যে কারণে ফল গাছে ফল ধরে না

0
191

খাদ্য পুষ্টি, ফলের চাহিদা পূরণ, বৃক্ষ সম্পদ বৃদ্ধি, সর্বোপরি পরিবেশ ও আর্থিক উন্নয়নের জন্য বাগান আকারে যার যতটুকু সম্ভাব্য সুযোগ-সুবিধা আছে সেখানে বেশি ফল গাছ লাগানোর প্রতি জোর দেয়া আমাদের প্রত্যেকেরই একান্ত দায়িত্ব।

রোপণ উপযোগী ফল গাছের তালিকা : পছন্দ  মতো ফল চাষ ও নির্বাচনের সুবিধার্থে এদেশের আবহাওয়ায় উপযোগী ভূমির অবস্থান, স্থানীয় চাহিদা, আবাদে লাভজনক এসব দিকগুলো বিবেচনায় এনে দেশি-বিদেশি সব ধরনের ফল নির্বাচন করে উন্নত জাতের ফল বাগান সৃষ্টি ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

কোন কোন ফল গাছ রোপণের এক বছরের মধ্যেই ফুল ফল ধরা আরম্ভ করে। আবার কিছু ফল গাছ রোপণের পর ফল দিতে ৫-১০ বছর সময় লেগে যায়। রোপণের পর ফল ধরতে দীর্ঘ সময় লাগে সেগুলোর ফাঁকে ফাঁকে স্বল্পমেয়াদি ফল চাষ (কম উচ্চতা বিশিষ্ট) অথবা মৌসুমি ফসল আবাদ করে ফল ধরার অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে বাড়তি ফসল প্রাপ্তি নিশ্চিত করে খরচ পুষিয়ে নেয়া যায়। অধিকন্তু এ ধরনের রিলে ফসল আবাদে পরোক্ষভাবে বাগানের যত্ন নেয়া হয়, তাতে ফল গাছ দ্রত বাড়তে ও বেশি ফল দিতে সহায়ক হয়।

বেশি লাভজনক ফল : বেশ কিছু ফল আছে যেগুলো পরিকল্পিতভাবে উন্নত জাতের বাগান সৃষ্টি করলে এবং নিয়মিত পরিচর্যা গ্রহণ করলে সেগুলোর আবাদ অতি লাভজনক। এগুলোর মধ্যে কলা, পেঁপে তরমুজ, আনারস, আম, কূল, পেয়ারা, কাগজিলেবু, কমলা, মালটা, লিচু, বেল, কদবেল, লটকোন, শরিফা, আমড়া, মিষ্টি তেঁতুল, খাট জাতের নারিকেল অন্যতম।ফল বাগান পরিকল্পনায় করণীয়

১. যেখানে নতুন বাগান সৃষ্টি করা হবে তার অবস্থান, মাটির প্রকার, মাটির পিএইচ, বন্যামুক্ত, মাটির নিচের পানির স্তরের গভীরতা ও পরিবেশ সম্বন্ধে বিস্তারিত ধারণা নিয়ে বাগান স্থাপন  উপযুক্ততা নির্ধারণ করা।

২. যে ফলের বাগান স্থাপন করা হবে তার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক উন্নত জাতের চারা/কলম নিজে তৈরি অথবা নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ ব্যবস্থা  নিশ্চিত করা।

৩. মানুষ ও গরু ছাগলের হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য বেড়া দিয়ে ফসল রক্ষা ব্যবস্থা শুরুতেই নিশ্চিত করা।

৪. বছরের কোন সময় কি ধরনের পরিচর্যা গ্রহণ, পরিমিত  সার প্রয়োগ, রোগ-পোকা দমন, পানি সেচ, নিষ্কাশন ব্যবস্থা ইত্যাদি কাজগুলো কোন অভিজ্ঞ ব্যক্তি দ্বারা, কখন  সমাধা করা হবে তার একটা বার্ষিক ওয়ার্ক  প্লান/ ক্যালেন্ডার তৈরি করা।

