আর্থিক নিরাপত্তা দরকার সৎ সাংবাদিকতার জন্য

0
575

পেশা, মর্যাদাবোধ, গুণগতমান–শব্দগুলো খুব বেশি রকম সংশ্লিষ্ট। যখনই বিচ্ছিন্ন হয়, পেশাটি পড়ে যায় হুমকির মুখে। গুণগতমান আর মর্যাদাবোধ অনেকটাই খুঁইয়ে সাংবাদিকতা এখন পড়েছে সেই হুমকির মুখে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি সীমানা দেয়ালের খুব কাছে। সাংবাদিকের ব্যক্তিমান খুব বেশি সম্পর্কিত সংবাদপ্রতিষ্ঠানের মানের সঙ্গে। প্রতিষ্ঠানের আদর্শগত অবস্থান, আর্থিক সক্ষমতা, সম্মানজনক বেতন কাঠামো সাংবাদিকের মর্যাদাবোধ তৈরির কাজকে সহায়তা করে। সেই কাজ করার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানেরই। তবে দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই পেশা সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন-সংগঠনগুলোরও। ব্যাঙের ছাতার মতো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান, রাস্তার মোড়ে মোড়ে সম্পাদক এবং অলিগলিতে বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন গড়ে উঠলেও পেশাগত নিরাপত্তা, মানোন্নয়ন ও মর্যাদাবোধ গড়ে তোলা কতটা সম্ভব হয়েছে এ পেশায়? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে  পক্ষ থেকে মুখোমুখি হওয়া গণমাধ্যম গবেষক ও সাংবাদিকদের। ‘প্রশ্নবিদ্ধ সাংবাদিকতা: উত্তরণের পথ’ শীর্ষক ধারাবাহিক আয়োজনের আজ থাকছে শেষ পর্ব।

বর্তমানে সাংবাদিকতায় গুণগতমান, পেশাদারিত্ব ও নীতিমালার কোনো বালাই নেই। ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যেখানে সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল, আইপি টেলিভিশন ও সংবাদ পত্র। আর এসব প্রতিষ্ঠান শুধু পরিচয়পত্র ও বুম ধরিয়ে দিয়েই বেতন-ভাতার দায় সারে। এটি চলছে জেলা-উপজেলা থেকে শুরু করে খোদ রাজধানীতেও। মানা হচ্ছে না সম্পাদক নিয়োগের নিয়মও।

ক্ষমতাবান ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধক

সাংবাদিকতা পেশায় আসতে হলে একটি নিবন্ধন প্রক্রিয়া থাকা দরকার বলে মনে করেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু। তিনি বলেন, ‘নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় উত্তীর্ণ হয়ে সাংবাদিকতা পেশায় ঢুকতে হবে। সেখানে নৈতিকতার স্ট্যান্ডার্ড ঠিক হবে। কী লিখবেন, কী বলবেন, কী উচিত, অনুচিত, আইনকানুন কী, কে সাংবাদিক হবেন, তার প্রশিক্ষণ কী, আইন কাঠামো তিনি মানবেন কি না–এসব বিবেচনায় নিতে হবে। আরেকটি দিক হলো–ভালো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে কি না, ভালো বেতন দিচ্ছে কি না, যে প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছে, সে প্রতিষ্ঠান এগুলো দেখভাল করছে কি না, অভিজ্ঞ সম্পাদকের নেতৃত্বে সম্পাদকীয় নীতি গড়ে উঠছে কি না–এগুলোর সমন্বয় করতে না পারলে, এসব রোগ বা ব্যাধি মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে যাবে।’

এ সম্পর্কে ডিবিসি নিউজের সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু বলেন, ‘একজন সম্পাদকের ১৫ বছর সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থাকা দরকার। সেই অভিজ্ঞতা নেই তারপরও একজন সম্পাদক হচ্ছেন কীভাবে? একজন মালিক সম্পাদক হচ্ছেন, কীভাবে হচ্ছেন? অথবা একজন রিপোর্টার সম্পাদক হচ্ছেন। এগুলোর নীতিমালা করতে হবে।’

