তাহাজ্জুদ সম্পকে আরো জানুন

0
1712

[تهجد‎‎] রাতের সালাত বা কিয়ামুল লাইল নামেও পরিচিত, ইসলাম ধর্ম অনুসারীদের জন্যে একটি ঐচ্ছিক ইবাদত।

এটা বাধ্যতামূলক পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের অন্তর্ভুক্ত নয়। ইসলামের নবী মুহাম্মদ নিয়মিত তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতেন এবং তার সাহাবীদের এটা পালনে উৎসাহিত করতেন।

কুরআনে তাহাজ্জুদ :

০১। ‘তারা রাতের সামান্য অংশই নিদ্রায় অতিবাহিত করে এবং রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করে।’ [সূরা আয-যারিয়াত, ৫১:১৭-১৮]

০২। আল কুরআনের ৭৩ নং সূরা আল মুজাম্মিলে উল্লেখ করা হয়েছে ‘অবশ্য রাতে ঘুম থেকে উঠা মনকে দমিত করার জন্য খুব বেশি কার্যকর এবং সে সময়ের কুরআন পাঠ বা জিকর একেবারে যথার্থ।’

০৩। ‘আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা, যারা তাদের রবের দরবারে সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকেই রাত কাটিয়ে দেয়।’

[সূরা আল ফুরকান ২৫:৬৪]

০৪। ‘তারা ছিল কঠিন পরীক্ষায় পরম ধৈর্যশীল, অটল-অবিচল, সত্যের অনুসারী, পরম অনুগত। আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ উৎসর্গকারী এবং রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহর কাছে ভুলত্রুটির ক্ষমাপ্রার্থী’। [সূরা আল ইমরান : ৩:১৭]

০৫। ‘তাদের পিঠ বিছানা থেকে আলাদা থাকে, নিজেদের রবকে ডাকতে থাকে আশায় ও আশংকায়।’ [সূরা আস-সাজদাহঃ ৩২:১৬]

০৬। যে ব্যক্তি হয় আল্লাহর হুকুম পালনকারী, রাতের বেলা সিজদা করে ও দাঁড়িয়ে থাকে, আখেরাতকে ভয় করে এবং নিজের রবের রহমতের প্রত্যাশা করে তার পরিনাম কি মুশরিকের মতো হতে পারে?[সূরা আয যুমারঃ ৩৯:৯]

০৭। আর রাতের শেষ প্রহরে এরা ক্ষমা চাওয়ায় রত থাকত। [আদ-দারিয়াত 51:18]

০৮। ‘নিশ্চয় তোমার রব জানেন যে, তুমি রাতের দুই তৃতীয়াংশের কিছু কম, অথবা অর্ধরাত অথবা রাতের এক তৃতীয়াংশ সালাতে দাঁড়িয়ে থাক এবং তোমার সাথে যারা আছে তাদের মধ্য থেকে একটি দলও।

আর আল্লাহ রাত ও দিন নিরূপণ করেন। তিনি জানেন যে, তোমরা তা করতে সক্ষম হবে না। তাই তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করলেন।

অতএব তোমরা কুরআন থেকে যতটুকু সহজ ততটুকু পড়। তিনি জানেন তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়বে।

আর কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে পৃথিবীতে ভ্রমণ করবে, আর কেউ কেউ আল্লাহর পথে লড়াই করবে।

অতএব তোমরা কুরআন থেকে যতটুকু সহজ ততটুকু পড়। আর সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও।

আর তোমরা নিজদের জন্য মঙ্গলজনক যা কিছু অগ্রে পাঠাবে তোমরা তা আল্লাহর কাছে পাবে প্রতিদান হিসেবে উৎকৃষ্টতর ও মহত্তর রূপে।

আর তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয় আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [মুজ্জাম্মীল 73:20]

..

