অবি ডেস্ক: আবলেত তারসুন তোহতির বয়স তখন ২৯ বছর। প্রতি সকালে সূর্য ওঠার ঘণ্টাখানেক আগে তিনি ও তার সঙ্গে থাকা বন্দিরা কসরতের জন্য নির্ধারিত জায়গায় যেতে সময় পেতেন মাত্র একমিনিট। বিবিসি’র এই দীর্ঘ অনুসন্ধানের প্রথম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন। সার বেঁধে দাঁড় করানোর পরে, তাদেরকে দৌড়াতে হতো। আবলেত বলছিলেন, “যারা খুব দ্রুত দৌড়াতে পারতো না তাদের শাস্তি দেয়ার জন্য একটা বিশেষ ঘর ছিলো। সেই ঘরে দুজন মানুষ থাকতো। একজন বেল্ট দিয়ে পেটানোর জন্য, অন্যজন শুধু লাথি মারতো।”
ক্যাম্পে কসরতের জন্য নির্ধারিত সেই জায়গাটা স্যাটেলাইটের ছবিতে স্পষ্ট দেখা যায়। আবলেত জানান, জিনজিয়াংয়ের দক্ষিণাঞ্চলীয় মরুশহর হোতানের সেই ক্যাম্পেই তাকে আটকে রাখা হয়। আবলেত বলেন, “আমাদেরকেগাইতে হতো-‘কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া নতুন চীন হতে পারে না’ বলে একটি গান। এবং তারা আমাদের আইন শেখাতো। যদি কেউ সেগুলো ঠিকভাবে উচ্চারণ করতে না পারতো, তাহলে তাদেরকে পেটানো হতো।”
তিনি সেখানে এক মাসের মতো ছিলেন। সময়টা ২০১৫ সালের শেষভাগে। তিনি সৌভাগ্যবানদের একজন। কারণ বন্দি শিবিরের শুরুর দিকে, কথিত ‘পুণঃশিক্ষা’র কর্মসূচি কম সময়ের জন্য করানো হতো। গত প্রায় দুবছর ধরে বন্দি শিবির থেকে কারো বের হয়ে আসার খবর নেই বললেই চলে। আর যেহেতু সব পাসপোর্টগুলো জমা নেয়া হয়েছে, তাই আবলেত সেই শেষ উইঘুরদের একজন যিনি চীন ছেড়ে পালাতে পেরেছেন। তিনি তুরস্কে আশ্রয় চেয়েছেন। এখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উইঘুর রয়েছেন সংস্কৃতি ও ভাষাগত ঐক্যের কারণে। আবলেত জানান, তার ৭৪ বছর বয়সী বাবা ও ৮ সহোদরের সবাই এখন বন্দি শিবিরে বন্দি। তিনি বলেন, “কেউই আর বাইরে নেই আমার।”
আবদুস সালাম:
৪১ বছর বয়সী আবদুস সালাম মুহেমেতও এখন তুরস্কে বাস করছেন। ২০১৪ সালে জিনজিয়াংয়ের পুলিশ তাকে আটক করেছিলো একজনের শেষকৃত্যে ইসলামিক দোয়া উচ্চারণের জন্য। তিনি জানান, তারা তাকে যদিও কোনো শাস্তি দেয়নি। কিন্তু তারপরেও তিনি মুক্ত হতে পারেননি।
তিনি বলেন, “তারা আমাকে বলেছিলো যে, আমার বিশেষ শিক্ষা অর্জন করতে হবে।” যদিও তিনি সেই ক্যাম্পে স্কুলের মতো কিছুই দেখেননি।
স্যাটেলাইট ছবিতে গার্ড টাওয়ার ও দুই স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনী স্পষ্ট দেখা যায়। এটা হানএরিক লিগাল এডুকেশন ট্রেনিং সেন্টারের ছবি। এখানেই রাখা হয়েছিলো তাকে। তিনিও সেই একই রুটিনের বিবরণ দেন। ২৫ বছরের আলী (প্রকৃত নাম নয়) তাদের একজন যারা এখনো এসব নিয়ে মুখ খুলতে ভয় পান। ২০১৫ সালে তাকে পুলিশ বন্দি শিবিরে আটক করে। কারণ তার মোবাইল ফোনে নেকাবে মুখ ঢাকা এক নারীর ছবি পাওয়া গিয়েছিলো।
তিনি বলেন, “আমার সঙ্গে সেখানে বন্দিদের মধ্যে একজন বৃদ্ধা নারী ছিলেন, যাকে আটক করা হয়েছিলো সৌদিতে হজ্জ করতে যেতে চাওয়ার কারণে। আরেকজন বুড়ো মানুষ ছিলেন, যার অপরাধ স্রেফ এটুকুই ছিলো যে তিনি তার পানির বিলটা সময়মত পরিশোধ করেননি।” তিনি একদিনের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছিলেন। প্রতিদিনের মতো সেদিনও ক্যাম্পে তাদেরকে কসরত করতে বাধ্য করা হচ্ছিলো। এমন সময় কোনো এক কর্মকর্তার গাড়ি ক্যাম্পে ঢোকানোর পর মূল দরজাটা সামান্য ফাঁকা করা ছিলো।
