প্রতারক জামাইয়ের শক্তি ‘পুলিশ বউ‘

0
822

ডেস্ক রিপোর্টার: চট্টগ্রামে এক প্রতারক জামাই টাকা আত্মসাৎ করেও কেবল বউ পুলিশ হওয়ার সুবাদে উল্টো এক অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা, আরেক অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে চেক প্রতারণা মামলা দিয়ে হয়রানি করার অভিযোগ মিলেছে। জানা যায়, চট্টগ্রামে আরএফএল দুরন্ত বিভাগে সদরঘাট জোনে কর্মরত বিক্রয় প্রতিনিধি মো.ইউসুফ (৩০) এর সাথে চট্টগ্রামে ডিলারদের সাথে অফিসিয়াল লেনদেন করতে গিয়ে এমন প্রতারণার খবর মিলেছে। এক ডিলারের কাছ থেকে খালি চেক নিয়ে তাতে নিজে টাকার অংক বসিয়ে চেক প্রতারণার মামলার আসামী করা, আরেক ডিলারের কাছ থেকে পন্য দেয়ার কথা বলে ২০লক্ষ টাকা নিয়ে তালবাহানা, পরবর্তীতে তার নামেও অপহরণ মামলাসহ নানাভাবে হয়রানি করে যাচ্ছেন বলে দাবী ভুক্তভোগীদের।

জানা যায়, আবু ইউসুফ(৩০) কুমিল্লা জেলার দক্ষিণ কুমিল্লা পৌরসভার আশ্রাফপুর গ্রামের মরহুম আলী বাড়ীর মৃত আবুল হাসেম এর ছেলে। প্রাণ আরএফএল এর দুরন্ত সাইকেল বিভাগে চট্টগ্রামে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত। তার স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা চট্টগ্রাম পুলিশ লাইনে কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত। আবু ইউসুফ দুরন্ত সাইকেলের বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে নানা ব্যবসায়ীর সাথে অর্থনৈতিক প্রতারণা করেও কেবল পুলিশ কনস্টেবলের স্বামী হওয়ার সুবাদে পার পেয়ে যাচ্ছেন বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।

চট্টগ্রাম নগরীর স্টেশন রোডের ভাই ভাই স্টোর নামক একটি দোকানের মালিক সাহাব উদ্দিন (৩৯) চট্টগ্রাম মুখ্য মহানগর হাকিম এর আদালতে গত ১১ জুলাই একটি অভিযোগ (১৫৭৩/২০১৯ কোতোয়ালী) দাখিল করেন।

দাখিলকৃত অভিযোগে সাহাবউদ্দিন উল্লেখ করেন, ইউসুফ প্রাণের বিক্রয় প্রতিনিধি হওয়ায় তার সাথে প্রায় ব্যবসায়িক লেনদেন ঘটেছে এবং তাকে বিশ^াসও করেছেন। সে তাকে ১৫% ডিসকাউন্টে প্রডাক্ট নিতে অনুরোধ করেন। সাহাবউদ্দিন নিজের কাছে টাকা নাই বললে, তাকে খালি চেক(ব্লাঙ্ক চেক) দিয়ে মাল দেয়ার কথা বলেন। সে হিসেবে তিনি খালি চেক দেন ইউসুফকে। পরবর্তীতে সাহাব উদ্দিন জানতে পারেন এ ধরণের কোন অফার কোম্পানীর নেই এবং এটি একটি প্রতারণা। সে তার চেক ফেরত চাইলে তা ফেরত না দিয়ে ইউসুফ নানা তালবাহনা করেন। সে খালি চেকটিতে এক কোটি পনের লক্ষ একান্ন হাজার ছয়শত আশি টাকা লিখে ব্যাংকে তোলার জন্য জমা করেছেন। সে এখন আমার নামে চেক প্রতারণার মিথ্যা মামলাও করেছেন।