৫.দীর্ঘমেয়াদি/জীবী ফল বাগান সৃষ্টিতে অন্তর্বর্তীকালীন/ বাগানের ফাকে কোন মৌসুমে/সময়ে/মৌসুমি ফসল/ স্বল্পমেয়াদি কি ধরনের ফল আবাদ করা হবে এবং তা ফল বাগানের জন্য কতটুকু উপকারী/অপকারী তা খতিয়ে দেখা এবং তা কতটা লাভজনক তা বিবেচনায় নেয়া।

৬. আম, লিচু, ড্রাগন ফল, কাগজিলেবু এ ধরনের  ফল গাছ আলো সুবিধা যুক্ত উন্মুক্ত স্থানে এবং আনারস, লটকোন, শরিফা, সিডলেস/এলাচি লেবু এ ধরনের ফল আধা ছায়ায় ভালো হয়, কাজেই ফল আবাদ পরিকল্পনায় এসব দিকগুলো বিবেচনায় নেয়া।

৭. পেঁপে, কাঁঠাল, আমড়া, শরিফা, আতা এ ধরনের ফল বাগানে গোড়ায় পানি জমলে গাছ  মারা যায় এবং নারিকেল, সুপারি খেজুর জাতীয় গাছের গোড়ায় রস কমে গেলে গাছের বৃদ্ধি কমে যায় যা শুরুতেই এসব গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো বিবেচনায় নেয়া।

৮. বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফল আবাদে অবশ্যই বাজারজাতকরণ সুবিধাসহ, ফল সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্যাকিং পরিবহন ইত্যাদির সুব্যবস্থা শুরুতেই নিশ্চিত করা।

৯. যেসব ফলের স্ত্রী পুরুষ গাছ (তাল, লটকোন, পেঁপে) আলাদা (ডায়োসিয়াস) সেগুলোর প্রায় ১৫টা স্ত্রী গাছের জন্য একটা পুরুষ গাছ রেখে পরাগায়নে অনুকূল ব্যবস্থা নেয়া।

১০. ফল বাগানের বেড়ায় বাগান বিলাস, লেবু, কদবেল, বাবলা, খেজুর এসব কাঁটা জাতীয় গাছের চারা কলম ঘন করে লাগিয়ে ০১ মিটার উচ্চতা রেখে হেজ?তৈরি করে জীবন্ত বেড়ার সৃষ্টি করতঃ এ বেড়ার ভেতরের অংশে ২ মিটার দূরত্বে আমড়া, বারমাসী সজিনা, সুপারি লাগিয়ে দু’বছরের মধ্যে এগুলোকে পিলার বা বেড়ায় খুঁটির হিসেবে ব্যবহার করা এবং তা থেকে বাড়তি ফলন প্রাপ্তি ব্যবস্থা নেয়া।

১১. প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ মালিকে বাগানের কাজে ব্যবহার করা, প্রয়োজনে হর্টিকালচারে জ্ঞান সম্পন্ন বিশেষজ্ঞ এর নিয়মিত পরামর্শ নেয়া।