আলীর (ছদ্মনাম) মতো অনেকেই এখনও মুখ খুলতে ভয় পান।
তিনি বলছিলেন, “হুট করে সেই ফাঁকা দিয়ে একটি শিশু দৌড়ে ভেতরে ঢোকে এবং আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। আমাদের সঙ্গে বন্দি ছিলো তার মা। সে দৌড় দিয়ে তার মায়ের কাছে যায়। তার মাও তার সন্তানের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। দুজনেই শুরু করে কান্না। এমন সময় একজন পুলিশ সদস্য ওই মাকে চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে বাচ্চাটা থেকে আলাদা করে। এরপর বাচ্চাটাকে নির্দয়ভাবে ক্যাম্পের বাইরে বের করে দেয়। চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এই কথিত পুণঃশিক্ষাকেন্দ্রগুলো নিয়ে যে সব সুন্দর সুন্দর ছবি দেখানো হয়, তার সঙ্গে এমন বিবরণ পুরোটাই বিপরীত।
যে আবলেতের কথা এর আগে বলছিলাম, তিনি জানালেন, “রাতের বেলা আমাদের ডরমেটরির সব দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয়া হতো। ভেতরে কোনো টয়লেট ছিলো না। আমাদের শুধুমাত্র একটা গামলা দেয়া হতো।
যদিও এসব তথ্য যাচাই করার অন্য কোনো সুযোগ মেলেনি। আমরা চীন সরকারের কাছে এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তাদের কোনো সাড়া মেলেনি।
উইঘুরদের জন্য জিনজিয়াংয়ের বাইরের জগতের খবর বলে কিছু নেই। ভয় আর নীরবতা শুধু। পারিবারিক চ্যাট গ্রুপ থেকে বাইরে থাকা স্বজনদের সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। অথবা বলা হচ্ছে আর কখনো ফোন না করতে। এসবই এখন এখানকার নিয়মিত চিত্র।
বিলকিস: উইঘুর সংস্কৃতির কেন্দ্রে রয়েছে দুটি ব্যাপার- বিশ্বাস আর পরিবার। খুব পদ্ধতিগতভাবেই সেগুলো ভেঙে দেয়া হচ্ছে। পরিবারের সব সদস্যদের বন্দি শিবিরে আটকে রাখার কারণে অনেক শিশুকেই চীনের রাষ্ট্রীয় এতিমখানায় রাখা হচ্ছে।
বিলকিস হিবিবুল্লাহ ২০১৬ সালে তার ছোট মেয়ে সেকিনা হাসান আর স্বামীকে জিনজিয়াংয়ে রেখে ৫ সন্তান নিয়ে তুরস্কে পালিয়ে আসেন। পরিকল্পনা ছিলো যে, ছোট মেয়েটার পাসপোর্ট পেয়ে গেলেই তাকে নিয়ে তার স্বামীও ইস্তানবুল চলে আসবেন। কিন্তু তা আর হয়নি।
বিলকিসের ছোট মেয়ে সেকিনা: গেলো বছরের ২০ মার্চের পর থেকে তাদের সঙ্গে বিলকিসের আর কোনো যোগাযোগ নেই। তিনি জানেনও না তার মেয়ে কোথায়। তার ধারণা তার স্বামীকে বন্দি শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
কান্নাভেজা কণ্ঠে বিলকিস বলেন, “মাঝরাতে যখন বাচ্চারা ঘুমিয়ে যায়, আমি তখন একা একা কাঁদি। সন্তান কোথায় আছে, বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে তা না জেনে জীবন কাটানোর চেয়ে অসহায়ত্ব আর নেই। যদি বেঁচে থাকে তাহলে মেয়েটার বয়স এখন সাড়ে তিন বছর। সে যদি আমার কথা শুনতে পায়, তাহলে আমি শুধু তার কাছে ক্ষমাই চাইবো।”