দুদকের অভিযান বিতর্কিত করার অভিনব কৌশল ঘুষসহ গ্রেফতার জাহাজ জরিপকারক সাইফুরকে রক্ষার মিশনে নৌ অধিদপ্তর

0
648

নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের শিপ সার্ভেয়ার এন্ড এক্সামিনার (জাহাজ জরিপকারক ও পরীক্ষক) মির্জা সাইফুর রহমানের খুঁটির জোর কোথায়? ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে আটক হবার পরও তাকে রক্ষায় মহল বিশেষের তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানকে বিতর্কিত করার কৌশল নিয়েও রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। অতীতের ন্যায় অপকর্ম ধামাচাপা দিতেই মির্জা সাইফুরের সুবিধাভোগী মন্ত্রণালয় এবং নৌ পরিবহন অধিদপ্তর কেন্দ্রিক সিন্ডিকেট অপতৎপরতায় কলকাঠি নাড়ছে ।

প্রসঙ্গত, গত ২ সেপ্টেম্বর দুদকের একটি টিম নৌ পরিবহন অধিদপ্তরে অভিযান চালিয়ে ঘুষের দুই লাখ টাকাসহ শিপ সার্ভেয়ার মির্জা সাইফুর রহমানকে হাতেনাতে আটক করে। “জাহাজের সার্ভে সংক্রান্ত সনদ দেওয়ার জন্য ঘুষ হিসেবে দুই লাখ টাকা নেওয়ার সময় তাকে হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়” বলে দুদক কর্মকর্তারা  গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন। “এক অভিযোগকারীর কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেয়ে তারা মির্জা সাইফুরের অফিসে অভিযান পরিচালনা করেন। গ্রেফতারকৃত সাইফুরকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গ্রেফতারের দুই সপ্তাহ পরও সাইফুরকে নিয়ম অনুযায়ী সাময়িক বরখাস্ত করা হয়নি। এমনকি নৌ পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন সদরঘাটে আজও কোন কর্মকর্তা পদায়ন না করায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে নৌ অধিদপ্তরে কর্মরত একাধিক প্রকৌশলী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান।

এদিকে তাকে গ্রেফতারের ঘটনায় নড়েচড়ে উঠেছে নৌ পরিবহন কেন্দ্রিক দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট। ঘুষের বিষয়টি আড়াল করতেই সিন্ডিকেট উল্টো অভিযান পরিচালনাকারী দুদক কর্মকর্তাদের বিতর্কিত করার মিশন শুরু করেছে বলে জানা গেছে। সাইফুরকে গ্রেফতার পরবর্তী মন্ত্রণালয় প্রেরিত একটি চিঠিতে মিশনের ইঙ্গিত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সূত্র মতে, ওই চিঠিতে ‘ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে আটক হবার পাঁচ মিনিট আগে মির্জা সাইফুর অফিসের একটি সভায় ছিলেন’ বলে দাবি করা হয়েছে। সূত্র জানায়, নৌ পরিবহন অধিদপ্তরে মির্জা সাইফুর দুর্নীতির বরপুত্র হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ নৌ-যান সার্ভে এবং রেজিস্ট্রেশনে ভয়াবহ দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। নকশা ছাড়াই ভুয়া ও জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে নৌযান রেজিস্ট্রেশন করে সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। এমনকি চার দশকের পুরনো জাহাজ নতুন দেখিয়ে রেজিস্ট্রেশন প্রদান করেছেন। এসব নিয়ে দুদকেও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। কিন্তু আইনের ফাঁক গলে বারবার তিনি পার পেয়ে গেছেন।