জমি নির্বাচন ও তৈরি : অধিকাংশ ফলই বহুবর্ষজীবী, এজন্য ফল বাগান স্থাপনে বন্যামুক্ত, পানি সেচ নিকাশ সুবিধা যুক্ত, উঁচু স্থান নির্বাচন প্রয়োজন। দোঁ-আশ ও বেলে দোঁ-আশ মাটি ফল চাষের জন্য বেশি উপযোগী। লোনা ভাবাপণ্ন মাটি ফল চাষে অনুপযোগী তবে সফেদা, আমড়া, নারিকেল, বিলাতি গাব, গাব, কাউফল, পেয়ারা, সবরি কলা এসব ফল গাছ কিছুটা লবণাক্ত সহিষ্ণু। যেসব স্থানে পানির স্তর (ওয়াটার টেবিল) অনেকটা কাছাকাছি তথায় গভীর মূল বিশিষ্ট (কাঁঠাল, আম, জাম) ফল চাষে অনুপযোগী। তবে এ ধরনের জমিতে গুচ্ছ মূল বিশিষ্ট (নারিকেল, সুপারি, তাল, খেজুর) এবং স্বল্পমেয়াদি ফল (লেবু, কমলা, পেয়ারা) আবাদ করা যায়। বেশির ভাগ ফল গাছের গোড়ায় সাময়িকভাবে পানি জমে থাকলে গাছ মরে যাওয়ার ভয় থাকে তবে কূল, লিচু, তাল, খেজুর এ ধরনের ফল গাছের প্রতিকূল অবস্থা সহিষ্ণুতা গুণ, কিছুটা আছে। শুরুতেই জমি গভীর ভাবে চাষ দিয়ে মাটি ওলাট-পালট করে আগাছা মুক্ত রেখে জমিকে ১০-১২ দিন রোদ খাওয়ালে অনেকটা পোকামাকড় ও রোগজীবাণু মুক্ত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

বাগান ‘লে-আউট’, রোপণ দূরত্ব ও মাদা তৈরি : জমি তৈরি ও প্রাথমিক সার (ব্যাসাল ডোজ) প্রয়োগের পর জমিকে অনেকটা সমান করে নিয়ে যে ধরনের ফল গাছ লাগানো হবে তার জন্য সঠিক দূরত্বে চতুর্ভুজ, আয়তাকার, ত্রিকোনি অথবা ষড়ভূজি পদ্ধতি অবলম্বন করে সঠিক দূরত্বে (লে-আউট করে) নির্ধারিত পয়েন্টে কাঠি পুঁতে গাছ রোপণ পয়েন্ট নির্ধারণ করা দরকার। এরপর তথায় গাছের ধরন ও মাটির প্রকার ভেদে বৃত্তাকার গর্ত তৈরি করে ১০-১২ দিন রেখে তাতে রোদ খাওয়ানোর পর সার ও মাটি মিশিয়ে গর্ত ভরাট  করা প্রয়োজন। বড় ধরনের গাছের ( আম, কাঁঠাল, লিচু) জন্য রোপণ দূরত্ব হবে প্রায় ৯-১১ মিটার এবং গর্তের মাপ হবে প্রায় ৮৫-৯০ সেমি. চওড়া এবং ৭৫-৮০ সেমি গভীর। মাঝারি ধরনের গাছের (কূল, খাট জাতের আম/নারিকেল, পেয়ারা) জন্য রোপণ দূরত্ব হবে ৫-৬ মিটার এবং গর্তের মাপ হবে চওড়ায় ৭৫-৮০ সেমি. এবং গভীরতায় ৬০-৭৫ সেমি.। ছোট আকারের গাছের (ডালিম, শরিফা, লেবু) জন্য দূরত্ব হবে (৩-৪) মিটার এবং গর্তের মাপ হবে ৬০-৭৫ সেমি. চওড়া এবং ৫০-৬০ সেমি. গভীর। মাটি এঁটেল বা কিছুটা কংকরময় হলে গর্তের মাপ ২৫% বাড়াতে হবে এবং প্রতি গর্তে কমপক্ষে ৪-৫ ঝুড়ি বালি এবং ৪-৫ ঝুড়ি গোবর/কম্পোস্ট মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে।

চারা/কলম সংগ্রহ : অধিকাংশ ফল গাছই অনেকটা স্থায়ী ধরনের এবং এর ফলন অনেক ক্ষেত্রে ৫০ বছরেরও অধিক কাল পর্যন্ত পাওয়া যায়। এজন্য নিজের তৈরি অথবা জানা-শোনা নার্সারি থেকে উন্নত জাতের চারা/কলম সংগ্রহ করা একান্ত কর্তব্য। বিনামূল্যে পাওয়া গেলেও কোন অনুন্নত বা অজানা জাতের ফল গাছ লাগানো ঠিক নয়। সুস্থ, সবল, ভালো গঠনের, চারা/কলম নির্বাচন করা দরকার। রোগ, পোকায় আক্রান্ত, দুর্বল, কাণ্ড চিকন, বাঁকা-তেড়া, ছায়ায় সংরক্ষিত চারা/কলম কোন মতেই সংগ্রহ করা উচিত হবে না।