এদিকে ইউসুফ সাহাবউদ্দিনের নামে গত ৩মার্চ একটি লিগ্যাল নোটিশ ইস্যু করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, সাহাব উদ্দিন তাকে ব্যবসায়িক পার্টনার করার কথা বলে বিভিন্ন সময়ে এক কোটি পনের লক্ষ একান্ন হাজার ছয়শত আশি টাকা নিয়ে পার্টনারও না করা এবং টাকাও ফেরত না দেয়ার অভিযোগ তুলেন। তিনি সেখানে বলেন, তার নামে উল্লেখিত টাকার পরিমানে দেয়া চেকটি ডিজঅনার করিয়ে সাহাব উদ্দিন প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্যবসায়ী সাহাব উদ্দিন বলেন, আমি আমার চেকটা ফেরত চাই কিন্তু ওনি সেটা দিচ্ছেন না। পুলিশের বড় কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সে আমাকে হয়রানি করছে।

চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানাধীন আরেক ব্যবসায়ী গাউসিয়া সাইকেল বাজার এর মালিক মোহাম্মদ নাসিম উদ্দিন গত ২৬ আগস্ট চট্টগ্রাম চীফ মেট্রেপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ইউসুফ এর বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারী অভিযোগ দায়ের করেন।

অভিযোগ থেকে জানা গেছে, ইউসুফের সাথে লেনদেন করতে গিয়ে ৬০লাখ টাকা পাওনা রয়েছে নাসিম উদ্দিন। কিন্তু ইউসুফ টাকা না দিয়ে বিভিন্ন তালবাহানা করলে সে আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করেন। টাকা না দিয়ে চেক দিলেও সে চেকও ডিজঅনার হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে। পরবর্তীতে টাকার জন্য আরএফএল অফিসে যোগাযোগ করলে সেখানে তারা উভয়কে ডেকে মিমাংসা করতে গেলেই বিপত্তি ঘটান ইউসুফের স্ত্রী রাজিয়া।

ঘটনার বিবরণে জানা গেছে, ইউসুফ অফিসে অনিয়মিত হওয়ায় আরএফএল চট্টগ্রাম কার্যালয়ের কর্মকর্তারা গত ১৯ অক্টোবর সকালে তাকে অফিসে ডেকে পাঠান। ওইদিন সকাল ১০টার দিকে ইউসুফ হালিশহরের ইসাবেলা টাওয়ারের চতুর্থ তলায় অবস্থিত আরএফএল অফিসে আসেন। এ সময় ডেকে পাঠানো হয় ডিলার নাসিমকেও। টাকার বিষয় নিয়ে আলাপের মাঝেই ইউসুফের স্ত্রী পুলিশ কনস্টেবল রাজিয়া স্থানীয় হালিশহর থানা পুলিশকে অভিযোগ করেন যে, তার স্বামীকে আরএফএল অফিসে ‘আটকে’ রাখা হয়েছে, ‘মারধর’ করা হচ্ছে।

পরে পুলিশ এসে আপোষের কথা বলে টাকা আত্মসাৎকারী ইউসুফ ও আরএফএল কর্মকর্তাদের থানায় ডেকে নিয়ে যায়। আরএফএল- এর চার কর্মকর্তাকে সারাদিন থানায় বসিয়ে রাখলেও কোনো সমাধান দিতে পারেনি পুলিশ। উল্টো পরদিন ২০ অক্টোবর সকালে আবারও সমাধানের কথা বলে থানায় ডেকে নিয়ে টাকা আত্মসাতের শিকার ডিলারসহ আরএফএল- এর ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা ঠুঁকে দেয় পুলিশ; সমাধানের জন্য যাওয়া চার কর্মকর্তাকে পাঠানো হয় হাজতে। পরদিন আদালত থেকে তারা জামিন লাভ করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ২০১৬ সাল থেকে তার সাথে নিয়মিত ব্যবসা করে আসছি। সে হিসেবে তার কাছে আমার ৬০ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। টাকা চাইতে গেলে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। আরএফএল বৈঠকে আমি ৫লাখ টাকা ছাড় দিয়ে মেনে নিয়েছি। সেখান থেকে ৩লাখ টাকা দিয়েছে, আমি আরো ৫২ লাখ টাকা পাব তার কাছে। কিন্তু পুলিশ বউয়ের শক্তিতে সে আমাকে টাকা দিচ্ছেনা। এদিকে ইউসুফ ও তার স্ত্রী পুলিশ কনস্টেবল রাজিয়ার বিরুদ্ধে স্টেশন রোডের আরেক ব্যবসায়ী 

