কাজী ইনামুল হক দানু একজন অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব

0
481

৬০-এর দশকের শেষ পর্যায়ে বাঙালির অধিকারের অগ্নিঝরা সংগ্রামের অগ্রসৈনিক। ১৯৭১ সালের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধকালীন বিএলএফ-এর গ্রুপ কমান্ডার, বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারি কাজী ইনামুল হক দানু মৃত্যুর আগ মূহুর্ত পর্যন্ত লড়াই-সংগ্রাম করে দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করে গেছেন।

বাংলাদেশের স্বাধিনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তাঁর অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। কোনো অশুভ চক্রের রক্তচক্ষু, ভয়ভীতি, হুমকি-ধমকি, জেল-জুলুম, নির্যাতন, প্রলোভন কোনো কিছুই তাঁকে দমাতে পারেনি। কখনো মাথা নত করেন নি তিনি। তাঁর মধ্যে ছিল অসীম দেশপ্রেম। ৬২-এর ছাত্র আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধিনতার জন্য তাঁর যে অবদান দেশবাসীর কাছে তা চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।

তিনি প্রবর্তক বিদ্যাপীঠ থেকে ১৯৬৬ সালে মাধ্যমিক পাস করে সরকারি সিটি কলেজে ভর্তি হন। স্কুল জীবন থেকেই জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতিতে। ১৯৭২ সালে সিটি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। পরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইন আর্টসে ভর্তি হন। ১৯৬৮-১৯৬৯ সালে সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। পরে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

বাধিনতা বিরোধিচক্রের ষড়যন্ত্র, পাকিস্তানি সৈরশাসকের বহু মামলা-হামলা, হয়রানি-নির্যাতনের শিকার কাজী ইনামুল হক দানু ডায়েরীর পাতায় তাঁর সুনিপুন হাতে লিখেছিলেন, “আমি উপলব্ধি করতে পারলাম যে আইয়ুব-মোনায়েম চিরজীবনের জন্য জাতিকে শেষ করে দেওয়ার জন্য শেখ মুজিবকে নিশানা করেছে। সে সময় আমি ঢাকার আর্ট কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়ায় ছিলাম।

আমার সিনিয়র বন্ধু কবি শাহনুর খান ও তার কয়েকজন বন্ধুর সাথে আমার পরিচয় হয়। তারা বর্তমান ১৫ নং ধানমন্ডির পেছনে একটি বাড়িতে মাঝে-মাঝে আড্ডায় বসতেন। তাঁরা যোগ বিয়োগ নামক একটি ক্লাবের সদস্য ছিল। আমি সেই ক্লাবের সদস্য হতে চাইলে আমাকে বলল যে, মোনায়েম খান (তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর) চট্টগ্রাম যাবে ১৬ই নভেম্বর, চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ উদ্বোধন করতে, তারপর সেখান থেকে চকবাজার হয়ে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে যাবে একটি মসজিদ উদ্বোধন করতে। পথে তাকে নাযেহাল করতে হবে।

তাহলেই যোগ বিয়োগ ক্লাবের সদস্য হতে পারবে। আমি এ কাজ করতে পারব বলে চট্টগ্রাম চলে আসলাম। কিন্তু তেমন উৎসাহী সাহসী কাউকে সঙ্গে না পেয়ে আমি নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে অলি খাঁ মসজিদের মোড়ে গর্ভনরের গাড়ী থামিয়ে তার গালে আমার পায়ের জুতা মেরে দিই এবং সাথে সাথে আমাকে গ্রেফতার করা হয়। আমি তখন “স্বাধিন পূর্ব বাংলা” শ্লোগান দিতে থাকলে বাঙালি পুলিশরা আমার মুখ চেপে ধরে বলে-ওরা শুনতে পেলে ফাঁসিতে লটকাবে।