আর্থিক নিরাপত্তার সঙ্গে পেশাগত মানোন্নয়ন ও মর্যাদাবোধ জড়িত। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘মফস্বল সাংবাদিকদের যদি একটি পরিচয়পত্র ধরিয়ে বলা হয়, এটা দিয়ে সব সুযোগ-সুবিধা নিতে হবে। তাহলে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এসব সমস্যা সরকার ও সাংবাদিক নেতাদের দেখা উচিত।’

সাংবাদিক সাজ্জাদ আলম খান তপু বলেন, ‘ন্যায্য পাওনা দিতে না পারলে মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা আশা করা যাবে না। শুধু একটি পরিচয়পত্র দিয়ে সাংবাদিকতা হয় না। ভালো সাংবাদিকতা চাইতে হলে ন্যায্য পারিশ্রমিক নিশ্চিত করতে হবে। শুধু পরিচয়পত্র দিয়ে ছেড়ে দিলে ভালো সাংবাদিকতাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। একটি বিশেষ সুরক্ষা আইন দরকার, ওয়েজ বোর্ড দরকার, নবম ওয়েজ বোর্ড কার্যকর করা দরকার।’

স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

গণমাধ্যম গবেষক জায়েদুল আহসান পিন্টু বলেন, ‘আন্ডারগ্রাউন্ড কিছু পত্রিকা আছে, যেগুলো বাজারে দেখা যায় না। দেয়ালে সেঁটে দেওয়া থাকে। সেই পত্রিকাগুলোর সাংবাদিকরা কী করবেন? বেতন তো দেয় না।’

গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বা নিবন্ধন দেওয়ার আগে মালিকের সক্ষমতা যাচাইয়ের ওপর গুরুত্ব দিলেন এ গবেষক ও সাংবাদিক। তিনি আরও বলেন, ‘একজন মালিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালানোর যোগ্য কি না, ট্যাক্স ঠিক মতো দিচ্ছে কি না, সরকারের নিয়ম-কানুন মেনে চলছে কি না, প্রতিষ্ঠানের লোকজনকে নিরাপত্তা দিতে সক্ষম কি না সেটি দেখতে হবে। এ ছাড়া কাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে সেটিও দেখতে হবে।’ তবে বিষয়গুলো যাচাইয়ের ক্ষেত্রে সরকার ও সাংবাদিক উভয়পক্ষের গাফিলতি রয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

সম্মানজনক বেতনভাতা না দেওয়া এবং ওয়েজ বোর্ড না মানার ক্ষেত্রে শুধু মালিক নয়, সাংবাদিক নেতারাও দায়ী বলে মনে করেন জায়েদুল আহসান পিন্টু। তিনি বলেন, ‘এটা আদায় করার দায়িত্ব তো ইউনিয়নের। একটা সময় ছিল–বেতন না দিলে ইউনিয়ন গিয়ে মালিক পক্ষকে ঘেরাও করত বা আলোচনায় বসত। তারপর মালিকপক্ষ দিতে বাধ্য হতো। অথচ এখন ইউনিয়নেরই কেউ কেউ গিয়ে সার্টিফিকেট দিচ্ছে, অমুক প্রতিষ্ঠানে ওয়েজ বোর্ড দেওয়া হচ্ছে, আসলে দেওয়া হচ্ছে না। যার যার দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না।’

নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে গড়ে ওঠা মানহীন এসব আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার নিবন্ধন প্রসঙ্গে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান চালু করতে হলে নিয়মের মধ্যে আসতে হবে। অবাধ মানে এই নয় যে, যে আসবে তাকেই লাইসেন্স দিতে হবে।’

যেখানে-সেখানে গড়ে ওঠা গণমাধ্যম বিষয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলেন সাংবাদিক নেতা সাজ্জাদ আলম খান তপুও। তিনি বলেন, ‘শুধু একটি ল্যাপটপ দিয়ে কেউ কেউ হয়তো অনলাইন পোর্টাল করার স্বপ্ন দেখছেন, প্রতিনিধি নিয়োগ করছেন। আমি বলব তাদের নিয়তে এক ধরনের সমস্যা রয়েছে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের কাঠামো, বেতন কাঠামো সুনিশ্চিত করতে হবে। সাংবাদিকদের পেশাগত অধিকার, মর্যাদার প্রশ্নে সবচেয়ে বড় জায়গাটি হচ্ছে তার অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ, সেটি তৈরি করে দিতে হবে। এটিকে কুটির শিল্প হিসেবে দেখলে চলবে না।’