রোপণ সময় ও পদ্ধতি : বর্ষার আগে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস) ফল গাছ লাগানো উত্তম। সেচ ও পানি নিকাশ সুবিধা থাকলে সারা বছরই গাছ লাগানো যায়। বিকাল বেলা গাছ লাগানো ভালো। চারা/কলম লাগানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন কোন ক্রমেই গাছের গোড়ায় শিকড়সহ মাটির বলটি ভেঙে না যায়। পলিথিন ব্যাগে চারা/কলম সংরক্ষিত থাকলে পলিব্যাগটি ছুরি বা ব্লেড দিয়ে সাবধানে তা অপসারণ করতে হবে। টব ছাড়ানো অসুবিধা হলে গাছের গোড়ায় মাটি ঠিক রেখে সাবধানে টবটি ভেঙে ফেলা ভালো। চারা/কলমের গোড়ায় যে পর্যন্ত মাটি থাকে গাছ লাগানোর সময় ঠিক ততটুকু মাদায় পুঁতে  মাটি দিয়ে ভালোভাবে চেপে সদ্য লাগানো গাছটিকে সোজা ও শক্ত রাখার ব্যবস্থা করতে হয়। গাছ লাগানোর আগে নিচে থেকে গজানো কিছু অপ্রয়োজনীয় ডাল এবং কিছু পাতা কমিয়ে দেয়া ভালো। ঝড় বাতাসে গাছের গোড়া নড়ে গাছ যেন মারা না যায় এজন্য গাছের গোড়ায় ০৮-১০ সেমি. দূরে একটা শক্ত কাঠি গেড়ে গাছকে সোজা করে বেঁধে রাখা দরকার। গাছ লাগিয়ে গাছের পাতায় ও গোড়ায় পানি দেয়া প্রয়োজন। প্রথম ৫/৭ সপ্তাহ গাছে গোড়ায় ও পাতায় প্রতিদিন পানি দিতে হয়। সম্ভব হলে গাছ লাগানোর প্রথম ৩/৪ সপ্তাহ আধা ছায়া দেয়ার ব্যবস্থা রাখা ভালো।

সার প্রয়োগ : গাছের ঠিকমতো বৃদ্ধি ও ফলদান ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রতি বছর গ্রীষ্মের প্রারম্ভে  (বৈশাখ মাসে) ও বর্ষার শেষে (ভাদ্র মাসে) ফল গাছে নিয়মিত সার প্রয়োগ করা উচিত। গাছের গোড়ার চারদিকের মাটি আলগা করে পরিমাণ মতো জৈব ও রাসায়নিক সার ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হয়। এ সময় মাটিতে রস কম থাকলে সার দেয়ার পর অবশ্যই পানি সেচ দেয়া প্রয়োজন। গাছ লাগানোর ১০-১৫ দিন আগে গর্তের মাটির সাথে জৈব সার, টিএসপি এবং অর্ধেক পরিমাণ পটাশ সার প্রয়োগ করা যেতে পারে (টেবিল-৪)। ইউরিয়া ও বাকি অর্ধেক পটাশ সার গাছ লাগানোর ২-৩ মাস পরে উপরিপ্রয়োগ করা ভালো। অনেকে বয়স্ক গাছের একেবারে গোড়ায় সার প্রয়োগ করে থাকেন। তাতে এ সার গাছের তেমন উপকারে আসে না। কেননা, সার গ্রহণে সম শিকড় (রুট হেয়ার) বড় গাছের গোড়া থেকে বেশ দূরে (গাছের প্রকার ভেদে ১-৪ মিটার) থাকে। এজন্য দুপুর বেলা গাছের নিচে যে পর্যাপ্ত ছায়া পড়ে, গোড়া থেকে সে অংশ পর্যন্ত মাটি ভালোভাবে কুপিয়ে সমগ্র অংশে সার প্রয়োগ করা উচিত। গাছের গোড়া থেকে কিছু দূরে (যে পর্যন্ত গাছের ছায়া পড়ে তার মাঝ বরাবর) বৃত্তাকারে ৩০ সেমি. চওড়া এবং ১৫-২৫ সেমি. গভীর করে তৈরি নালায় সার সার মিশ্রিত মাটি দিয়ে ভরাট করে সেচ দেয়া প্রয়োজন। গাছ প্রতি সার প্রয়োগ পরিমাণ নির্ভর করে জমির উর্বরতা শক্তির ওপর। উর্বর মাটিতে অপেক্ষাকৃত কম এবং অনুর্বর মাটিতে বেশি পরিমাণ সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। সব বয়সের গাছের সারের চাহিদার পরিমাণ সমান নয়। গাছ বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারের চাহিদার পরিমাণ বাড়তে থাকে। গাছের প্রকার ভেদে প্রতি গর্তে/মাদায় যে পরিমাণ সার প্রয়োগ প্রয়োজন তা মোটামোটি নিম্নরূপ-

