ঢাকা কাস্টম হাউজের নায়েব আলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ

0
668

ঢাকা কাস্টম হাউজের অফিস সুপারিনটেনডেন্ট (নিলাম শাখা) নায়েব আলী জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন তিনি। তার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এ বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়েছে। দুদকে অভিযোগ জমা পড়ার বিষয়টি জানতে পেরে বিদেশে সপরিবারে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন নায়েব আলী। এরইমধ্যে পরিবারের সবার পাসপোর্টও করেছেন তিনি। এখন পর্যন্ত কাস্টম হাউজের আর্থিক কেলেঙ্কারির দায়ে দুইবার ওএসডি হয়েছেন নায়েব আলী। প্রথমবার ওএসডি হওয়ার দীর্ঘদিন পর আবারও একই পদে একই শাখায় নিয়োগ পান। এর কিছুদিন পর আবারও ওএসডি হন। কাস্টম হাউজের কর্মকর্তারা বলছেন, একজন ব্যক্তি ওএসডি থাকার পর আবার কীভাবে একই পদে একই শাখায় নিয়োগ পান? তার কেলেঙ্কারির বিষয়ে সরাসরি মুখ খুলতে নারাজ কাস্টম হাউজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

জানা যায়, ১৯৯৩ সালে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করেন নায়েব আলী। এর তিন বছর পর চাকরিতে ঢোকেন তিনি। চাকরিতে ঢোকার পর পেয়ে যান সোনার হরিণ। ঢাকার বনানী, মিরপুর ও মানিকগঞ্জে ভ্যাট সার্কেলে চাকরি করলেও তদবিরের মাধ্যমে বদলি হয়ে আসেন বিমানবন্দর কাস্টম হাউজে।

গত ৯ বছর তিনি একই জায়গাতে চাকরি করার সুবাদে টাকার কুমির হওয়ার অবারিত সুযোগ পেয়েছেন। ঢাকায় রয়েছে তার তিনটি বাড়ি, একাধিক প্লট। এ ছাড়া বগুড়ায় রয়েছে দুটি ফ্ল্যাট। শ্বশুরের কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন বিঘা বিঘা জমি। আইনের চোখকে ফাঁকি দিতে কোনোটি রেখেছেন শ্বশুরের নামে, মামার নামে, রেখেছেন স্ত্রী ছাবিনা মোস্তাকির নামে। অথচ তার স্ত্রী সামান্য গৃহিণী।

স্ত্রীর নামে রয়েছে একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ঢাকার বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে তার বসবাস। তার ছেলে তমাল ও মেয়ে রশ্মির পড়ালেখার পেছনে মাসে খরচ তার অর্ধ লাখ টাকা।

অপরদিকে রাজধানীর মালিবাগের সোনালীবাগে ৪৭৮/১ হোল্ডিংয়ের বাসার তৃতীয় তলায় থাকেন নায়েব আলী। বছর পাঁচেক আগে ৮০ লাখ টাকা খরচ করে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটটি কেনে নায়েব আলী। এটির কেয়ারটেকার রতন আলী। এ ছাড়া মালিবাগের চানবেকারির গলিতে আরও একটি ফ্ল্যাট রয়েছে নায়েব আলীর। এটি হোল্ডিং নম্বর: ৫৪। দ্বিতীয় তলার ওই ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিয়েছেন তিনি। প্রতিমাসে এই ফ্ল্যাট থেকে ভাড়া আসে ২০ হাজার টাকা।

অবৈধ উপার্জনে ‘টাকার কুমির’ ঢাকা কাস্টম হাউজের নায়েব আলী

রাজধানীর ঢাকা উদ্যানে একতা হাউজিংয়ের ৫ নম্বর রোডের ৮৯ নং হোল্ডিংয়ে একটি বাড়ি আছে নায়েব আলীর। তৃতীয় তলা এই বাড়িটির কেয়ারটেকার হিসেবে এতদিন ছিলেন নায়েব আলীর শ্যালক রিয়াল। মোট পাঁচ কাঠা জমিতে এই তৃতীয় তলা করা হয়েছে। বাড়িটি তৈরিতে খরচ হয়েছে তিন কোটি টাকা। এ ছাড়া পাঁচ কাঠা জমির বর্তমান বাজার দাম প্রায় দুই কোটি টাকা।