অপরদিকে সাইফুরের বিরুদ্ধে ভয়াবহ অভিযোগ হচ্ছে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ঘাটের কাছে পদ্মায় লঞ্চডুবিতে শতাধিক যাত্রীর প্রাণহানির ঘটনায় তার সংশ্লিষ্টতা। অভিযোগ মতে, পিনাক-৬ নামের ওই নৌ-যানটিতে অনেক ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও মির্জা সাইফুর মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে এটিকে দফায় দফায় যাত্রী পরিবহনের অনুমতি দিয়েছিলেন। তার আগে ওই বছরের মে মাসে মুন্সিগঞ্জে এম ভি মিরাজ-৪ নামে একটি লঞ্চ ডুবে ৫৬ জনের প্রাণহানি ঘটে। যান্ত্রিক ত্রুটিপূর্ণ ওই নৌ-যানটিরও সার্ভের দায়িত্বে ছিলেন মির্জা সাইফুর। এসব অভিযোগে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। উচ্চ পর্যায়ে দেনদরবারের মাধ্যমে বরখাস্ত আদেশটি এক পর্যায়ে প্রত্যাহার করা হলে পরে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে প্রত্যাহার আদেশটি স্থগিত করা হয়।

দুদক সূত্র মতে, শিপ সার্ভেয়ার মির্জা সাইফুরের বিরুদ্ধে ত্রুটিপূর্ণ নৌযান নিবন্ধন এবং অবৈধভাবে সার্ভে সনদ দিয়ে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ তদন্তে তথ্য প্রমাণ মিলেছে। এর মধ্যে এমভি বোরহান কবির যার প্রাক্তন নাম এমভি জয়খান-৫ এবং এম.এল বাদল প্রাক্তন নাম এম.এল রুমা নৌযান দুইটি প্রায় চার দশকের পুরনো। স্ক্র্যাপ করার পরিবর্তে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সেগুলো নতুন হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে। অন্য অভিযোগের মধ্যে রয়েছে নৌযানগুলির গ্রসটন কম ধরে সরকারের লাখ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয়া হয়েছে। নৌযানগুলোর নকশার সাথে বাস্তব কাঠামোর কোন মিল নেই। অনেক নৌযানের ডক সনদ এবং ভ্যাট আদায়ের ছাড়পত্র ভুয়া। তবে এ তদন্তকে ভিন্নখাতে নিতে শুরু থেকেই একটি চক্র তৎপর। এরা বিভিন্ন কূট কৌশলের মাধ্যমে প্রকৃত সত্যকে আড়াল করতে চাইছে। দুদকের একটি চিঠির প্রেক্ষিতে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের গৃহীত পদক্ষেপে এ অভিযোগ দৃঢ়তা পেয়েছে।

জানা গেছে, মির্জা সাইফুরের বিরুদ্ধে নৌ-যান রেজিস্ট্রেশন প্রদান করে রাজস্ব ফাঁকি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানের স্বার্থে সহায়তা চেয়ে ২০১৪ সালের ২১ অক্টোবর এবং ২০১৬ সালের ১৫ আগস্ট সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালককে একটি চিঠি দেয় দুদক। দুদকের উপ-পরিচালক শেখ আবদুস ছালাম স্বাক্ষরিত ওই চিঠির সঙ্গে ৫৭টি নৌযানের তালিকা সংযুক্ত করে সেগুলো সরেজমিন যাচাইয়ের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে নৌ-যান রেজিস্ট্রেশন কাজে পারদর্শী তিন সদস্য বিশিষ্ট টিম গঠন করে অবহিত করার জন্য চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। ‘বিষয়টি অতীব জরুরী’ উল্লেখ করে চিঠিতে আরো বলা হয়, নিয়োজিত প্রকৌশলীদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বাস্তব যাচাই কাজের তারিখ নির্ধারণ করা হবে।তার পিআরএর এর পর তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপপরিচালক মো: শামসুল আলম ২০১৮ সারের ৪ ফেব্রুয়ারী দুদক মহাপরিচালকের কাছে অপর এক পত্রে চাহিত প্রতিবেদন প্রদানের অনুরোধ জানান। আজও অদিদপ্তর থেকে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে কীনা তা জানা যায়নি।

এদিকে ২০১৬ সালের ২১ আগস্ট প্রকৌশলী ও শিপ সার্ভেয়ার মো: মুঈন উদ্দিন জুলফিকারকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন মো: হুমায়ুন কবির এবং মো: শাহরিয়ার হোসেন। সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের  তৎকালীন মহাপরিচালক কমোডর এম জাকিউর রহমান ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন পেশ করার নির্দেশ দেয়া হয়। সে তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি।

