সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১। শনিবার রাতে রাজধানীর ভাটারা থানাধীন আবাসিক এলাকার একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
রাতেই তাকে নিয়ে মোহাম্মদপুরের বাসা, অফিসসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালিত হয়। গ্রেফতারের পরপরই মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে রাজীবকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
রাত সোয়া ১টায় র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক সারোয়ার বিন কাশেম সাংবাদিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিফ করে গ্রেফতারের খবরটি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের অভিযোগে কাউন্সিলর রাজীবকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি বন্ধুর বাসায় গত কয়েক দিন ধরে আত্মগোপনে ছিলেন। খবর পেয়ে সেখানে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় একটি পিস্তল, কয়েক রাউন্ডগুলিসহ একটি ম্যাগজিন, ৩৩ হাজার টাকা, সাতটি বিদেশি মদের বোতল ও একটি পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়। তার বন্ধুকে পাওয়া যায়নি, তিনি বিদেশে আছেন। সূত্র জানায়, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের অভিযোগ আসার পর থেকেই র্যাব রাজীবকে খুঁজছে। শনিবার বিকালে তারা জানতে পারে তিনি কয়েক দিন যাবত বন্ধুর বাসায় আত্মগোপনে আছেন। খবর পেয়েই র্যাব বন্ধুর বাড়িটি ঘিরে ফেলে। এরপর একদল ভেতরে অভিযান শুরু করে। দীর্ঘ সময় নিয়ে বাড়িটিতে তল্লাশি চালানো হয়। রাজীবের বন্ধুর বাসার পাশাপাশি কাউন্সিলরের মোহাম্মদপুরে ১ নম্বর রোডের ৩৩ নম্বর বাড়িটি র্যাব সদস্যরা ঘিরে রাখেন। সেখানে রাজীবের উপস্থিতিতে অভিযান চালানো হয়।
স্থানীয় সূত্র জানায়, কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব নিজের এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলদারিত্ব, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ আর মাদকসেবীদের আখড়ায় পরিণত করেছেন তার সাম্রাজ্য। কেউ তার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলার সাহস দেখায়নি। তার বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুরে জমি দখল, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া তার আত্মীয়ের বিরুদ্ধে ১৫টি প্লট দখলের অভিযোগ উঠেছে। ২০১৫ সালের কাউন্সিলর নির্বাচনে তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। দলীয় প্রার্থী ও মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি শেখ বজলুর রহমানকে হারিয়ে নির্বাচিত হন তিনি। এরপর থেকেই বদলে যান রাজীব। তার চালচলনে আসে ব্যাপক পরিবর্তন। কোথাও গেলে সঙ্গে থাকে গাড়ি আর মোটরসাইকেলের বহর। রাস্তা বন্ধ করে চলে এসব গাড়ি। রোদে গেলে আশপাশের কেউ মাথার ওপর ধরে রাখত ছাতা। সঙ্গে থাকত ক্যাডার বাহিনী। হঠাৎ কেউ দেখলে মনে হবে আগের আমলের রাজা-বাদশাহ বা সুলতান। মাত্র কয়েক বছরেই মালিক বনে গেছেন অঢেল সম্পত্তি আর গাড়ি বাড়ির।
মোহাম্মদপুর এলাকায় যুবলীগের রাজনীতি দিয়েই রাজীবের রাজনৈতিক জীবন শুরু। অল্পদিনেই নেতাদের সান্নিধ্যে এসে মোহাম্মদপুর থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক পদ বাগিয়ে নেন তিনি। থানা আওয়ামী লীগের বীর মুক্তিযোদ্ধা নেতাকে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করায় বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। পরে কেন্দ্রীয় যুবলীগের এক নেতাকে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা দিয়ে উল্টো তিনিই হয়ে যান ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
যুবলীগের সাইনবোর্ড আর কাউন্সিলরের পদটি ব্যবহার করে এলাকায় সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনীর মাধ্যমে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, ডিশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন রাজীব। বিগত ৪ বছরে ৮-১০টির বেশি নামিদামি ব্র্যান্ডের গাড়ি কিনেছেন। যার মধ্যে মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ, ক্রাউন প্রাডো, ল্যান্ডক্রুজার ভি-৮, বিএমডব্লিউ স্পোর্টস কার রয়েছে।
গুলশান ও মোহাম্মদপুরে আটটি ফ্ল্যাট রয়েছে রাজীবের। কমিশনার হওয়ার পরপরই তিনি বাহিনী দিয়ে প্রচার চালিয়ে বনে যান স্বঘোষিত ‘জনতার কমিশনার’। তবে কথিত এই ‘জনতার কমিশনার’ এর বিরুদ্ধে জনতার কাছ থেকেই মাসে কোটি টাকা চাঁদা তোলার অভিযোগ রয়েছে। বাসস্ট্যান্ড, সিএনজি স্ট্যান্ড, ফুটপাতই তার চাঁদা তোলার মূল উৎস।
রাজীব মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির ১ নং রোড এলাকায় পানির পাম্পের জন্য নির্ধারিত জায়গায় বাড়ি বানিয়েছেন। বাড়ির জায়গাটির দামই প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। তার ইশারাতেই রহিম ব্যাপারী ঘাটের ৩৩ নং ওয়ার্ড যুবলীগের অফিসটিও দখল করার অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, মোহাম্মদপুরে যুবলীগ কর্মী তছির উদ্দিন হত্যা মামলার আসামিরা কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবের ঘনিষ্ঠ। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধের জেরে তছিরকে খুন করা হয়। এর আগে ঢাকার মোহাম্মদপুরের আলোচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার কাছ থেকে এক কোটি টাকার এফডিআর, পৌনে সাত কোটি টাকার চেক, নগদ দুই লাখ টাকা ও চার রাউন্ড গুলিসহ একটি পিস্তল উদ্ধারের কথা জানান র্যাব কর্মকর্তারা।