টেবিল-৪ : গাছ লাগানোর ১২-১৫ দিন আগে প্রতি মাদায় সার প্রয়োগের পরিমাণ

গাছ লাগানোর সময় মাদায় যে পরিমাণ সার প্রয়োগ করা হয় তার চেয়ে পরবর্তী বছরগুলোতে (গাছের প্রকার ভেদে ১ থেকে ৮ বছর  পর্যন্ত) প্রতি বছর সার প্রয়োগ পরিমাণ বাড়াতে হয়। এ বৃদ্ধির হার হতে পারে নিম্নরূপ (টেবিল-৫ দেখুন) টেবিল-৫ এর অনুরূপ।

বছর বছর সারের পরিমাণ বাড়ানোর পর শেষ বছরের (৮,৫ বা ৩য় বছর) সুপারিশকৃত সারের ডোজ পরবর্তী বছরগুলোতে অব্যাহত রাখতে হবে। আঁশ জাতীয় (নারিকেল, খেজুর, তাল, সুপারি) গাছে পটাশ জাতীয় সারের চাহিদা বেশি। এজন্য এ ধরনের গাছের ক্ষেত্রে পটাশ জাতীয় সারের পরিমাণ ৩০% বাড়াতে হবে। বছরে দু’বার সার প্রয়োগের পরিবর্তে ৩ মাস পরপর ৪ বার প্রয়োগ করা উত্তম। এক্ষেত্রে প্রতিবার সুপারিশকৃত ডোজের এক চতুর্থাংশ প্রয়োগ করতে হবে। মে-জুন মাসে প্রতি ফল গাছের গোড়ার চারিদিকে বৃত্তাকার অগভীর নালায়  ১০০ গ্রাম দোল চুন/ দোলামাইট (ম্যাগনেশিয়াম + সামান্য ক্যালসিয়াম) এবং ৩০০ গ্রাম সাধারণ চুন (ক্যালসিয়াম) মিশিয়ে গাছের গোড়ার চারিদিকে তৈরি নালায় প্রয়োগে গাছের ম্যাগনেশিয়াম ও ক্যালসিয়ামের চাহিদা মিটাবে। মাটির পিএইচ ৬.৫ বা তার নিম্নে হলে জিপসাম (সালফার) ব্যবহার করলে মাটির অম্লতা আরও বৃদ্ধি পাবে। সে ক্ষেত্রে প্রতি গাছের গোড়ার চারদিকে প্রায় ৪০০ গ্রাম সাধারণ চুন ব্যবহারে মাটির অম্লতা বৃদ্ধি রোধ হবে। অম্ল মাটিতে কতগুলো অনু খাদ্য প্রয়োগ করলে তা গাছ গ্রহণে সক্ষম হয় না। এজন্য বোরন ও দস্তা সার ফোলিয়ার সেপ্র করে অভাব পূরণ করা উচিত হবে।

