বাইরে রিয়েল এস্টেট-ভেতরে এমএলএম ‘ব্রাইট ফিউচার’র হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা

0
536

জেমস এ কে হামীম: উত্তরার কসমো সিএনজি পাম্পের পেছনেই ভবনটি সেক্টর-৭, রোড-৫, বাড়ি নম্বর-৭। অসচছ থাইগ্লাসে আবদ্ধ ছোট ছোট খুপড়ি। ভেতরে প্লাস্টকিরে চেয়ার। কয়েকটি টেবিল ঘিরে নারী-পুরুষরে জটলা। চলছে চাপা স্বরে কথার ফিসফাস। মনে হতে পারে রবি শস্যের আড়ৎ। মানুষ আসছে-যাচ্ছে। কারো হাতে পুটলি। কারো কাছে বগলদাবা করা কার্টুন। কিন্তু না তারা কোনো গৃহস্থ নন। ভিড়মি খেতে হয় তখনই যখন এসব পুটলি থেকে বেরিয়ে আসে অন্যি কছু। অবিশ্বাস্যই বটে। যেন এক ‘টাকার আড়ৎ’ খোলা হয়েছে। বাইরে থেকে বোঝার জো নেই। সিসি ক্যামেরার নজরদারি গলে খানিকটা মাথা ঢোকালেই চোখে পড়ে ‘ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিংস লিমিটেড’ সাইনবোর্ড।

ভেতরে নগদ টাকার খেলা।হাউজিং ব্যবসার আড়ালে অভিনব পদ্ধতিতে চলছে এমএলএম প্রতারণা। বাইরে রিয়েল এস্টেট-ভেতরে অবৈধ এমএলএম। সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি প্রকাশ্যেই চলছে এ প্রতারণা। স্ট্যাম্পে প্লট বিক্রির ভুয়া চুক্তিনামার বিপরীতে পাঁচ বছরে গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে ৮শ’ কোটি টাকা। সরকার দলীয় দু’জন ছাত্রনেতা এবং স্থানীয় প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়া রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির ওপর। রয়েছে সাবেক দু’জন প্রভাবশালী মন্ত্রীর আশীর্বাদ।

‘করপোরেট কার্যক্রম’ চালাতে সামনে রাখা হয়েছে প্রতরিক্ষা বাহিনীর কিছু অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। ‘গ্রাহক’ শিকারে ব্যবহার করা হচ্ছে বন্ধ হয়ে যাওয়া ডেসটিনি, ইউনি পেটু’র প্রশক্ষিতি প্রতারক এবং সুন্দরী রমনী। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এসব তথ্য। রিয়েল এস্টেটের আড়ালে এমএলএম: ডেসটিনি-২০০০ লি:, ইউনি পেটু’ গ্রাহকের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর মাল্টি লেবেল মার্কেটিং বা এমএলএম বৈধতা পায়নি। কিন্তু রয়ে গেছে প্রতিষ্ঠান দুটিতে কাজ করা হাজার হাজার প্রশক্ষিতি কর্মী।

ডেসটিনির প্রশিক্ষিন কাজে লাগিয়ে অভিনব কৌশলে নব উদ্যোমে তারা করেছেন এমএলএম প্রতারণা। অপরাধমূলক কাজটির দাপ্তরিক বৈধতা দিতেই সংঘবদ্ধ চক্র হাউজিং কোম্পানির আশ্রয় নেয়। চক্রের নেতৃত্বে রয়েছেন রংপুরের আক্তার হোসেন, চাঁদপুরের মিজানুর রহমান, ঢাকার মুগদার মো. আলাউদ্দিন ও তার স্ত্রী, মাদারিপুরের নার্গিস বেগম, সায়মা আক্তার, মাহমুদা আক্তার, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আল আজহার আলীসহ ৪৪ জন। তারা ‘ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিং লিমিটেড’ নামে ট্রেড লাইসেন্স এবং জয়েন্ট স্টক থেকে কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন নেন।

