যৌন নির্যাতনের অভিযোগে সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন সহ ৩ কর্মকর্তার নামে মামলা

0
1507

মোঃ আহসানউল্লাহ হাসান: যৌন হয়রানির মামলায় সিটি ব্যাংকের এমডিসহ তিনজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে শিগগির জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ। ইতিমধ্যে গুলশান থানা পুলিশ জোরেশোরে তদন্ত শুরু করেছে। এ চক্রের দ্বারা আর কেউ হেনস্তা হয়েছেন কিনা সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট অনেকের ব্যাংক হিসাবের লেনদেনও তদন্তের আওতায় আনা হবে। বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা ছাড়াও থানা পুলিশের বাইরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ ছায়াতদন্তও শুরু হয়েছে। নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্র যুগান্তরকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

প্রসঙ্গত, যৌন হয়রানির অভিযোগে সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন, হেড অব সিএসআরএম আবদুল ওয়াদুদ ও বোর্ড সেক্রেটারি কাফি খানের বিরুদ্ধে রোববার গুলশান থানায় মামলা দায়ের হয়। বাদী ব্যাংকের চাকরিচ্যুত সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট মনিরা সুলতানা পপি। মঙ্গলবার এ বিষয়ে যুগান্তরে রিপোর্ট প্রকাশিত হলে ব্যাংকপাড়াসহ সর্বত্র তোলপাড় সৃষ্টি হয়। খুবই নিন্দনীয় ঘটনা আখ্যা দিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তসহ দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তারা। যেন কোনো প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপে নারী নির্যাতনের এমন জঘন্য ঘটনা কেউ ধামাচাপা দিতে না পারে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়।

মামলার অগ্রগতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গুলশান থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) এসএম কামরুজ্জামান মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, নিয়মানুযায়ী ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্ত প্রক্রিয়া তার নিজস্ব গতিতে চলবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে শিগগির অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশের কয়েকটি সূত্র জানায়, এ মামলাটি খুবই স্পর্শকাতর হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে ঊর্ধ্বতন মহল থেকে ক্লোজ মনিটরিং করা হচ্ছে। আসামির সার্বিক গতিবিধি বিশেষ নজরদারির মধ্যে আনা হয়েছে। এছাড়া সন্দেহভাজন বেশ কয়েকজনের ব্যাংক হিসাবসহ তাদের সাম্প্রতিক সময়ের লেনদেনের তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। বাদী যাতে মামলা করতে না পারে সেজন্য কারা কিভাবে ভূমিকা রেখেছে সে বিষয়টিও ছায়াতদন্তের আওতায় আনা হয়েছে। বেশকিছু ফোন মেসেস ছাড়াও কয়েকজনের কল রেকর্ডও (সিডিআর) পর্যালোচনা করা হবে। এছাড়া মামলার এজাহারে বর্ণনার বাইরেও বাদিনীর কাছে আসামিদের বিষয়ে আরও বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। সে বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

বিশেষ করে বাদীর মতো আর কেউ তাদের রোষানলে পড়েছেন কিনা সেটিও তদন্ত থেকে বাদ যাবে না। অপরদিকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ছাড়াও মামলার বাদী ব্যাংকটিতে বড় ধরনের ঋণ জালিয়াতি হয়েছেন বলে যে তথ্য উপস্থাপন করেছেন সেটি পৃথকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক খতিয়ে দেখছে। দায়েরকৃত এজাহারের এক স্থানে বলা হয়, ‘ব্যাংকে যোগদান করার পরপরই মাসরুর আরেফিনের নিয়মিত ইভটিজিংয়ের শিকার হন তিনি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় এমডির এসব আচরণ সহ্য করেই তাকে কাজ করতে হয়। ২০১১ সালে অপর আসামি হেড অব সিএসআরএম আবদুল ওয়াদুদ গাড়িতে লিফট দেয়ার নাম করে তার ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে বসেন। লিফটের ভেতরে, সিঁড়িতে, অফিস চলাকালীন তার হয়রানির শিকার হতে হয়। এ ঘটনা বোর্ডের চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার টিটো এবং তাবাসসুম কায়সার জানেন। বোর্ডের আলোচনায় আসার পর কনসালটেন্ট রাজা দেবনাথ লিখিত অভিযোগ করতে বলেন। এরপর ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তারা আমাকে নিয়ে আলোচনায় বসেন। তারা আমার কাছে জানতে চান, আমি কি চাই। এই ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে একই ফ্লোরে কাজের পরিবেশ নেই জানানোর পর সেপ্টেম্বর মাসে আমাকে ট্রান্সফার করা হয়। এরপর ৩১ ডিসেম্বর ডিএমডি অপারেশন মাহিয়া জুনেদ এবং মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান আমাকে চাকরি খুঁজতে বলেন।

অপর এক স্থানে বলা হয়, সরাসরি গায়ে আপত্তিজনকভাবে হাত দেয়া, কটূক্তি, লালসার শিকার বানানোর অপচেষ্টাসহ অন্যায়ভাবে আমার দীর্ঘ ১৭ বছরের কর্পোরেট লাইফ নষ্ট করতে চেয়েছেন। আমি সসম্মানে আমার চাকরির পদমর্যাদা ফেরত চাই। সামাজিকভাবে আমাকে হেয় করা, অফিসে ঢুকতে না দেয়া, ইভটিজিংয়ের তীব্র নিন্দা জানাই এবং সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি। নারী অধিকার রক্ষায় বর্তমান সরকার যে ভূমিকা পালন করছে তার প্রতি সম্মান জানিয়ে আপনাদের সহযোগিতা একান্তভাবে কাম্য।

সিটি ব্যাংক থেকে বেআইনি চাকরিচ্যুতির শিকার সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট মনিরা সুলতানা পপি বলেন, যৌন হয়রানি বলেন আর অন্য নির্যাতনই বলেন- একটা মেয়ে কোন পর্যায়ে গেলে মামলা করতে পারে, সেটি সবাইকে বিবেচনায় নিতে হবে। এছাড়া আমার মামলা তো পুলিশ সহজে নেয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায় থেকে ফোন না করলে মামলাটি নেয়া হতো না।

তিনি বলেন, আসলে আমি তো সাহস করে ওদের মুখোশ খুলে দিয়েছি। কিন্তু আমার মতো এ রকম আরও অনেক ভুক্তভোগী আছেন যারা চাকরি হারানোর ভয়ে মুখ খুলছেন না। এ অবস্থায় তারা এখন ক্ষমতা আর প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে উল্টো আমাকে ফাঁসানোর জন্য ভিত্তিহীন নানান অভিযোগ দাঁড় করানোর অপচেষ্টা করবে। কিন্তু আমি পুরো ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত চাই। এছাড়া আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। তাই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

16 + fifteen =