০৯। গ্রন্থঃ সহীহ বুখারী (তাওহীদ) অধ্যায়ঃ ১৯/ তাহাজ্জুদ (كتاب التهجد) হাদিস নম্বরঃ ১১৪৫

১০। আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

মহামহিম আল্লাহ্ তা‘আলা প্রতি রাতে রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকাকালে পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করে ঘোষণা করতে থাকেনঃ কে আছে এমন, যে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দিব।

কে আছে এমন যে, আমার নিকট চাইবে? আমি তাকে তা দিব। কে আছে এমন আমার নিকট ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব। (৬৩২১, ৭৪৯৪; মুসলিম ৬/২৩, হাঃ ৭৫৮, আহমাদ ৭৫৯৫)

(আধুনিক প্রকাশনীঃ ১০৭৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১০৭৯)

১১। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় কর। কেননা এটা তোমাদের পূর্ববর্তী সকল নেককারদের অভ্যাস ছিলো।

 এটা তোমাদেরকে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য দানকারী, মন্দ কাজের কাফফারা এবং গোনাহ থেকে নিবৃত্তকারী। [সহীহ ইবনে খুযাইমাহঃ ১১৩৫]

তাহাজ্জুদ নামাজের উপকারিতা:

০১। তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার কারণে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং ফেরেস্তাদের বন্ধুত্ব অর্জন করা সম্ভব।

০২। আল্লাহ তার উক্ত বান্দাদের জন্য ফেরেস্তাদের কাছে গর্ববোধ করেন।

০৩। তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়কারীর অবস্থান আসমানবসিদের কাছে নক্ষত্রের ন্যায়।

০৪। তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়কারীর আত্মা নুরানি হয়।

০৫। তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়কারীর দোয়া দ্রুত কবুল হয়।

০৬। তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়কারীর তওবা কবুল হয় এবং তার গুনাহকে ক্ষমা করে দেয়া হয়।

০৭। তাহাজ্জুদের নামাজ গুনাহের জন্য কাফফারা স্বরূপ।

০৮। তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়কারীর চেহারা নূরানি হয়।

০৯। তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়কারীর দৈহিক এবং আত্মিক উন্নতি হয়।

১০। তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়কারীর চোখের জ্যোতি বৃদ্ধি পায়।

১১। তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়কারীর আচরণে নবি এবং আউলিয়াদের গুণাবলি পরিলক্ষিত হয়।

১২। তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়কারী নবির ‍সুন্নতের উপরে আমল করে।

১৩। মানুষের অন্তরে তার জন্য ভালবাসার সৃষ্টি হবে।

১৪। আয়ু বৃদ্ধি পাবে।

১৫। রিযিক ও রুজি বৃদ্ধি পাবে।

১৬। তাহাজ্জুদের নামাজ হচ্ছে এক প্রকারের সাদকা।

১৭। তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়কারীর আমলে চারটি বড় সৎকর্মের সমপরিমাণ সওয়াব লিখা হবে।

১৮। আল্লাহর নির্দেশে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়কারীর পিছনে ফেরেস্তারা জামাতে দাড়ায়।

১৯। তাহাজ্জুদের নামাজ হচ্ছে পুলসিরাত অতিক্রমের মাধ্যম এবং বেহেশতের চাবি স্বরূপ।

২০। কেয়ামতের দিন সকলে শরিরে বস্ত্র না থাকলেও তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়কারির শরির বস্ত্র থাকবে।

তাহাজ্জুদ নামাযের ওয়াক্তঃ

তাহাজ্জুদের অর্থ হল ঘুম থেকে উঠা। কুরআনে রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদের যে তাকীদ করা হয়েছে তার মর্ম এই যে, রাতের কিছু অংশ ঘুমিয়ে থাকার পর উঠে নামায পড়া।

তাহাজ্জুদের মসনূন সময় এই যে, এশার নামাযের পর লোকেরা ঘুমাবে। তারপর অর্ধেক রাতের পর উঠে নামায পড়বে।