পানি সেচ ও নিকাশ : বর্ষাকালে ফল গাছের গোড়ায় যেন পানি না জমে এজন্য নালা কেটে বাড়তি পানি বের করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিশেষ করে পেঁপে, আনারস, কাঁঠাল, আমড়া, ড্রাগন ফল, স্ট্রবেরি এ ধরনের গাছের গোড়ায় পানি জমলে গাছ মারা যাবে। শুকনা মৌসুমে অবশ্য ফল গাছে নিয়মিত পানি সেচ দেয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। মাটিতে রস কমে গেলে  নারিকেল, সুপারি, ড্রাগন ফল, পেঁপে, কলা গাছ ঠিকমত বাড়ে না, ফল দান ক্ষমতা কমে যায়। আম গাছে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে সেচ দিলে গাছে ফুল ধারণ ব্যাহত হয়। শুকনা মৌসুমে গাছের গোড়া থেকে ৪০-৬০ সে.মি. দূর পর্যন্ত বৃত্তাকারে মাটি হালকাভাবে কুপিয়ে লতাপাতা, কচুরিপানা, তুষ, নারিকেলের ছোবড়া, চিনাবাদামের খোসা দিয়ে মালচিং ব্যবস্থা নিলে গোড়ায় ঘাস জন্মে না, রস সংরক্ষিত থাকে, ঘনঘন পানি দেয়ার প্রয়োজন হয় না, পরবর্তীতে এগুলো পচে জৈব সারের কাজ করে, গাছের জন্য পরিবেশ অনুকূল হয়।

পরিচর্যা : ফল বাগান সবসময় আগাছা মুক্ত রাখা দরকার। পানি দেয়ার ফলে গোড়ার মাটির উপরিভাগ শক্ত হয়ে যায়, মাটিতে বাতাস চলাচল করতে, শিকড় ছড়াতে এবং মাটিতে রস সংরক্ষণ ব্যাহত হয়। এ অবস্থার উত্তোরণে গাছের গোড়ার চারদিক হালকাভাবে কুপিয়ে মাটি আলগা রাখা প্রয়োজন। গাছ যেন বাতাসে হেলে না পড়ে এ জন্য গাছে খুঁটি দিয়ে সোজা রাখতে হবে।

ট্রেনিং প্রুনিং : গাছ লাগানোর শুরু থেকেই গাছের গোড়ায় গজানো অতিরিক্ত ডালসহ, রুগ্ন, দুর্বল, অফলন্ত ডাল নিয়মিত ছাঁটাই করে গাছকে সুন্দরভাবে বাড়তে ও আলো বাতাস চলাচল সুবিধা করে দিতে হবে। ছোট আকারের গাছের (লেবু, কমলা) ৫০ সেমি. মধ্যে গোড়ায় গজানো ডাল ছেঁটে গাছের কাঠামো ঠিক করে নেয়া দরকার। অনুরূপভাবে মাঝারি আকারের গাছের (পেয়ারা, বাতাবি লেবু) ৮০ সেমি. মধ্যে এবং বড় ধরনের গাছের (আম) এক মিটারের মধ্যে কাণ্ডে কোন শাখা-প্রশাখা গজাতে দেয়া ঠিক হবে না। বিশেষ করে কাঁঠাল, জাম, আমড়া, গুটি আম এ ধরনের গাছে ৩ মিটারের মধ্যে শাখা কেটে গাছের লম্বা সোজা কাণ্ড তৈরী করা প্রয়োজন।  তাতে গাছের টিম্বার ভ্যালু বাড়বে। কূল সংগ্রহের পর এক-দেড় মিটার রেখে সম্পূর্ণ ডাল ছাঁটাই করা  অত্যাবশক। তাতে নতুন গজানো ডালে ফুল ফল বেশি ধরে। লিচু সংগ্রহের পর গাছের আগার ৩০ সেমি. ডাল সম্পূর্ণ ছাঁটাই করে দিলে পরের বছর ফল বেশি দিবে। কাঁঠাল গাছের কাণ্ড ও প্রধান ডালগুলো থেকে গাজানো ডাল এবং কাঁঠাল ফলের বোঁটার অবশিষ্ট অংশ বাকল বরাবর ধারাল ছুরি দিয়ে ছেঁটে ফেলতে হবে। এ কাজ কাঁঠাল সংগ্রহের পর আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে সমাধান করা প্রয়োজন। নারিকেল, তাল, খেজুর, সুপারি, কলা গাছের পাতা হলুদ হয়ে শুকানো আরম্ভ হওয়ার আগে সবুজ অবস্থায় কোন মতেই পাতা কাটা ঠিক না। নারিকেল গাছের ছোবড়া পরিষ্কার করে পাতার গোড়ার সাদা অংশ বের করা ঠিক নয়। খেজুর গাছে রস সংগ্রহে যে পরিমাণ কর্তন করা হয় তার মাত্র ২৫% ছিললেই সম পরিমাণ রস পাওয়া  যায়। বেশি কাটলে, গাছ বেশি দুর্বল হয়, পরবর্তী বছরে  গাছের রস দান ক্ষমতা কমে যায়।