গোপন সমঝোতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সাংবাদিকতা

পেশাগত মান উন্নয়নের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ওপর জোর তাগিদ দিয়ে সাংবাদিক জায়েদুল আহসান পিন্টু বলেন, ‘সাংবাদিকতায় যেটার বড়ই অভাব। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতার বেসিক জ্ঞান দেয়। আর কিছু এনজিও, সরকারি প্রতিষ্ঠান, যেমন–নিমকো, পিআইবিও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তবে সেগুলোর মান নিয়ে সন্দেহ আছে। এনজিওগুলো তো সাংবাদিকতার মান বাড়াতে প্রশিক্ষণ দেয় না। এরা টাকা নিয়ে ব্যবসা করে। বিদেশ থেকে টাকা আসে, একটা অংশ প্রশিক্ষণের নাম করে খরচ করে, আরেকটা অংশ প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে নেয়। এটা দিয়ে খুব বড় পরিবর্তন হবে না।’

ডিবিসি নিউজের সম্পাদক আরও বলেন, ‘পেশাগত মান উন্নয়নের জন্য প্রতিনিয়ত চর্চা করতে হয়। চর্চাটা নিজস্ব প্রতিষ্ঠান থেকে করতে হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর সিস্টেমের মধ্যেই থাকতে হবে প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণ চলতেই থাকবে। পেশাদারিত্ব বাড়াতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ও সাংবাদিকদের নীতি-নৈতিকতার একটি চার্ট থাকতে হবে। কোনটা করতে পারবে কোনটা করতে পারবে না এগুলোর নীতিমালা থাকতে হবে। এর বাইরে গেলেই ব্যবস্থা নিতে হবে।’

এ ছাড়া প্র্যাকটিক্যাল ফিল্ডে প্রশিক্ষণের বিষয়ে সংগঠনগুলোর ভূমিকা রয়েছে বলেও জানান তিনি। এ গবেষকের মতে, ক্লাব, ইউনিয়ন, বিটভিত্তিক সংগঠনগুলো পিকিনিক, আউটিং, বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের, পাশাপাশি কিছু ওয়ার্কশপ, সিম্পোজিয়াম, সেমিনার করতে পারে। সাংবাদিকতার মূল বিষয়, অনুসন্ধানী, ব্যবসা বা অর্থনৈতিক সাংবাদিকতার নিয়ম-নীতি শেখাতে ডিআরইউ একটা কোর্স চালু করতে পারে। বিক্ষিপ্তভাবে যেটুকু হচ্ছে তা সংগঠিত নয়। সাংবাদিককে আত্ম উন্নয়নের জন্য প্রতিনিয়ত পড়াশোনা বাড়াতে হবে।

জায়েদুল আহসান পিন্টু বলেন, ‘একজন রিপোর্টারের জানতে হবে তার লেখার কারণে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও রাষ্ট্র ক্ষতির মুখে পড়ছে কি না।’

সাংবাদিকতার যে বিচ্যুতি ঘটেছে সেখান থেকে বের হতে হলে প্রতিষ্ঠান, সাংবাদিক, মালিক, স্টেকহোল্ডার এমনকি পাঠককেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে বলে মত দেন এ গণমাধ্যম গবেষক।

স্বার্থের দ্বন্দ্বে পরাজিত সাংগঠনিক শক্তি

পেশাগত মান উন্নয়নের বিষয়ে একই রকম মত দিলেন সাংবাদিক নেতা সাজ্জাদ আলম খান। তিনি বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। সেটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত।’

পেশাগত মান উন্নয়ের ক্ষেত্রে আচরণবিধি প্রণয়ন করতে সাংবাদিক নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেন, ‘যারা দুর্নীতি করছে, তাদের সরাসরি সংগঠন থেকে এমনকি পেশা বিদায় করতে হবে।’ এটি করতে পারলে সরাকারি নিয়ন্ত্রণের ঝুঁকি থাকবে না বলে মনে করেন তিনি।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

14 − 7 =