নবী সা. কখনও মধ্য রাতে, কখনও তার কিছু আগে অথবা পরে ঘুম থেকে উঠতেন এবং আসমানের দিকে তাকিয়ে সূরা আলে-ইমরানের শেষ রুকুর কয়েক আয়াত পড়তেন। তারপর মেসওয়াক ও অযু করে নামায পড়তেন।

তাহাজ্জুদ নামাযের সময়ঃ

অর্ধ রাতের পরে। রাতের শেষ তৃতীয়াংশে পড়া উত্তম। তাহাজ্জুদের মুল সময় মুলত রাত ৩টা থেকে শুরু হয়ে ফজরের আযানের আগ পর্যন্ত থাকে।

 তবে ঘুম থেকে না জাগার সম্ভাবনা থাকলে ইশা সালাতের পর দু রাকআত সুন্নত ও বিতরের আগে তা পড়ে নেয়া জায়েয আছে।

 তবে পরিপূর্ণ তাহাজ্জুতের মর্যাদা পেতে হলে, এশার নামাযের পর ঘুমিয়ে রাত ২টা বা ৩টার দিকে উঠে নামায আদায় করতে হবে।

তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম :

তাহাজ্জুদ নামাজ হচ্ছে একটি নফল ইবাদত তবে নফল ইবাদতের মধ্যে এটি অন্যতম একটি ইবাদত।

এই নামাজ ঘুম নষ্ট করে গভীর রজনীতে পড়তে হয় তার জন্য এর সওয়াব ও ফজিলত বেশি। অনেকে চান মনের বাসনা পূর্ন করতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে কিন্তু নিয়ম সময় বা নিয়ত না জানা থাকায় পড়তে পারেন না।

তাহাজ্জুদ পড়ার নিয়মঃ

তাহাজ্জুদ নামায পড়ার জন্য নির্দিষ্ট কোন সুরা নেই। যে কোন সুরা দিয়েই এই নামায আদায় করা যাবে। তবে যদি বড় সুরা বা আয়াত মুখুস্ত থাকে তবে, সেগুলো দিয়ে পড়াই উত্তম।

 কারন রাসুল সা. সব সময় বড় সুরা দিয়ে তাহাজ্জুদ নামায আদায় করতেন। যাইহোক, বড় সুরা মুখুস্ত না থাকলেও ছোট যে কোন সুরা দিয়েই নামায আদায় করা যাবে।

নিয়ম হল ২রাকাত করে করে, এই নামায আদায় করা। প্রত্যেক রাকাতে সুরা ফাতিহা পড়ার পর, অন্য যে কোন সুরা মিলানো।

ধীর-স্থীর ভাবে রুকু সিজদা করা। সিজদার তাসবিহ পড়ার পর নিজের ইচ্ছা মত মন-প্রাণ খুলে দোয়া করা। কারণ সিজদার দোয়া কবুল হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ।

 রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘সিজদাহ অবস্থায় বান্দা আপন প্রভুর সবচেয়ে অধিক নিকটতম হয়ে থাকে। সুতরাং (ঐ অবস্থায়) তোমরা বেশী-বেশী করে দুআ কর।’ [মুসলিম, সহীহ ১/৩৫৮]

তাহাজ্জুদ নামাযের রাকআত সংখ্যাঃ

[এক.]

তাহাজ্জুদ নফল-শ্রেণীর নামায।আল্লাহ তাআলা বলেন,

অর্থাৎ রাত্রির কিছু অংশে তাহাজ্জুদ কায়েম কর; এটা তোমার জন্য নফল তথা অতিরিক্ত কর্তব্য। আশা করা যায়, তোমার প্রতিপালক তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে। (সূরা বানী ইসরাইল :৭৯ )

[দুই.]