এ ছাড়া বগুড়ার চ্যালোপাড়ায় মধুবন সিনেমা এলাকায় একইসঙ্গে ১৫ কাঠা জমিতে তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে। প্রতিটি ফ্ল্যাট তিনতলা বিশিষ্ট। এই জমিটি নায়েব আলী তার শ্বশুরের কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন। তবে নায়েব আলী জমির মালিকানা দিয়েছেন মেয়ে ছাবিনা মোস্তাকির নামে। এই ১৫ কাঠা জমির দাম অন্তত সাড়ে চার কোটি টাকা। এ ছাড়া ওই জমিতে বাড়ি তৈরি করতে নায়েব আলীর খরচ করতে হয়েছে অন্তত ১০ কোটি টাকা।

এ ছাড়া নাটাইপাড়ায় তিন কাঠা জমি আছে নায়েব আলীর। তবে নিজের জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে শ্বশুরের কাছ থেকে কেনা জমিটি আবার শ্বশুরের নামে ফিরিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা চালাচ্ছেন নায়েব আলী।

বগুড়ায় জলেশ্বরী তলায় মফিজ পাগলা মোড় এলাকায় দুটো ফ্ল্যাট আছে নায়েব আলীর। একটি বাড়ি ছয়তলা ও আরেকটি বাড়ি তিন তলা। ছয়তলা বিশিষ্ট বাড়িটির দাম অন্তত ছয় কোটি টাকা আর তিন তলা বিশিষ্ট বাড়িটির দাম ৫ কোটি টাকা। এই বাড়িটির হোল্ডিং ৩৯৫/এ, ওয়ার্ড নং-৭।

হোল্ডিং নম্বরে মালিকের নাম দেওয়া হয়েছে সফিকুল ইসলাম সাবুর নামে। এই সাবু নায়েব আলীর আত্মীয় হন। তবে মুল দলিলে মালিক তিনি নিজেই। বাড়ি-প্লট-ফ্ল্যাটের পাশাপাশি বগুড়ার আজিজ ম্যানসন মার্কেটের সাত মাথায় দুটো দোকান রয়েছে। মার্কেটের নিচ তলায় ছেলের নাম তমালের নাম অনুসারে দোকানটির নাম দেওয়া হয়েছে তমাল মেডিকেল স্টোর। এই দোকানটি তিনি কেনেন ৭০ লাখ টাকায়। আর দ্বিতীয়টির নাম সাবু সার্জিকেল স্টোর। আত্মীয় সফিকুল ইসলাম সাবুর নামে এই দোকানটির নাম দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বগুড়ায় গ্রামের বাড়িতে অন্তত ১০ বিঘা জমি রয়েছে নায়েব আলীর। যেগুলোর রেজিস্ট্রি হয়েছে নামে-বেনামে।

নায়েব আলীর জ্ঞাত বহির্ভূত সম্পদের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা কাস্টমস হাউসের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।

অন্যদিকে নায়েব আলীর ব্যক্তিগত ফোনে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি মালিবাগে তার বাসায় গেলে সেখান থেকে জানানো হয়, নায়েব আলী গ্রামের বাড়িতে গেছে। তাই তাকে এখন পাওয়া যাবে না।

নায়েব আলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগের বিষয়ে জানলে চাইলে দুদক সচিব আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দুর্নীতি দমন করতে আমরা বদ্ধপরিকর। যে অভিযোগ জমা পড়েছে তা যাচাই-বাছাই শেষে আমলে নেওয়ার মতো হলে অবশ্যই বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

fourteen − 6 =