কথিত এই রিয়েল এস্টেট কোম্পানির না আছে বৈধতা, না আছে স্বীকৃতি। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত রিয়েল এস্টেট কোম্পানির তালিকায় ‘ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিংস লিমিটেড’ নামক কোনো হাউজিং কোম্পানির অস্তত্বি¡ নেই। অথচ ঢাকার শেষ প্রান্তে আশুলিয়া ইয়ারপুর ইউনিয়নের ইছরকান্দি মৌজায় দেদারছে ‘বিক্রি’ করছে অস্তত্বিহীন প্লট। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব বলেন, রাজধানীর বাইরে কোনো আবাসন প্রকল্প করতে হলে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষরে অনুমোদন লাগে। ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিংস লি: নামক কোনো কোম্পানি অনুমোদন নিয়েছে বলে আমার জানা নেই। তবে কোনো হাউজিং কোম্পানি প্লট বিক্রির পরিবর্তে দ্বিগুণ অর্থ ফেরত দেয়ার প্রলোভনে আমানত সংগ্রহ করতে পারে না।

যেভাবে হাতিয়ে নেয় অর্থ : অনুমোদন না থাকলেও দেদারসে চলছে প্লটরে কাল্পনিক বেচা-কেনা। মূল বিষয় হচ্ছে এমএলএমের মাধ্যমে প্রতারণামূলক ভাবে গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়া। এটিরই দাপ্তরিক বৈধতা দিতে ‘ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিং লিমিটেড’র সঙ্গে গ্রাহকের একটি ‘চুক্তি’ দেখানো হয়। কথিত চুক্তিতে প্লট বুকিংয়ের কথাই উল্লখে করা হয়। কিন্তু প্রকল্পটি ভুয়া এবং কাল্পনিক হওয়ায় বাস্তবে কোনো প্লটই দেয়া হয় না। বিনিয়োগের ‘লভ্যাংশ’ হিসেবে দ্বিগুণ অর্থ ফেরত দেয়ার প্রলোভন দেয়া হয়। প্রথম ছিলো ২৪ মাসে দ্বিগুণ।

অর্থাৎ ১ লাখ টাকায় দুই বছরে লাভ দেয়া হবে ২ লাখ টাকা। কখনো ৪৮ মাস, ৩০ মাস এবং কখনো ৪৮ মাসে দ্বিগুণ লাভ দেয়ার প্রলোভন দেয়া হচ্ছে। এমএলএম সিন্ডিকেটের চটকদার কথাবার্তায় প্রলুব্ধ হয়ে সীমীত আয়ের মানুষ ব্রাইট ফিউচার লিমিটেড নামক এমএলএম কোম্পানিতে রাখছে টাকা। এ প্রক্রিয়ায় এমএলএম প্রতিষ্ঠানটি গত ৫ বছরে ১৪ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ৮ শ’ কোটি টাকা। তবে এ অর্থ শুধু ‘উদ্যোক্তা’ ৪৪ জনের পকেটেই যায়নি।

নিয়মিত ভাগ পাচ্ছেন প্রভাবশালী সাবেক দুই মন্ত্রী, সরকার দলীয় স্থানীয় নেতা, পুলিশ প্রশাসন। বদৌলতে উত্তরার মতো অভিজাত এলাকায় টানা ৫ বছর ধরে বিনা বিপত্তিতে চলছে অর্থ লোপাট। সর্বস্বান্ত হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। পক্ষান্তরে দেশ-বিদেশে বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লটসহ কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এমএলএম’ প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তারা। ক’দিন আগেও সংসার চালাতে যাদের কষ্ট হতো তারা এখন চালাচ্ছে দামী গাড়ি। দেদারসে অর্থ হাতিয়ে নিতে শীর্ষ কর্মকর্তারা আত্মগোপনে থেকে অর্থ সংগ্রহে ব্যবহার করেন স্বল্প শিক্ষিত, অর্ধশক্ষিতি বেকার তরুন, তরুনি, সুন্দরী গৃহিনী, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ, প্রকৌশলী, ব্যর্থ ব্যবসায়ী এবং আমলাদের। পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে কারো কাছে ধরা দেয় না ‘ব্রাইট ফিউচার লিমিটেড’ এমএলএম কোম্পানি।

