ওষুধের নকল আর ভেজালের খেলা মাঠ পর্যায়ে ড্রাগ সুপারদের অসাধুতার জন্যই ভেজাল সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা করেও আপোস করতে হচ্ছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এ বিষয়ে বলেন, জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তার স্বার্থে নকল-ভেজাল ওষুধ বিক্রির বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে। ওষুধ নিয়ে সব ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে ওষুধ আইনকে আরও যুগোপযোগী এবং কঠোর শাস্তির বিধান রেখে প্রস্তাবিত আইন অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়াধীন। নকল-ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাজধানীসহ সারাদেশে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে আসছে। ভবিষ্যতে তা আরও জোরালো হবে গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী বলেন, ওষুধ তৈরির কাঁচামাল খোলাবাজারে কোনোভাবেই বিক্রি হতে পারে না। যারা এ ধরনের কাঁচামাল বিক্রির সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তাহলেই ছোট ছোট কোম্পানির মাধ্যমে তৈরি হওয়া মানহীন ওষুধের উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ দল ৭৩টি ওষুধ কোম্পানি সরেজমিন পরিদর্শন করে ২০১৪ সালের অক্টোবরে একটি প্রতিবেদন দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুকের নেতৃত্বে কমিটির প্রতিবেদনে ২৯টি কোম্পানির ওষুধের কার্যকারিতা ও উপযুক্ত মান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে এসব কোম্পানির ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ও দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ২৯ কোম্পানির ওষুধ উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ দেয়। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের রয়েল ফার্মাসিউটিক্যালস, ফার্মিক ল্যাবরেটরিজ ও স্ট্যান্ডার্ড ল্যাবরেটরিজ, চুয়াডাঙ্গার এজটেক ফার্মাসিউটিক্যালস, দিনাজপুরের বেঙ্গল টেকনো ফার্মা, গাজীপুর কোনাবাড়ীর ব্রিস্টল ফার্মা, বরিশালের ইন্দো-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস, রাজধানীর মিরপুরের ইনোভা ফার্মাসিউটিক্যালস, এবলেশন ল্যাবরেটরিজ, বিকল্প ফার্মাসিউটিক্যালস, যাত্রাবাড়ীর ডলফিন ফার্মাসিউটিক্যালস, পোস্তগোলার মিল্লাত ফার্মাসিউটিক্যালস, শ্যামলীর ট্রপিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল ও তেজগাঁওয়ের রেমো কেমিক্যালস, নারায়ণগঞ্জের ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিজ, সাভারের সুনিপুণ ফার্মাসিউটিক্যালস ও এভার্ট ফার্মা, কেরানীগঞ্জের ইউনিক ফার্মাসিউটিক্যালস, সিরাজগঞ্জের ওয়েসিস ল্যাবরেটরিজ ও রাসা ফার্মাসিউটিক্যালস, পাবনার ইউনিভার্সাল ফার্মাসিউটিক্যালস, সিলেটের জালফা ল্যাবরেটরিজ, নওগাঁর নর্থ বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যালস, বরিশালের প্যারাডাইস ফার্মা, কুষ্টিয়ার কোয়ালিটি ফার্মাসিউটিক্যালস, ফরিদপুরের বেলসেন ফার্মাসিউটিক্যালস, ময়মনসিংহের স্পার্ক ফার্মাসিউটিক্যালস ও সেভ ফার্মাসিউটিক্যালসের বিরুদ্ধে নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরির অভিযোগ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সনদ বাতিলের পরও তারা উচ্চ আদালতে রিট করে ওষুধ উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে।
নতুন কৌশলে নতুন পন্থায় বাজারে নকল ওষুধ নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির বিরুদ্ধে গত বছর ভ্রাম্যমাণ আদালত ২ হাজার ১৪৫টি মামলা দায়ের করেন। এ সময় ১২ কোটি ৪১ লাখ ৬ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয় ৩৯ জনকে। সিলগালা করা হয় ৪৪টি প্রতিষ্ঠান। জব্দ করা হয় প্রায় ৩২ কোটি টাকা মূল্যের নকল ওষুধ। এ ছাড়া উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রায় ৪৭ কোটি টাকা মূল্যের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধ্বংস করা হয়। এসব পদক্ষেপের মধ্যেও থেমে নেই এ অপরাধ। নতুন কৌশল অবলম্বন করে নকল ওষুধ বাজারে ছাড়ছে অপরাধীরা। তাদেরই একজন কেরানীগঞ্জের রাসেল। সে নিজেই কেমিস্ট, নিজেই ফার্মাসিস্ট, আবার ওষুধ কোম্পানির মালিকও। স্কয়ার, বেক্সিমকো, অপসোনিন এবং ইনসেপটার মতো নামিদামি কোম্পানির মোড়ক, বোতল হুবহু নকল করে বছরের পর বছর ধরে অনৈতিক বাণিজ্যে জড়িত রাসেল। রাসেলের মতো ঢাকার মুগদার বাদশা, মিরপুরের সালাউদ্দিন বাবু, পান্থপথের মোহাম্মদ আলী খান, পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীর এম এ বারেক নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। এই অপরাধে তাদের একাধিকবার জেলেও যেতে হয়েছে। জেল থেকে বেরিয়ে আবার ফিরে গেছে পুরোনো ব্যবসায়। ছোটখাটো কয়েকটি বৈধ কোম্পানিও নকল ওষুধ উৎপাদনে জড়িত। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অবৈধ কারখানায় নকল ওষুধ তৈরি করে তা পাইকারি দোকানে বিক্রি করছে তারা। এসব দোকানের মাধ্যমেই সারাদেশে নকল ওষুধ ছড়িয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মিটফোর্ডের ওষুধ ব্যবসায়ী, বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরির এমন ভয়ঙ্কর তথ্য পাওয়া গেছে। ওষুধ ছাড়াও নকল প্রসাধনীর কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্রেতার পক্ষে নিম্নমানের এসব ওষুধ চেনা সম্ভব নয়। অন্যদিকে সরকারকে কর না দিয়ে অবৈধভাবে বাজারজাত হচ্ছে সিগারেট। মোবাইল ফোন ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্যের অবৈধ বাজার রয়েছে। সরকারের রেভিনিউ স্ট্যাম্পও জাল হচ্ছে। এর বাইরে প্রয়োজনীয় অনেক পণ্য নকল হচ্ছে। মিটফোর্ডে ওষুধের দোকান আছে এমন অন্তত ১০জন ব্যবসায়ী জানান, প্রথমে তারা মনে করতেন, বড় কোম্পানির এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা বা কর্মচারী লট চুরি করে বাজারে বিক্রি করছে।