পোকামাকড় ও রোগ বালাই দমন : ফল আবাদে সীমিত আকারে প্রয়োজনে কীটনাশক/ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে। কেমিক্যাল ব্যবহারে খেয়াল রাখতে হবে যেন উহা মানুষ/পশুপাখির জন্য তির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। বরং তথায় আইপিএম পদ্ধতি অনুসরণ করে ক্ষতিকারক পোকামাকড়/ রোগবালাই নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে

১. ফল বাগানে প্রাথমিক অবস্থায় পোকা সংখ্যায় কম থাকে বিধায় তা সংগ্রহ করে মেরে ফেলাই ভালো।

২. আক্রান্ত পাতা বা ডাল পালার অংশ ছেঁটে পুড়িয়ে ফেলা উচিত।

৩. ঠিকমতো চাষ দিয়ে ওলট-পালট করে ১০-১৫ দিন রোদ খাওয়ানো হলে  অনেক পোকা ও রোগের জীবাণু ধ্বংস হয়।

৪. রাতে বিচরণকারী পোকা আলোর ফাঁদ পেতে মেরে ফেলা একটা উত্তম উপায়।

৫. বাগানের আশপাশে ঝোঁপ-জঙ্গল থাকলে সেখানে রোগ ও পোকার বংশ বৃদ্ধির আড্ডা হয়। কাজেই, এসব অংশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখলে রোগ পোকার উপদ্রব  কমবে।

৬. সুযোগ থাকলে  বাগান ২-৪ দিন পানিতে ডুবিয়ে রাখলেও অনেক পোকা  ও রোগ জীবাণু ধ্বংস করা যায়।

৭. অন্তর্বর্তী (ইন্টার ক্রপ) ফসল আবাদে বাগানে একই জাতীয় ফসল বার বার না ফলিয়ে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ধরনের ফসল আবাদ করে ফসল চক্র পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে ফসলের পোকা ও রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

৮. ফসল সংগ্রহ শেষে খড় কুটো রেখে আগুন ধরিয়ে দিলে অনেক পোকা ও রোগ জীবাণু ধ্বংস হয়। একই ভাবে মশাল জ্বালিয়ে ফল বৃক্ষের গোড়া ও মোটা ডালের অংশে তাপ দিলে অনেক পোকা ও রোগ জীবাণু ধ্বংস হবে।

৯. সেঙ ফেরমন ফাঁদ একবার ব্যবহার করে ৬-৮ সপ্তাহ পর্যন্ত পুরুষ পোকা (মথ) ধ্বংস করে পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পরিবেশ সহায়ক আধুনিক এ ব্যবস্থা প্রয়োগ করা প্রয়োজন।

১০. রোগ পোকার উপদ্রব বেশি বাড়লে তা দমনে সঠিক মাত্রায়, সঠিক রোগবালাই নাশক ব্যবহার করে আক্রমণের ব্যাপকতা নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।