কয়েকটি কোটি টাকা বিনিয়োগের টোপ ফেলে সায়মা আক্তার নামক পরিচালকের বশ্বিস্ততা অর্জন করেন এ প্রতিবেদক। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানের ভাইস চেয়ারম্যান মো: মিজানুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: আকতার হোসেন, পরিচালক (প্রশাসন) আলাউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে রুদ্ধদার বৈঠকেই জানা যায় তাদের প্রকৃত কার্যক্রম সম্পর্কে। গোপন ডিভাইসে ওই বৈঠক ধারণ করা হয়। তাতে রিয়েল এস্টেট কোম্পানির আড়ালে এমএলএম পরিচালনা এবং শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার স্বীকারোক্তি রয়েছে।

উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের ৭ নম্বর বাড়িটি মূলত: প্রতিষ্ঠানটির করর্পোরেট শাখা। ১ থেকে ১০ লাখ টাকার অর্থ সংগ্রহের জন্য এ ঠিকানা ব্যবহৃত হয়। অংক ১০ লাখ টাকা থেকে ১০ কোটি পর্যন্ত টাকার জন্য লগ্নিকারীকে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বাড়ি নং-১/এ, রোড-৬, সেক্টর-৩, উত্তরা কথিত ‘হেড অফিস’ এ। এটি মূলত: ভাড়া বাসা। ‘বড় লগ্নিকারী’র সঙ্গে এ বাড়িতে বৈঠক করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিগণ। তবে উত্তরা এলাকায়ই প্রতিষ্ঠান দুটির গোপন কার্যালয় রয়েছে। এসব কার্যালয়ে সারাদিন কর্তাব্যক্তিরা বক্ষিপ্তিভাবে অবস্থান করেন। ‘ভালো পার্টি’র ঘ্রাণ পেলে একত্রিত হোন ‘হেড অফিস’ এ। হেড অফিসে সন্ধ্যার পর ব্যাগ ও বস্তা ভরে টাকা আসতে থাকে। গত ৪ এপ্রিল প্রতিবেদকের সঙ্গে বিকেলে বৈঠক চলাকালেও দুটি ব্যাগে ভরে টাকা আসে।

কর্মকর্তাদের অকপট স্বীকারোক্তি: কোম্পানির কোনো প্রোফাইল-প্রোফর্মা পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু ‘ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিংস লিমিটেড’ এ ১০ কোটি ‘কালোটাকা’ লগ্নির প্রস্তাব দিলে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সায়মা আক্তার সম্মত হন এ প্রতিবেদকের সঙ্গে এমএলএমটি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চেয়ারম্যানসহ কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাত করিয়ে দিতে। উত্তরাস্থ করপোরেট অফিসে যেতে যেতেই স্বীকারোক্তি দেন সায়মা। তিনি উল্লেখ করেন, সারাদেশে ১২ হাজারের মতো অভিজ্ঞকর্মী রয়েছেন। প্রথমে তারা নিজেরা এ প্রতিষ্ঠানে লগ্নি করেন, পরে দ্বিগুণ লাভের প্রলোভন দিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে আসেন।