অভিযোগ রয়েছে, দুদকের চিঠির প্রেক্ষিতে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর কমিটি গঠন করলেও সেটি ছিল আইওয়াশ। কেননা, দুদকের চিঠিতে রেজিস্ট্রেশনকৃত নৌ-যানগুলো সরেজমিন যাচাইয়ের জন্য পারদর্শী সার্ভেয়ার বা প্রকৌশলীর সহায়তা চাওয়া হয়েছে। অর্থাৎ দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা সমুদ্র পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সাথে নিয়ে নিজেরা প্রতিটি নৌযান স্বচক্ষে দেখবেন। অথচ সমুদ্র পরিবহন সংশ্লিষ্টরা দুদককে পাশ কাটিয়ে পৃথক তদন্ত করতে চাইছে, যা রহস্যজনক।

দুদকের চিঠিতে যেসব নৌযানের উল্লেখ রয়েছে সেগুলো হলো-এমভি মিরাজ-২, এমভি পিনাক-৬, এমভি বোরহান কবির যার প্রাক্তন নাম এমভি জয়খান-৫, এম.এল বাদল প্রাক্তন নাম এম.এল রুমা, এমভি আলতাফ-১, এমভি এন.এ-৬, এমভি নজিব বেপারী, এমভি ড্রীম-৬, এমভি আল ইত্তেহাদ-২, এমভি আল ইত্তেহাদ-৩, ওটি কিংফিশার-৭, ৮ ও ১০, এমভি সুমনা, এমভি সুন্দরবন-১১, এমভি এইচ পিএল-১ ও ২, ওটি হযরত বাহাদুর শাহ, এমভি হাজী ইমন আলী, এমভি অতিফা জাহান, ওটি দারিন দাশাব-১, এমভি সান্নিধ্য, ওটি আওলাদ ২ ও ৪, এমভি ফারহাত, এমভি শাহরাস্তি-৩, এমভি শাহিন রিফাত-১, এমভি সোনার তরী, এমভি ইমাম হাসান-২, এমভি গোল্ডেন পোস, এমভি বালশুর-১, এমভি নিউ স্টার-৫ ও ৬, এমভি ময়ুর-৭, এমভি জাবেদ-১১, এমভি বনি হাসান, এমভি ঈগল-৩ ও ৪, ওটি ওশান প্রিন্স, ওটি ওশান, এমভি শান্তা রূপা-৪ ও ৫, এমভি ওয়াটারবাজ-৩, ৪, ৫ ও ৬, এমভি জাভেদ-১২, ওটি নোভা, এমভি আক্তার বানু, এম এল বাদশা, এমভি মিতালী-৪, এমভি আকাশ-১৩, ওটি মেঘবতী, এমভি মানিক-৯. এমভি নিউ সাব্বির-২ ও ৩, এমভি সর্দার বাড়ী, এমভি মান-৭, এমভি মমিন আমিন, এমভি রাজহংস-৮, ওটি রিদা, ওটি রিদা-১, ওটি আফসারা, এমভি জেসি-২, এমভি সিটি ও এমভি স¤্রাট-২।

এছাড়া উপপরিচালক আবদুস সালামের পিআরএল পরবর্তি  তদন্ত কর্মকতা আরেকটি চিঠি দেন নৌ মহাপরিচালককে। সে চিঠির বাপারেও সন্তোষজনক সহায়তা  দেয়া হয়নি।

অনদিকে তথ জালিয়াতি করে এনওসি পদানের মাধমে বিদেশেজনবল পাঠিয়ে দেশের মযাদা ক্ষুন্ন এব রাষ্টীয় রাজস্ব ফাকির অভিযোগ রয়েছে দুদকের তদন্তেও আওতায়। এর মধে  ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারী মো: আয়ুব আলীকে আইডি এনওসি ২০১৬/৬৫৭ এবং এমডি নাসিরকে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর ৭২৭০ নম্বর  এনওসি  প্রদানের বিষয়টি ফাঁস হবার পর ব্যাপক চাঞ্চলের  সৃস্টি হয়। ভুয়া তথ্যে এধরনের এনওসি প্রদান নজিরবিহীন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

4 × four =