অবৈধ ব্যাংকিংয়ের আড়ালে নজিরবীহিন অর্থ লোপাটকারী আবু জাফর চৌধুরী ধরাছোয়ার বাইরে

0
999

মোঃ আহসানউল্লাহ হাসানঃ সরকারী নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষ সমবায় অধিদপ্তরের থেকে নিবন্ধিত ‘দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ সোসাইটি’র “সোসাইটি” শব্দটি বাদ দিয়ে তদস্থলে “ব্যাংক” শব্দটি জুড়ে দিয়ে “দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক” নামে সারা দেশে শাখা অফিস খুলে সাধারন জনগনের দৃষ্টিভঙ্গিকে খুব সহজেই পরিবর্তন করে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কুখ্যাত প্রতারক ‘দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডের অবৈধ চেয়ারম্যান আবু জাফর চৌধুরী। তবে  জনগনের টাকা হাতিয়ে নিয়ে তিনি এদেশের মাটিতে কিছুই করেননি। নিজের আখের সাঁজাতে অন্তত হাজার কোটি টাকা মালয়েশিয়াতে পাঁচার করেছে বলে গুণজন শোনা যাচ্ছে। দুর্নীতি দমন কমিশন এই অবৈধ ব্যাংকিয়ের গডফাদার আবু জাফর চৌধুরীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায়  সংশ্লিষ্ট মহলে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বলেন যে কোন সময় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবে এই প্রতারক।  বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করেই হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।   

আর এই অর্থ পাচার করে বিদেশের মাটিতে গড়ে তোলেন বিলাশী জীবন ধারনে স্বর্গরাজ্য।‘দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জাকিউদ্দিন আহম্মেদকে কৌশলে চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে শুরুতেই অন্তত ১৩ কোটি টাকা স্থিতি মুলধন সহ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহন করে প্রতারক আবু জাফর চৌধুরী। প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব গ্রহন করার মাসখানেক পরেই ‘দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ সোসাইটি’র সমস্ত কাগজপত্র গায়েব করে শুরু করেন “দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক” নামে শুরু করেন অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম। প্রতারক আবু জাফর চৌধুরীর এহেন কর্মকান্ডে জাকিউদ্দিন আহম্মেদ বাঁধা প্রদান করলে প্রতারক আবু জাফর চৌধুরীর তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে জাকিউদ্দিন আহম্মেদকে অফিসে প্রবেশ করাই চিরতরে বন্ধ করে দেন। এঘটনার পর থেকে প্রতারক আবু জাফর চৌধুরী অদ্যবধি অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রমে স্ত্রী, ছেলে মেয়ে, ভাইবোনদের প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে যুক্ত করে জনগনের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। “দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক” নামে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নোটিশ দিলেও তাতে কর্নপাত করেনি প্রতারক আবু জাফর চৌধুরী। বরং অবসর প্রাপ্ত উচ্চপদস্থ একাধিক সামরিক অফিসারকে প্রতিষ্ঠানে শেয়ারহোল্ডার নিযুক্ত করে নিজের প্রতারনার ক্ষেত্রকে আরো বেশী শক্তিশালী করেন।    