কথিত এ কর্মীবাহিনী মুলত: নিষিদ্ধঘোষিত ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেড, ইউনি পে-টু ইউ, ফার্স্টওয়ে, খুলনার ‘নিউ বুসন্ধরা’র মতো এমএলএম কোম্পানি থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছেন। ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিং লি:কে রিয়েল এস্টেট কোম্পানি বলে দাবি করা হলেও এটির কোনো প্রচার-প্রচারণা নেই। কোনো সাইনবোর্ড নেই, বিজ্ঞাপন নেই, নেই কোনো ওয়েবসাইটও। কোনো প্লটও বিক্রি করা হয় না। একটি প্লটও হস্তান্তর করা হয়নি এ যাবত। মানুষকে শুধু অর্থলগ্নিতে প্রলুব্ধ করা হয়। বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য পরের গ্রাহকের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে পূর্বের গ্রাহকের ‘প্রফিট’ পরিশোধ করা হচ্ছে। ক্রমাগত অর্থ আসতে থাকায় প্রফিট প্রদানেও কোনো গড়িমসি করে না।

ফলে শুভংকরের ফাঁকিটা এখনো গ্রাহকের কাছে স্পষ্ট নয়। কিন্তু কোনো প্লটও বিক্রি না করে কিভাবে দ্বিগুণ প্রফিট দিচ্ছেন-এ প্রশ্ন করলেই আটকে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। সে ক্ষেত্রে মুহূর্তের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম গুটিয়ে কর্মকর্তারা গা ঢাকা দেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও রেকর্ডপত্রে তাদের ধরার মতো কিছু নেই। লক্ষ লক্ষ টাকার লেনদেন হচ্ছে নিজেদের ছাপানো মানিরিসিপ্টে। ব্যাংকে লেনদেন নাম মাত্র। কিছুদিন ধরে স্ট্যাম্পে ভুয়া বুকিং চুক্তিনামা করা হচ্ছে। পরবর্তীতে সেটিও বাতিল করা হয়।

স্বীকারোক্তিতে পরিচালক সায়মা আক্তার জানান, সর্বশেষ রাজধানীর বনানীতে টিপিএস নামক একটি কোম্পানিতে ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিংস লি:র কর্মকর্তারা কাজ করতেন। সেটিও ছিলো রিয়েল এস্টেট কোম্পানির আড়ালে এমএলএম। ওই কোম্পানি ১ লাখ টাকায় দ্বিগুণ লাভ দিতো। ফলে কোম্পানিটি বেশি ‘লাভজনক’ ছিলো না। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ব্রাইট ফিউচারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আক্তার হোসেন, সায়মা আক্তার, আলাউদ্দিন আহমেদ, নার্গিস এবং মাহমুদাসহ ১৪ জন আলাদাভাবে এমএলএম ব্যবসা শুরু করেন ‘ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিং লিমিটেড’ নাম দিয়ে।

এটির চেয়ারম্যান করা হয় অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আল-আজহারকে। তিনি এখন ‘ব্রাইট সিটি’র প্রজেক্টের প্রকল্প পরিচালকও। ব্রাইট ফিউচারে বর্তমানে ৪৪ জন পরিচালক রয়েছেন। অভিনব পদ্ধতি এবং অতিরিক্ত লাভ দেয়ার কারণে এমএলএম কারবারিদের মাঝে দ্রুত প্রসার ঘটে প্রতিষ্ঠানটির।

গত চার-পাঁচ বছরে ১২ হাজার লগ্নিকারীর কাছ থেকে ৮শ’ কোটি টাকার মতো ‘আমানত’ সংগ্রহ হয় তাদের। সাভারের শেষ প্রান্তে ইয়ারপুর ইউনিয়নের ইছরকান্দি মৌজায় জমি কেনা হয়েছে ১ শ’ বিঘার মতো। সায়মা জানান, মূলত: কালো টাকা সাদা করার উদ্দেশ্যেই বিনিয়োগের এ সুযোগ দেয়া হয়েছে। এখানে কে কত টাকা বিনিয়োগ করলেন কাকপক্ষী জানে না। এমনকি একজন ডিরেক্টর আরেক জনের খবর জানেন না।