তারপর থেকে আমি ১৯৬৯-এর ২৩ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত কারাগারে ছিলাম। সাথে ছিলেন বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদার, বিমল সেন, কালিপদ চক্রবর্তী, আহমেদুর রহমান আজমী, এমএ মান্নান, এসএম ইউসুপ, মৌলভী সৈয়দ আহম্মদ, সাবের আহম্মদ আজগরী, আব্দুল্লাহ আল নোমান, কমরেড শাহআলম, ওসমান গণি খানসহ আরো অনেকে। কয়েকদিনের জন্য মহিউদ্দিন চৌধুরীকে পাই”। অদম্য সাহস আর বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী কাজী ইনামুল দানু কারাগার থেকে বের হয়ে পূনরায় রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছাত্রজীবনে একজন ফুটবল, ক্রিকেট ও ব্যাটমিন্টন খেলোয়ার, চিত্রশিল্পী, কবি ও একজন ভাল প্রবন্ধকারও ছিলেন। তাঁর লেখা অসংখ্য প্রবন্ধ ও কবিতা বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও স্মরণিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবীদ। কাজী ইনামুল হক দানু ১৯৪৭ সালের ১৪ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিত্রালয় বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার দেবীদ্ধারে।

তাঁর পিতা চট্টগ্রাম শহরের কোতোয়ালী থানার ১৬ নং চকবাজার ওয়ার্ডের জয়নগরে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। এরই সূত্র ধরে চট্টগ্রামেই কাজী ইনামুল হক দানুর বেড়ে উঠার পাশাপাশি চট্টগ্রাম শহরেই রাজনীতি থেকে আরম্ভ করে সমস্ত কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। পিতা কাজী আব্দুল গফুর (বিএ)-এর কর্মস্থল ভারতে হওয়ায় সেই সূত্রে তাঁর জন্মও ভারতে হয়। অবিভক্ত ভারতে রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়াতে তাঁর পিতা চাকরী শুরু করেন। দেশ বিভাগের পর তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানে পরিবার নিয়ে চলে আসেন। ১৯৪৮ সালে তাঁর পিতা পূর্ব পাকিস্তানের ষ্ট্রেট ব্যাংক অব পাকিস্তান চট্টগ্রাম শাখার গোড়াপত্তনে অন্যতম ভূমিকা পালন করেন। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রামের ম্যানেজার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন এবং ১৯৮০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মা আফিয়া খাতুন ছিলেন একজন গৃহিনী। কাজী ইনামুল হক দানু চট্টগ্রামের প্রবর্তক বিদ্যাপিটে ৮ম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে উক্ত বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম সিটি কলেজে ভর্তি হন। সেখানে থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ¯œাতক ডিগ্রী অর্জনের পর ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা অনার্স কোর্সে ভর্তি হন। তিনি ১৯৬৪ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফার প্রচার কাজে বলিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। তাঁর হাতেলেখা পোষ্টার ছিল অসাধারণ। পোষ্টার লেখার জন্য তিনি ছাত্রলীগ নেতা-কর্মিদের কাছে ছিল একমাত্র গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। কারণ তখনও প্রেসে ছাপানো পোষ্টারের প্রচলন হয়নি। তাঁর লেখা পোষ্টারের ভাষা ও শৈল্পিক গুণ ছিল অদ্বিতীয়। ইনামুল হক দানু ৬ দফা আন্দোলনে তৎকালিন চট্টগ্রামের তুখোর ও অত্যন্ত মেধাবী


