ডিবির এসআই আক্রামের রোষানলে সাংবাদিক রফিকের সর্বনাশ

0
803

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি: ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল । এই সময়ে ময়মনসিংহে কর্মরত পুলিশের এক উপ পরিদর্শকের (এসআই) পৃষ্ঠপোষকতা ও সংশ্লিষ্টতায় ঘটে মাদকের জমজমাট ব্যবসা । যৌনপল্লীতে নারী পাচারের ঘটনা । সন্ত্রাস আর অস্ত্রের ঝনঝনানিসহ অপরাধ কার্যক্রম । এই অপরাধ কার্যক্রমের পেছনে ছিল যার হাত তিনি এসআই আক্রাম হোসেন । এসব অপরাধ কার্যক্রমে ছিল নিজের প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ সম্পৃক্ততা । এসবের সাথে যুক্ত করেন গ্রেপ্তার বাণিজ্য । হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা । সেই সময়ে র্যাবের অভিযানে উদ্ধার হয় অস্ত্র ও বিপুল মাদক ও গ্রেপ্তার হয় সংশ্লিষ্ট অনেকেই । এসআই আক্রাম হোসেনের এহেন কর্মকান্ডের সংবাদ প্রকাশ হয় দৈনিক ময়মনসিং প্রতিদিনহসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে । এতেই আক্রামের রোষানলে পড়েন দৈনিক ময়মনসিংহ প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদক, দৈনিক আমাদের কন্ঠের বিশেষ প্রতিনিধি খায়রুল আলম রফিক । দৈনিক ময়মনসিংহ প্রতিদিনে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদের ধারাবাহিকতায় শহরের চরপাড়ায় মাদক কারবারিদের সাথে এসআই আকরাম হোসেনের ঘনিষ্টতা বিষয়ে একটি সংবাদ প্রকাশ হয় । সেসময় এসআই আক্রাম হোসেন কর্মরত ছিলেন ৩নং ফাঁড়ি পুলিশে ।

এসব সংবাদে তার ঘুষ বাণিজ্য ও গ্রেপ্তার বাণিজ্যে ধ্বস নামে । ক্ষুব্ধ হন সাংবাদিক রফিকের ওপর । এ থেকেই একের পর এক রোষানলে পড়তে থাকেন সাংবাদিক রফিক । এরই মাঝে আক্রাম হোসেন যোগদান করেন ময়মনসিংহ জেলা গোয়েন্দা সংস্থা ডিবি পুলিশে । কাজের পরিধি বেড়ে যাওয়ায় এই এসআই আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেন । উপরোক্ত অপরাধমূলক কর্মকান্ডের মাত্রা বাড়িয়ে দেন । জেলার বিভিন্ন স্থানে তার নিয়ন্ত্রিত ও সুবিধাভোগী মাদক ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে প্রতিপক্ষ মাদক ব্যবসায়ী ও নিরীহ মানুষকে মাদক কারবারি হিসাবে আখ্যায়িত করে গ্রেপ্তার করে এনে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেন । মানসম্মানের ভয়ে গ্রেপ্তারের শিকাররা আক্রাম হোসেনকে টাকা দিতে বাধ্য হন । আর যারা তার দাবীকৃত টাকা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন গ্রেপ্তারের পর থেকে তাদের জীবন থেকে ততদিনে চলে গেছে দর্গি সময়। কারাগারে বন্দী থেকে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন তারা। দৈনিক ময়মনসিংহ প্রতিদিনে আক্রামের গ্রেপ্তার বাণিজ্যেও সংবাদ শিরোনাম হয় । ঐ সময় ডিবির ওসি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন, আশিকুর রহমান ও মোখলেছুর রহমান । সেময় উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিভ্রান্ত করে আক্রাম বাগিয়ে নেন শ্রেষ্ঠ এসআইয়ের পুরষ্কারও ।

সুচতুর এই এসআইয়ের কর্মকান্ড নজর এড়াতে পারেনি তৎকালীন পুরিশ সুপার নুরুল ইসলাম পিপিএমের । এসপি তাকে বদলী করেন জেলার মুক্তাগাছা থানায় । আক্রাম মুক্তাগাছায় যোগদান না করে সুযোগ খুঁজতে থাকেন । এরই মাঝে বদলী হন এসপি নুরুল ইসলাম । এই সুযোগে তিনি আবারও যোগদান করেন ময়মনসিংহ ডিবিতে । ক্ষমতার দম্ভে স্বঘোষিত ডন হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে থাকেন । হয়ে উঠেন বেপরোয়া । সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ করে আবারও তার রোষানলে পড়েন সাংবাদিক রফিক । শুধু রফিকই নন, সাংবাদিক আব্দুল কাইয়ুম তার মতো আরও অনেকেরই জীবন আজ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে । অনেকে তার নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে জীবন বিপর্যস্ত । এসআই আক্রাম হোসেন সাংবাদিক রফিককে আটক করে হেফাজতে রাখার নামে অকথ্য নির্যাতন চালায় যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। আক্রামের যোগসাজশে ষড়যন্ত্রমূলক ৩টি মামলায় গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘ দুই মাস থাকতে হয় ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে ।