যেহেতু তাহাজ্জুদ নফল নামায তাই আপনি যত পড়তে চান-নিষেধ নেই। তবে রাসূল সাঃ সাধারণত আট রাকাত পড়তেন।

 যেমন, হাদীসে এসেছে,

‘আয়েশা রাযি. হতে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ এগার রাকাত (আট রাকাত তাহাজ্জুদ এবং তিন রাকাত বিতর) নামায পড়তেন,

অর্থাৎ রাতে। তিনি মাথা তোলার পূর্বে এত দীর্ঘ সেজদা করতেন যে, ততক্ষণে তোমাদের কেউ পঞ্চাশ আয়াত পড়তে পারবে।

আর ফরয নামাযের পূর্বে দু’ রাকাত সুন্নত নামায পড়ে ডান পাশে শুয়ে আরাম করতেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর নিকট নামাযের ঘোষণাকারী এসে হাযির হত।’

[বুখারী ৬২৬, ৯৯৪, ১১২৩, ১১৩৯, ১১৪০,

১১৬০, ১১৬৫, ৬৩১০]

[তিন.]

সর্ব নিম্ন দু রাকআত। আর সর্বোচ্চ ৮ রাকআত পড়া উত্তম।

[চার.]

তাহাজ্জুদের ৮ রাকাত নামায আদায় করার পরে, বিতর ৩ রাকাত নামায পড়া। রাসুল (সাঃ) তাহাজ্জুদের নামায বেশিরভাগ সময় ৮রাকাত পরতেন এবং এর পর বিতরের নামায পড়ে মোট ১১রাকাত পূর্ণ করতেন।

[নোটঃ]

তাহাজ্জুদ নামায বিতরসহ ১৩, ১১, ৯ কিংবা ৭ রাকাত পড়া যায় [বুখারী, মুসলিম, মেশকাত ১০৬ পৃঃ]

প্রথমে দু’রাকাত ছোট ছোট সুরা মিলিয়ে হালকাভাবে পড়ে আরম্ভ করবে [মুসলিম, মেশকাত ১০৬ পৃঃ]

অতঃপর দু’রাকাত করে, তাহাজ্জুদের নামায সাত রাকাত পড়তে চাইলে দু’সালামে চার রাকাত পড়ে তিন রাকাত বিতর পড়বে । [বুখারী, মেশকাত ১০৬ পৃঃ]

[বি.দ্র.]

যদি এশার নামায পরে বিতরের নামায পড়ে থাকেন, তবে তাহাজ্জুত নামায পড়ার পড়ে বিতর নামায পড়ার দরকার নেই। তখন ২ রাকাত থেকে শুরু করে ৮রাকাত তাহাজ্জুত নামায পরলেই হবে।

আবু বকর রা., আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ও আম্মার বিন ইয়াসির (রা.) প্রমুখ সাহাবিদের আমল দ্বারা এমনটি প্রমাণিত। তাঁরা এশার পর বিতর পড়ে শেষ রাতে তাহাজ্জুদ পড়েছেন। [তিরমিজি, ৪৭১; ফাতহুল বারি : ২/৫৫৪]

 ‘আবু হোরায়রা থেকে বর্ণিত, ‘আমি মুহাম্মাদ সা. কে বলতে শুনেছি, ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদের নামাজ।’

হজরত আবু হোরায়রা থেকে বর্ণিত অপর এক হাদিসে মুহাম্মদ বলেছেন, আল্লাহ প্রতি রাতেই নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হন যখন রাতের শেষ তৃতীয় ভাগ অবশিষ্ট থাকে। তিনি তখন বলতে থাকেন,  কে আছো যে আমায় ডাকবে?

আর আমি তার ডাকে সাড়া দেবো।

কে আছো যে আমার কাছে কিছু চাইবে? আর আমি তাকে তা দান করব।

কে আছো যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আর আমি তাকে ক্ষমা করব?

[বুখারী হা/১১৪৫; মুসলিম হা/৭৫৮] হে আল্লাহ, আমাদের সবাইকে নিয়মিত তাহাজ্জুদ সালাত পড়ার তাওফিক দান করুন।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

1 × 4 =