেলার কুতুবদিয়া উপজেলার পেয়ারাকাটা গ্রামের মৃত আলী হোছেনের মেয়ে বিথি মাহমুদ মোস্তাফা সিফা (২৩), ফেনীর সোনাগাজীর চরলক্ষীগঞ্জ গ্রামের মৃত জহিরুল ইসলামের মেয়ে ফাতেমা ইয়াছমিন নিশি (২৮), বায়েজিদ থানাধীন শান্তিনগর এলাকার মৃত ফটিক মিয়ার ছেলে আনোয়ার হোসেন আনু (৪৪) এবং ফেনী সদরের পাঁচগাছিয়া গ্রামের জসিম উদ্দিনের ছেলে রাকিব আল ইমরান (২৬)। এ ঘটনায় চক্রটির পলাতক আরেকজন হলেন, নোয়াখালী জেলার হাতিয়ার বাসিন্দা হাবিবুর রহমানের ছেলে কামরুল হাসান (৩০)। কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি টিম নগরীর পাঁচলাইশ, চশমা হিলসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে তাদের আটক করে। এ সময় আটকৃতদের কাছ থেকে ৭টি মোবাইল সেট জব্দ করা হয়। নগর পুলিশের উপ কমিশনার মেহেদী হাসান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আসামীরা একটি অপহরণকারী সংঘবদ্ধ চক্র। চক্রটি বিগত ৫ বছর ধরে মহানগরী এলাকায় বিভিন্ন বিত্তশালী ব্যবসায়ী লোকদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে। এ ধরণের ৪০/৫০টি’র মতো অপরাধের সাথে জড়িত বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে বলে জানান উপ কমিশনার। আত্মসম্মানের ভয়ে এ অপরাধের ঘটনাগুলোর ভুক্তভোগীরা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবগত করা থেকে বিরত থাকে বলে জানান তিনি। মেহেদী হাসান বলেন, এরা স্বামী-স্ত্রী’র পরিচয় দিয়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। এসব ভাড়া বাসায় কোনোটিতে তারা ২/৩ মাসের বেশি থাকে না। এদের বাসাগুলোতে সামনের অংশে হালাকা আসবাব দিয়ে সুন্দরভাবে সজ্জিত রাখা থাকে। উপ কমিশনার বলেন, চক্রটির পুরুষ সদস্যরা বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বিত্তশালী লোক, ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবী লোকদের টার্গেট করে তাদের মোবাইল নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। মহিলা সদস্যরা ওইসব মোবাইল নাম্বারে ইমো, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যোগাযোগ করে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার পাশাপাশি টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের ব্যাপারে আরও তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করে থাকে। নারী সদস্যদের দেওয়া তথ্যমতে টার্গেটকৃত ব্যক্তির গতিবিধি লক্ষ্য করে সুবিধাজনক জায়গা থেকে নিজেদের পুলিশ কিংবা সাংবাদিক পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। পরে ভাড়া বাসায় নিয়ে নারী সদস্যের সাথে অপহৃত ব্যক্তির অশ্লীল ছবি ধারণ করে। এসব আপত্তিকর ছবি দিয়ে পরে প্রতারণার মাধ্যমে অপহৃত ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেন। মেহেদী হাসান বলেন, চক্রটি এই ধরণের একটি অপরাধ কাজ শেষে ভাড়া নেওয়া বাসাটিও ছেড়ে দিয়ে পুনরায় অন্য জায়গায় ভাড়া বাসায় গিয়ে একই কর্মকাণ্ড করে বেড়াতেন। পরবর্তীতে ইমরান (৩২) নামে কোতোয়ালী থানাধীন নুপুর মার্কেটের এক ব্যবসায়ী কোতোয়ালী থানায় চক্রটির ব্যাপারে অভিযোগ করেন। ওই অভিযোগে ইমরান জানান, গত ২ মার্চ রাতে নিউমার্কেট থেকে সিএনজি যোগে মেডিক্যালের উদ্দেশ্যে রওনা হলে কাজীর দেউড়িতে তিনজন লোক তাকে পুলিশ পরিচয়ে অপহরণ করে চোখ বেধে একটি বাসায় নিয়ে যায়। পরে বদ্ধ একটি কক্ষে এক নারীর সাথে ও ইয়াবা নিয়ে আপত্তিকর ছবি তোলে তা বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবে বলে তার কাছ থেকে ২ লাখ টাকা দাবি করেন। এক পর্যায়ে সে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে ওই চক্রটিকে বিকাশের মাধ্যমে ৫০ হাজার ৫’শ টাকা ও একটি দামী মোবাইল সেট দেন। এছাড়া তাকে ছেড়ে দেওয়ার শর্ত হিসেবে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়ার পাশাপাশি কাউকে জানালে প্রাণনাশের হুমকি দেন। অপহরণের পরদিন ছাড়া পাবার পর গত ৮ মার্চ তিনি এ ব্যাপারে কোতোয়ালীতে অভিযোগ করেন। মেহেদী হাসান এ সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীদের ফাঁদে না পড়ার ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকার আহবান জানান। নগরীতে আরও এ ধরণের অপরাধ কাজে আরও কয়েকটি চক্র সক্রিয় আছে বলে আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে এসব তথ্য জানিয়েছেন ডিসি। কোতোয়ালী পুলিশের পরিদর্শক কামরুজ্জামান আজাদীকে বলেন, ব্যবসায়ী, ব্যাংকারসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে চাকরীজীবীরা এ প্রতারক চক্রটির ফাঁদে পড়েছিলেন। এর আগে আটককৃত কয়েকজনের বিরুদ্ধে পাহাড়তলী. ইপিজেড, বায়েজিদ বোস্তামী ও কোতোয়ালীতে অস্ত্র, মাদক ও নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

16 − 10 =