এরআগে তার চোখ বেঁধে অকথ্য নির্যাতন করে এসআই আক্রাম হোসেন । ২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর খায়রুল আলম রফিককে গ্রেপ্তার করে এসআই আক্রাম হোসেন । গ্রেপ্তার করার পর থেকেই খায়রুল আলম রফিকের চোখ বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয় । নির্যাতনের ছবি তুলে প্রতিপক্ষের হাতেও তুলে দেন এই পুলিশ কর্মকর্তা । এসব ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় । এরপর রফিককে আসামি করে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় মামলা । এসআই আক্রাম হোসেন অমানুষিক নির্যাতন করে সাংবাদিক রফিককে অন্ধ ও পঙ্গু করে দিয়েছে । রফিকের দুচোখ ও পেছন থেকে দুই হাত বেঁধে ডিবি কার্যালয়ের ফ্লোরে ফেলে আলমারীর সাথে হেন্ডকাপ পড়িয়ে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে হাত পা ও কোমড়ে বেধড়ক পিটুনি, পায়ের তালুতে , গরম পানি ঢুকিয়ে দেওয়া, কলম দিয়ে আঙুলের নখে চাপ দেওয়া ও নখ উপড়ে ফেলা, ফ্লোরে চিৎ করে শুইয়ে হাত-পা চেপে ধরে নাকে-মুখে লাথি এবং মুখের ভেতরে গামছা ঢুকিয়ে নির্যাতন করে আক্রাম হোসেন। এতে সাংবাদিকের রফিকের যৌনশক্তি হারিয়েছে যাওয়ার মত । শরীরের বিভিন্নস্থানে ইনফেকশন ধরা পড়েছে। চোখ নষ্ট হয়ে গেছে প্রায় । চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও চোখ,কান খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

তিনি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারবেন কিনা তা বলা যাচ্ছে না। তার উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন । সাংবাদিক খায়রুল আলম রফিক জানান, ২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর রাত ১১টার দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গেইটের বিপরীত দিকে আমি অবস্থান করছিলাম । এসআই আক্রামের নেতৃত্বে ডিবি পুলিশ আমার চোখ বেঁধে একটি কালো গাড়িতে করে আমার পত্রিকার কার্যালয়ে নিয়ে যায় । সেখানে থাকা আমার জমি ক্রয়ের দলিল, ব্যাংকের চেক ও কম্পিউটার জব্দ করে । দলিল ও ব্যাংক চেক প্রতিপক্ষের কাছে তুলে দিয়ে জব্দ দেখানো হয় শুধু কম্পিউটার । সেখান থেকে আমাকে নেয়া হয় ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র পুরাতন গুদারাঘাটস্থ দুর্গম চর এলাকায় । দুচোখ বেঁধে দু হাত পেছনে বেঁধে নির্যাতন চালানো হয় । এসময় আক্রাম হোসেনের মোবাইলে একজন ফোন করে বলে যে, এখন আর ক্রসফায়ারে দেয়ার দরকার নাই । টিভিতে তাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে । এসআই আক্রাম তখন গালি দিয়ে বলে যে, সাংবাদিকের বাচ্চা , অসভ্যের বাচ্চা । তুই আজ বেঁচে গেলি । টেলিভিশনে সংবাদ হওয়ায় কারণে । এসআই আক্রামের নেতৃত্বে রফিককে নেয়া হয় ডিবি কার্যালয়ে । ডিবি অফিসে একটি আলমারির নিচে তাকে ফেলে রাখে । এসময় আক্রাম সংবাদিক রফিককে উলঙ্গ করে ভিডিও ধারন করেন ও ছবি তুলেন । সেসব ছবি প্রতিপক্ষের হাতে তুলে দেন আক্রাম হোসেন । ভিডিও রেখে দেন নিজের কাছেও । সাংবাদিক রফিক তার চোখ বাঁধা অবস্থায় শুনতে পায় কয়েকজনকে আক্রাম বলছে, তোমরা প্রত্যেকে ৫শ’ টাকা করে নিয়ে যাও ।

ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে প্রচার কর যে, একে চাঁদাবাজির অভিযোগে আটক করা হয়েছে । এসময় তারা বলে, ৭১ টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে চাঁদাবাজির অভিযোগে রফিক আটক । কিন্তু রহস্যজনক কারণে সাংবাদিক রফিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে( আইসিটি) মামলা দেয়া হয় । মামলার বাদী করা হয় একজন শিক্ষক । সাংবাদিক খায়রুল আলম রফিক বলেন, ডিবি কার্যালয়ে দীর্ঘ ১৬ ঘন্টা খাবার এমনকি পানিও দেয়া হয়নি আমাকে । কান্নকাটি শুরু করি । এসময় ডিবির ওসি (তদন্ত) ফারুক হোসেন দয়াপরবশ হয়ে আমার খাবার ও পানিও দেওয়া হয়নি। ২মাস কারাভোগের পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাই । যদিও আক্রামের কাছে থাকা তার উলঙ্গ ভিডিও যা আজ রফিকের আতঙ্কেও কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে । ভিডিও কোন কাছে ব্যবহার করবে এসআই আক্রাম হোসেন তা নিয়ে চিন্তিত তিনি । রফিক আরো বলেন, একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছি, সেদিন রাত ১২টার দিকে আমাকে ক্রস ফায়ারে দেয়ার চেষ্টা করে আক্রাম । আমাকে হত্যা করতে আক্রাম ১৫ লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয় । এজন্য ৭লাখ টাকা অগ্রিম নেয় সে । এখনও আক্রাম আমাকে হুমকি দিচ্ছে । আমাকে শাশায় । বলে তুই নেত্রকোনা থেকে এসেছিস । কুত্তার বাচ্চা তুই বাড়াবাড়ি করিস ।

ময়মনসিংহ নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের জামালপুরের লোকজন । এটা জেনে রাখিস । এখনও আক্রাম আমাকে জানে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে যাচ্ছে । রফিক বলেন, আমার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার বাদীগণ স্ট্যাম্পের মাধ্যমে মামলা আপোষ করেছেন । তাদের তাদের সাথে আমার কোন বিরোধ নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়,আইজিপি বরাবরে এসআই আক্রামের বিরুদ্ধে অভিযোগ করি । অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাকে বদলী করা হয় জেলার ঈশ্বরগঞ্জ থানা, এর ২০দিন পর নেত্রকোনা এবং এক মাস পর নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে । জানা যায়, প্রভাবশালী ও ময়মনসিংহে ডন হিসাবে খ্যাত এসআই আক্রাম মাদক ব্যবসা , গ্রেপ্তার বাণিজ্য ও নিরীহদের ধরে এনে নির্যাতনের মাধ্যমে টাকা আদায় করে ময়মনসিংহ শহরের পুলিশ লাইনের সামনে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছেন চকচকে বাড়ি । এছাড়াও তার রয়েছে নামে বেনামে ব্যাংক ব্যালেন্স ও অগাধ বিত্ত বৈভব । এদিকে আদালত থেকে জামিন ও মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে সাংবাদিক রফিক হারিয়েছেন ভিটে বাড়ি । বন্ধ হয়ে গেছে তাদের সন্তানদের পড়া লেখা। পরিবার নিয়ে চরম অভাব অনটনে দিন কাটছে তার। সংসার চালাতে ও মামলা খরচের ঘানি টানতে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন অবশিষ্টও ।

নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি আজ পঙ্গু ও অন্ধ প্রায় । চোখে ঝাপষা দেখেন। চলা ফেরায় কষ্ট । রফিকের আত্বীয়- স্বজন ও সহকর্মীরা বলেন, সাংবাদিক হিসাবে রফিক অত্যন্ত সৎ, পরোপকারি । তিনি সর্বদা মানুষের উপকার করে থাকেন । এসআই আক্রাম তাকে পঙ্গু করলো । অন্ধ বানালো, আবার তাকে জেলেও ঢোকালো। ভালো একজন মানুষের ওপর এমন অত্যাচার আল্লাহ সহ্য করবেন না । রফিক জানান, এসআই আক্রামের কর্মকান্ডের বিচ্যুতি, অপেশাদারসুলভ বা অপরাধমূলক আচরণ এবং অবৈধ কর্মকান্ডের অভিযোগ এনে প্রতিকার চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ও আইজিপি বরাবর অভিযোগ দায়ের করি । অভিযোগের তদন্তকারী তৎকালীন এডিশনাল এসপি ময়মনসিংহ সদর সার্কেল মো: আল আমীন সঠিক তদন্ত না করে প্রকৃত বিষয় আড়াল করে প্রতিবেদন দেন । সাংবাদিক রফিক চোখ বাঁধা আক্রামের নির্যাতনের ছবিযুক্ত করে আবারও অভিযোগ করেন । বর্তমান জেলা পুলিশ সুপার আহমার উজ্জামান পিপিএম এসআই আক্রামকে বদলী করেন । জেলার ঈশ্বরগঞ্জ থানায়। কয়েদিন পর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আবারও বিভ্রান্ত করে পোস্টিং নেন নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ থানায় ।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

4 × two =