এ অর্থ কোথায় যায়, কি কাজে ব্যয় হয় এটি জানেন আখতার হোসেন, আলাউদ্দিন আহমেদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আল-আজহার আলী ছাড়া কেউ জানেন না। তবে প্রতিষ্ঠানটির ভাইস চেয়ারম্যান (নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) মিজানুর রহমান জানান, ডাচবাংলা ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংকসহ ৭/৮টি ব্যাংকে ব্রাইট ফিউচারের একাউন্ট রয়েছে। লেনদেন বেশি হয় ব্র্যাক ব্যাংকে। সোনালি ব্যাংক এবং রূপালি ব্যাংকেও একাউন্ট রয়েছে।

এসবে কম-বেশি লেনদেন হয়। এসব একাউন্ট বেশিরভাগই ব্রাইট ফিউচারে পরিচালক এবং তাদের বিশ্বস্ত আতœীয়-স্বজনদের। এসব লোক দেখানো। কালোটাকা বিনিয়োগের সুবিধার কথা বলে অর্থ লেনদেনের দালিলিক কোনো প্রমাণই সৃষ্টি করে না এমএলএম কোম্পানিটি। কোটি কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে নগদে। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী, গোয়েন্দাসংস্থা, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর এবং গণমাধ্যমকে ফাঁকি দিতেই প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংকের দ্বারস্থ হয় না। কোনো কর্মী বড় অংকের টাকা নিয়ে আসতে পারলে বেশি কমিশন দেয়া হয়।

এটির হার ৪ থেকে ৮ শতাংশ পর্যন্ত। দু’তিন কোটি টাকা আনতে পারলে পরিচালক হিসেবে কোম্পানিতে নিয়ে নেয়া হয়। কালো টাকা সাদা করার উদ্দেশ্যে ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিংসে আসে। বৈঠকের আলোচনায় ভাইস চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান জানান, খুব ছোট থেকে তারা প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম শুরু করেন। এখন এটির পরিধি অনেক। কৌশল হিসেবে প্লট বাণিজ্য এড়িয়ে শুধু ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম হাতে নেন। এখন একটি সিটি করার প্রস্তাব দিয়ে অর্থলগ্নিকারীদের প্রলুব্ধ করছেন। নাম করা হয়েছে ‘বেস্ট হোম ডেভলপার্স লি:’।

তবে অর্থ হাতিয়ে শিগগিই গুটিয়ে নেয়ার ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে টি আর চালাবো না। একটা ডুপেক্স সিটি করবো। হসপিটাল করবো।’ কিভাবে এত দ্রুত উন্নতি করলেন-জানতে চাইলে মিজানুর রহমান বলেন, ১ লাখ টাকা দিলে আমরা ২৪ মাসে ২ লাখ টাকা দেবো। পরে ১ লাখে ৩০ মাসে দ্বিগুণ অর্থ দেয়ার প্রকল্প হাতে নিই। ৪৮ মাসে ২ দ্বিগুণ মুনাফা দেয়ার প্রকল্প চলছে এখন। অনেকগুলো সেগমেন্ট আছে। আমরা অনেককে অর্থ দিচ্ছি। প্রতিনিয়তই ডিসকার্ট হচ্ছে। অন্যদিকে অনেক লগ্নিকারী কোটি কোটি টাকা অর্থ এখানে বিনিয়োগ করছেন।

তিনি বলেন, এখানে সরাসরি কেউ আসতে পারে না। রেফারেন্সে আসতে হয়। আমরা কাউকে জোরাজুরি করছি না। চাপও দিচ্ছি না। যার ইচ্ছে তিনি আসবেন। তবে এটি আপনাকে আশস্ত করছি যে, শেষ ৫ বছর যে প্রতশ্রিুতি গুলো দিয়েছি সে অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে তাদের প্রফিট সেভাবে দিয়েছি। লগ্নিকারীর নিরাপত্তা কতখানি-জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনার টাকার নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা শত ভাগ। আপনি কিভাবে টাকা দিতে চান? ১ লাখ টাকার ডাবল অপারচুনিটি।