অপরদিকে ইউসুফের বিরুদ্ধে নগরীর সদরঘাট এলাকার মামা সাইকেল স্টোরের মালিক আবু বকর(৪৭) চট্টগ্রামের মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে গত ২১ এপ্রিল অনুরূপ একটি প্রতারণার অভিযোগ উত্থাপন করেন। অভিযোগে ভুক্তভোগী আবু বকর উল্লেখ করেন, আবু ইউসুফের সাথে ব্যবসায়িক লেনদেন হয়ে আসছে অনেকদিন ধরেই। তারই ধারাবাহিকতায় সাইকেল এবং বেয়ারিংসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সরবরাহের নিমিত্তে গত ১০ আগস্ট ২০লাখ টাকা নেন ইউসুফ। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে মালামাল ডেলিভারী না দেওয়ায় টাকা ফেরত চাইলে ইউসুফ তাকে ২০ লাখ টাকা মিলিয়ে ৩টি চেক দেন। কিন্তু চেক পাশ না হওয়ায় বিভিন্ন সময়ে ঘোরাঘুরি করেও টাকা পেতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে আইনের দ্বারস্থ হন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যবসায়ী আবু বকর বলেন, আমাকে ৩টি চেক দিয়েছিল কিন্তু কোনটাই পাশ হয়নি। এখন টাকা না দিয়ে বিভিন্ন তালবাহনা করছে। পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা আমাদেরকে আশ^াস দিয়ে যাচ্ছেন টাকা আদায় করে দিবেন বলে।

অন্যদিকে নগরীর সদরঘাট এলাকার আরএফএল এর ডিলার ভূঁইয়া সাইকেল মার্ট থেকে বিক্রয় প্রতিনিধি ইউসুফ সাইকেল নিয়ে বিভিন্ন দোকানে খুচরা বিক্রয় করেছিল। সেখানেও তার একুশ লক্ষ উনচল্লিশ হাজার পাঁচশত বিয়াল্লিশ টাকা বকেয়া রয়েছে। যা উত্তোলনের জন্য আরএফএল ম্যানেজারের সাথে একটি চুক্তিনামাও সম্পাদিত হয়েছে। আরএফ দুরন্ত বিভাগের জোনাল ম্যানেজার শফিউল আজম বলেন, ইউসুফের প্রতারনার কারনে আমাদের মার্কেটিং এর অনেক বদনাম হয়েছে। সহজে এই বদনাম গোছানো যাবে না। দুরন্ত বিভাগের ডিষ্ট্রিভিউটর ও  মেসার্স ছিরিকোর্ট ট্রেডার্স এর মালিক সুমন ভৌমিক বলেন ইউসুফের কারনে আমার ৬ লক্ষ টাকার মত ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়েছে।

এদিকে উল্লেখিত ৩ ব্যবসায়ীর সাথে সংঘটিত ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত ইউসুফকে ফোনে পাওয়া যায় নি।

ইউসুফের স্ত্রী পুলিশ কনস্টেবল রাজিয়া বলেন, আমার স্বামী যদি অপরাধ করে তার শাস্তি হবে। অভিযোগ ওর বিরুদ্ধে এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নাই।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

4 + nine =