বনের কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করছে মুনাফালোভী একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরা

0
293

ঢাকার নিকটবর্তী ধামরাইয়ে অবাধে চলছে মাটির তৈরি চুল্লিতে সংরক্ষিত ও  বনের কাঠ পুড়িয়ে কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে কয়লা তৈরি করছে মুনাফালোভী একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরা।এতে করে উজাড় হচ্ছে বনজ ও ফসলের গাছ।  আর কাঠ থেকে কয়লা তৈরির এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন স্থানীয় অনেকে। এসব কয়লা তৈরির চুল্লি থেকে নির্গত হচ্ছে প্রচুর ধোঁয়া। যাতে অতিষ্ঠ জনজীবন। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগও আমলে নিচ্ছেন না এ ব্যবসায় জড়িতরা।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো অনুমোদন ছাড়াই অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব কয়লা তৈরির কারখানায় অবাধে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। জনবসতি এলাকা ও ফসলি জমি নষ্ট করে এসব চুল্লি স্থাপন করা হয়েছে। লাল মাটি, ইট ও কাঠের গুঁড়া মিশিয়ে তৈরি করা চুল্লিতে প্রতিদিন পোড়ানো হচ্ছে কয়েক শ মণ কাঠ।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ধামরাই উপজেলার যাদপুর, বালিয়া ও বাইশাকান্দা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে ওইসব অবৈধ চুল্লি বসিয়ে কাঠ পুড়িয়ে কয়লা বানানো হয়। সেখান থেকে বের হওয়া ধোঁয়ায় আশপাশ আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে এই ব্যবসা পরিচালনা করছে স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। কিন্তু এসব অবৈধ চুল্লির মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় প্রতিবাদ করার সাহস পায় না কেউই। এমনকি অসাধু চুল্লি মালিকদের প্রসঙ্গে জনপ্রতিনিধিরাও কথা বলেন নরম সুরে।

সরেজমিনে গিয়ে উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে এমন প্রায় ২২টি চুল্লির সন্ধান পাওয়া গেছে, সেখানে গিয়ে দেখা যায় প্রতিটি চুল্লির মধ্যে সারিবদ্ধভাবে কাঠ সাজিয়ে একটি মুখ খোলা রেখে অন্য মুখগুলো মাটি ও ইট দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। খোলা মুখ দিয়ে আগুন দেওয়া হয় চুল্লিতে। আগুন দেওয়া শেষ হলে সেটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর প্রায় ৭ থেকে ১০ দিন পোড়ানোর পর চুলা থেকে কয়লা বের করা হয়। প্রতিটি চুল্লিতে প্রতিবার ২০০ থেকে ৩০০ মণ কাঠ পোড়ানো হয়। এবং একেকটি চুল্লি থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকার কয়লা পাওয়া যায়। পরে এই কয়লা শীতল করে বিক্রির উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন ইটভাটার মালিকেরা এই কয়লার বড় অংশের ক্রেতা বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব এলাকার একাধিক বাসিন্দারা বলেন, চুল্লিতে কাঠ পোড়ানোয় সৃষ্টি হচ্ছে ধোঁয়ার। রাস্তার পাশ দিয়ে চলাচল করার সময় চোখ জ্বালাপোড়া করে। গাছপালা নষ্ট হচ্ছে। ফলন্ত গাছও মরে যাচ্ছে। বাড়ির শিশু ও বয়স্কসহ অনেকেই অসুস্থ হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তবে প্রভাবশালীদের ভয়ে এলাকায় প্রতিবাদ করা যাচ্ছে না। এদের বিরুদ্ধে কিছু বললেই দেয়া হয় এলাকা ছাড়ার হুমকি।

বালিয়া ইউনিয়নের বাস্তা টেটাইল গ্রামে বংশী নদীর গড়ে ওঠা ৬টি চুল্লির মালিক স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা নাহিদ রানার কাছে চুল্লির অনুমোদনের ব্যাপারে জানতে চাইলে রাগান্বিত স্বরে তিনি বলেন, ‘পরিবেশের ক্ষতি হলে হবে। এগুলা সবই অবৈধ ব্যবসা। যেভাবে চালাতে পারি চালাই। কেউ অভিযোগ দিলে প্রশাসন যদি ভাইঙ্গা দেয় তাইলে ব্যবসা বন্ধ থাকবে।’

দক্ষিণ গাঁওতারা এলাকার নুরুল ইসলাম নামে আরেকজন চুল্লির মালিক বলেন, ‘ধোঁয়ায় ক্ষতি হচ্ছে এসব কথা আমাকে বইলেন না ভাই। এসব চুল্লির লিখিত কোনো অনুমতি হয়না। অনুমতি সবারই আছে তবে সেটা মুখে মুখে।’

বাইশাকান্দা ইউনিয়নের গোলাকান্দা গ্রামে হারুন অর রশিদের চুল্লির তথ্য সংগ্রহের সময় তার লোকজন বিদ্রূপ করে বলেন, ‘যত পারেন ছবি তুলে নিয়ে যান। আপনারা নিউজ করলেই কী হবে?’

এ ব্যপারে বালিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মজিবর রহমান বলেন, এটার বিরুদ্ধে ওই গ্রামের লোকজনকে আমি আইডিয়া দিছি। তারা এসবের বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষরও নিয়েছেন। ওরা যারা (চুল্লির মালিক) কাজ করতেছে তারা আমাদেরই লোক। আমাদেরই কর্মী। তাই আমি নিজে সরাসরি না গিয়ে অন্যদের মাধ্যমে এগুলো বন্ধ করা যায় কিনা সেটা দেখছি।

বিষয়টি নিয়ে ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ নূর রিফাত আরা বলেন, কাঠ পুড়ানোর ফলে কার্বন ও সীসা উৎপন্ন হয়ে বাতাসের সাথে মিশে যায়। এতে যে এলাকার এসব কাঠ পুড়ানো হচ্ছে সেসব এলাকায় বসবাসরত মানুষের মধ্যে শ্বাসকষ্টজনিত রোগ, অ্যালার্জী, চর্মরোগ ও চোখের  সমস্যাসহ নানান রোগ দেখা দিতে পারে।

ধামরাই উপজেলা বন কর্মকর্তা মোতালেব আল মামুন বলেন, ‘দুই বছর আগে আমরা এসব চুল্লি ভেঙে দিয়েছিলাম। পরে আমার বদলি হওয়ায় আমি অনত্র চলে গিয়েছিলাম। সম্প্রতি আবার এখানে জয়েন করেছি। বিষয়টি আমি ইউএনও স্যারকে জানিয়ে আগামী সপ্তাহের মধ্যে ইনশাআল্লাহ আমরা ওটা ভেঙে দেয়ার ব্যবস্থা করব।’ এ ব্যাপারে ধামরাই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসাইন মোহাম্মদ হাই জকী বলেন, কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির কোন অনুমতি কাওকেই দেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে দ্রুতই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এবং তদন্ত সাপেক্ষে এর সাথে জড়িত ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

17 − 6 =