ব্যাংকের একাউন্টে আপনার প্রাপ্য অর্থ চলে যাবে। কিভাবে এ টাকা আদান-প্রদান হবে এটি কোনো সমস্যাই নয়। বিষয়টি নির্ভর করছে আপনারা কিভাবে দিতে চান ? কিছু ক্যাশ। কিছু বিকাশ। কিছু অ্যাকাউন্টে দিন। এশিয়া, ডাচবাংলা ব্যাংকে আমাদের একাউন্ট আছে। ডাচবাংলা ব্যাংকের উত্তরা শাখা, উত্তরা আড়ং সংলগ্ন ব্র্যাক ব্যাংক শাখা, ব্যাংক এশিয়ার রবীন্দ্র সরণি শাখায়ও দিতে পারেন।

তিনি জানান, ইছরকান্দি প্রকল্পে ৮৫ বিঘার মতো জমি কেনা হয়েছে। টার্গেট ৩শ’ বিঘা। এমএলএম কোম্পানিটির পরিচালক (প্রশাসন) আলাউদ্দিন আহমেদ। রাজধানীর সবুজবাগে স্থায়ী নিবাস। ইতিপূর্বে কয়েকটি এমএলএম কোম্পানিতে লগ্নি করে নি:স্ব হয়ে যান। এক পর্যায়ে আবাসকি হোটেেল চাকরি করেন। কিন্তু ব্রাইট ফিউচার হোল্ডিংস লি:’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে ‘বেশ ভালো’ আছেন বলে জানান।

শ্যালকের নামে কেনা ৪০ লাখ টাকা দামের গাড়িটি নিজেই ড্রাইভ করেন। এ প্রতিষ্ঠানে পরিচালক হিসেবে রয়েছেন তার স্ত্রীও। স্বীকারোক্তিতে আলাউদ্দিন আহমেদ জানান, এমএলএম করে আমি শেষ হয়ে গিয়েছিলাম। পরে হোটেলে চাকরি করতাম। যেভাবেই হোক বের হয়ে গেছি। এখন ব্যবসা একটা দাঁড় করিয়েছি। আমি এটির ফাউন্ডার ডিরেক্টর নই। ৬ মাস পরে যোগ দিয়েছি। এখন আমি ডিরেক্টর (এডমিন) । ওয়ান পার্সেন্ট শেয়ার আমার। স্ত্রীও ডিরেক্টর। মাত্র ৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করি। এখনতো ২০ লাখ টাকাও শেয়ার পাওয়া যায় না। মাঝে দেড়-দুই মাস রাগ করে অফিসে আসিনি। দুই মাস পর কাজ শুরু করি। প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান ছিলাম। তখন ম্যানেজমেন্টে ছিলেন ৪ জন।

যখন দেখলাম কোম্পানিটির অবস্থা ভালো হবে তখনই যুক্ত হলাম। ৬ মাসের মধ্যে কোম্পানি অনেক ডেভলপ করেছে। প্রথম শুরু করি ২ বিঘা জায়গা দিয়ে। এখন প্রায় ১শ’ বিঘ জায়গা কিনি। ৫ বছরে কোম্পানিতে কোটি কোটি টাকা দিয়েছেন এবং নিয়েছেন। যে যার লভ্যাংশ নিয়ে চলে গেছেন। দীর্ঘ দিন লেনদেনে যদি উনিশ-বিশ থাকতো তাহলে ব্যবসা এতদিন চলতে পরতো না। এখন কেউ যদি এসে বলে যে, আমার টাকা দেয় না। তাহলে ব্যবসা ডাউন হতে ১০ মিনিট সময় লাগবে না। তাই এদিকে আমরা খুব সতর্ক।


এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক (মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ) মীর জয়নুল আবেদীন শিবলি বলেন, প্রতারণা লব্ধ অর্থ স্থানান্তর, রূপান্তর, পরিবর্তন এবং পাচার স্পষ্টতই মানিলন্ডারিং আইনের আওতায় পড়ে। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত পেলে দুদক বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে পারে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

5 × one =