ছাত্রনেতা এসএম ইউসুপ, মৌলভী সৈয়দ আহম্মদ, কবি শাহনুর খান, গাজী গোফরানসহ প্রমূখ ছাত্র নেতৃত্বের সাথে কাজ করেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সময়ে মাদারবাড়ির সিরাজুল হক মিয়ার বাসভবণে গোয়েন্দাদের চোখে ফাঁকি দিয়ে অন্যান্য ছাত্র নেতৃবৃন্দের সাথে কর্মসূচী নির্ধারণের জন্য গোপন বৈঠকে যোগ দিতেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলারও আসামী হয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৯-এর পহেলা মার্চ পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চের জাতীয় সংসদ অধিবেশন বন্ধ ঘোষনা করলে ছাত্র, যুব, কৃষক, শ্রমিক, কবি, সাহিত্যিকসহ সর্বস্থরের জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। ৩রা মার্চ থেকে তিনি বিভিন্ন ছাত্র যুব সমাবেশে অংশগ্রহণ করার পাশাপাশি ছাত্র যুবকদের নিয়ে গোপনে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য সংগঠিত করেন। বিভিন্ন কলেজ থেকে ক্যামিক্যাল, এক্সপ্লোসিভ বারুদ, সালফার ইত্যাদী জোগাড় করে মলোট ও ককটেল বোমা তৈরী করার কাজ শুরু করেন এবং ব্যক্তিগত বন্দুক-পিস্তল সংগ্রহ করে ছাত্র যুবকদের সাথে প্রশিক্ষণ গ্রহন শুরু করেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম শহর পাকিস্তানি হানাদারেরা দখল করে নেওয়ার পর কাজী ইনামুল হক দানু সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের আগড়তলা চলে যান। সেখানে আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহম্মদ চৌধুরী, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী ও এমএ মান্নানের সাথে দেখা হওয়ার পর তিনি চলে গেলেন ঐতিহাসিক শ্রীধর ভিলায়। এর কয়েকদিন পর বি, এল, এফ-এর অন্যতম নেতা শেখ ফজলুল হক মণির নির্দেশে সৈয়দ রেজা ও আব্দুল কুদ্দুস মাখনসহ ২৮ জনের একটি গ্রæপের সাথে সশস্ত্র ট্রেনিং গ্রহণের জন্য উত্তর প্রদেশের চাক্রাতা জেলার তান্ডুয়া ক্যাম্পে বি, এল, এফ (মুজিব বাহিনী) সদস্য হিসেবে গেরিলা ট্রেনিং গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে আগড়তলার উদয়পুর মহকুমার তেপানিয়া ট্রানজিট ক্যাম্পে কয়েকদিন অবস্থান করেন। সেখান থেকে ১০ জনের একটি গ্রæপ নিয়ে একই সালের ১৩ আগষ্ট ছাগলনাইয়ার শ্রীনগর সীমান্ত দিয়ে মীরেরসরাই সীতাকুন্ড হয়ে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করেন। এই গ্রæপের গ্রæপ কমান্ডার ছিলেন ডা. মাহবুব। তারা চট্টগ্রাম এসে মৌলভী সৈয়দের আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে শহরে বেশ কয়েকজন রাজাকার অপারেশন করেন।

ইতিহাস বিশ্লেষনে জানা যায়, গ্রæপ কমান্ডার সে সময়ে দেশে এসেই লাপাত্তা হয়ে যান। এরপর কমান্ডারের দায়িত্ব পান ডা. জাফর। পরবর্তীতে ডা. জাফর গ্রেফতার হয়ে গেলে কমান্ডারের দায়িত্ব পান কাজী ইনামুল হক দানু। তিনি ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্রæপ কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ইনামুল হক দানু চট্টগ্রাম সিটি কলেজ ছাত্রলীগের নির্বাচনী দল ‘অভিযাত্রিক’ এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের সভাপতি, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক এবং ২০০৬ সালে চট্টগ্রামের মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি চট্টগ্রাম বিজয় মেলা পরিষদের কো-চেয়ারম্যান, স্বাধিনতা মেলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, মুক্তিযুদ্ধ গবেষনা কেন্দ্রের পরিচালক ও চট্টগ্রাম বিজয় মেলা পরিষদের মহাসচিব ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধ পদকে ভূষিত হন। পারিবারিক জীবনে তিনি ও স্ত্রী সামশুন্নাহার বেগমের তিন পূত্র সস্তান। ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে কাজী ইনামুল হক দানু প্রতিরোধযুদ্ধে অবতীর্ন হন। পরে সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার হয়ে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন। এতে করে তাঁর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের প্রচন্ড ক্ষতি হয় এবং ধীরে-ধীরে বিভিন্ন জটিল রোগ তাঁর দেহে বাসা বাঁধতে থাকে এবং ২০১৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী ইনামুল হক দানুর জীবনাবসান ঘটে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। তাঁর রেখে যাওয়া স্মৃতি এবং আদর্শ আমাদের আগামী দিনের পথ চলার পাথেয় হয়ে থাকবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

5 × five =