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সমবায় অধিদপ্তর থেকে দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ সোসাইটির নিবন্ধন নিয়ে সোসাইটির পরিবর্তে ব্যাংক শব্দটি জুড়ে দিয়ে সাধারন জনগনের কাছে ব্যাংক হিসেবে পরিচিতি লাভ এ প্রতিষ্ঠানটি। আর এই সমিতির অন্তরালেই অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আবু জাফর চৌধুরী হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে এখন সে প্রভাবশালী কোটিপতিদের একজন। ব্যাংক না হলেও অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করছে যাচ্ছে মহাসমারোহে। লাখ টাকা জমা রাখলে মাসে দুই হাজার টাকা করে মুনাফা। এমন প্রলোভনে সমবায় সমিতির নামে যাদুর ছোঁয়ায় পুরো মাত্রায় ব্যাংকিং কার্যক্রম প্রতিষ্ঠিত করে এই প্রতিষ্ঠানটি। অথচ সমবায় অধিদপ্তর ও প্রশাসনের নাকের ডগায় বসেই উচ্চ হারের সুদের প্রলোভন দেখিয়ে দি ঢাকা মাকেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো চেক বই, মেয়াদী আমানত, মাসিক সুদ প্রদানের সুবিধাসহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে জনগণের সঙ্গে করেছে ব্যাংকিং প্রতারণা। লোপাট হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। যার অধিকাংশ মালয়েশিয়ায় পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৪০ সালের সমবায় আইনের আওতায় আর্থিক কার্যক্রম ১টির বেশি শাখা খোলার নিষেধাজ্ঞা থাকলেও দি ঢাকা মাকেন্টাইল কো অপারেটিভ রাজধানীর মতিঝিল ও মিরপুর সহ ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাট, খুলনা, জামালপুর, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলায় শাখা খুলে চালাচ্ছে অবৈধ ব্যাংকিং। সমবায় অধিদপ্তর কর্তৃক ইহা দেখভালের কথা থাকলেও তাদের নাকের ডগায় চলছে এমন জালিয়াতি। বরং অনেক ক্ষেত্রেই সমবায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘুষের বিনিময়ে তাদের সহযোগিতা করে থাকে। যার প্রমাণ প্রতি বছর অডিট হওয়ার কথা থাকলেও মনগড়া অডিট তৈরি করার কথা উঠে আসে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানেও এরূপ ২০ থেকে ২৫টি সমবায় সমিতির খোঁজ মিলেছে। যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মাঠে নেমেছে দুদক। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যাবৎ প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ থাকলেও একটি সিন্ডিকেটের প্রভাবে সমবায় অধিদপ্তর থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি তাদের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয় অবৈধ সুবিধা দিয়ে সমবায় অধিদপ্তরের কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আর্থিক সুবিধা গ্রহনের প্রমানও মিলেছে দুদকের অনুসন্ধানে।

অপরদিকে, মাত্র তিন কোটি টাকার শেয়ার মূলধনের বিপরীতে হাজার হাজার কোটি টাকার আগ্রাসী আমানত সংগ্রহের চিত্র উঠে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে। আর একারনে দি মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেডকে অবৈধ ব্যাংকিং ব্যবসা বন্ধের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে প্রতিষ্ঠানটির কাছে চিঠি দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জবাব চাইলেও সন্তোষজনক উত্তর দিতে পায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১১ অক্টোবর-২০১৮ সব ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ করতে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দেয়। সমবায় সমিতির কার্যক্রম চালানোর লক্ষ্যে গঠন করা হয় দি মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ সোসাইটি। কিন্তু সমবায়ের আড়ালে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানো সহ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে জঙ্গিদের সংগঠনের প্রতি অর্থায়নের অভিযোগও উঠে আসে। পাশাপাশি উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে সারা দেশে ১২০টি শাখার মাধ্যমে দেড় লাখ গ্রাহক থেকে আমানত সংগ্রহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তাই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে প্রতিষ্ঠানটির অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধে করণীয় নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৬ সালের ৩ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সভা করে। সভায় বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধন কার্যালয়, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি, সমবায় অধিদফতর, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি উপস্থিত থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহন করে।

দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি সমবায় অধিদফতর থেকে ১৯৭৩ সালের ‘দি বেঙ্গল কো-অপারেটিভ সোসাইটি অ্যাক্ট-১৯৪০’ এর বিধান অনুযায়ী সমবায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধন নিয়েছে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংক বা ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ অনুযায়ী কোনো ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধিত নয়। তবে সমবায় অধিদফতর থেকে এই প্রতিষ্ঠানের নামের শেষে ব্যাংক শব্দ ব্যবহার না করার নির্দেশ থাকা সত্তে¡ও তার তোয়াক্কা না করেই অবৈধ ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি আমানত সংগ্রহ করেছে হাজার হাজার কোটি টাকার ওপর। চলবে……।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

fifteen + 10 =