ফল পাতলাকরণ ও ফসল সংগ্রহ : কলম করা গাছে প্রথম বছর থেকেই ফুল ও ফল ধরতে পারে। তাতে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। এ জন্য ফুল আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম ২/১ বছর এগুলো ভেঙে ফেলা উচিত। বয়স্ক গাছে খুব বেশি ফল ধরলে গাছ কাহিল হয়ে পড়ে, ফলের আকার ছোট হয়, ডাল ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য ফল ভর্তি গাছের অপেক্ষাকৃত ছোট ও দুর্বল ফল প্রথম অবস্থায় পেড়ে কমিয়ে ফেলা উচিত। গাছ থেকে ফল সংগ্রহের সময় সাবধান হওয়া দরকার। মোচড় দিয়ে, ডাল ভেঙে অথবা গাছে বা ডালে জোরে ঝাকানি দিয়ে ফল পাড়া ঠিক নয়। এতে গাছের ক্ষত হয়, সংগৃহীত ফলের মান কমে যায়।

ফল ধরা ও ঝরার কারণ ও প্রতিকার : অত্যাধিক তাপমাত্রা, বাগানের মাটিতে রসের অভাব, জলাবদ্ধতা, অতিমাত্রায় সার প্রয়োগ, খাদ্য ও হরমোন ঘাটতি, রোগ-পোকার আক্রমণ এবং সময় উপযোগী পরিচর্যার অভাবই ফল কম ধরা ও ঝরার প্রধান কারণ। এছাড়া অনুখাদ্য ও হরমোনের ঘাটতির কারণে ফুল-ফল ঝরে। কাজেই ঝরা রোধে গাছে ফুল আসার ১০ দিন আগে প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ মিলি. হারে নাফা (এতে আছে প্রধান ও অপ্রধান খাদ্যসহ হরমোন) স্প্রে করা উচিত। এরপর ফুল আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি. হারে লিটোসেন (এতে আছে অনুখাদ্য+ হরমোন এবং পরাগায়নে ক্ষত না করার গুণ) ১ মিলি. এগবেন এবং ০.৫ মিলি. ইমিটাফ এ তিনটি একত্রে মিশিয়ে সেপ্র করা প্রয়োজন। ফল ধরা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ৭-১০ দিন ব্যবধানে ২-৩ বার এ সেপ্র অব্যাহত রাখতে হবে। একমাস পর পর প্রতি লি. পানিতে ৪ গ্রাম হারে একবার কৃপ্রাভিট (কপার দলীয়) এবং পরের বার প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি. হারে ড্যাট গ্রো (সালফার দলীয়) মিশিয়ে সেপ্র করে গাছকে রোগ মুক্ত করে বাগান নিরাপদ  রাখা যায়।

ফুল-ফল ঝরা কমানো এবং ফল ধরতে সহায়তার জন্য গাছে ফুল আসার আগে ২৫ দিনের ব্যবধানে দু’বার প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি ফোরা মিশিয়ে গাছ ভালোভাবে সেপ্র করতে হবে। ফল ধরা আরম্ভ হলে তৃতীয় বারের মতো তা দিয়ে সেপ্র কাজ সমাধা করতে হবে। এ সময় ফোরা হরমোনের সঙ্গে মটিভাস (প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি) মিশিয়ে সেপ্র করলে ফল গাছের সুস্বাস্থ্য ফিরবে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে তৃতীয় বার শুধু ফ্লোরা সেপ্র করার ২০ দিন পর প্রতি লিটার পানিতে ১ মিলি. লিটোসেন এবং ১ মিলি. মটিভাস মিশিয়ে স্প্রে করলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে।

রেস্টুরেন্ট, বাসাবাড়ি, অফিস, খালি জায়গা জমিতে বাগান করতে চাচ্ছেন?

কিন্তু কীভাবে করবেন ?কোথায় থাকে করবেন? সকল প্রকার পরামর্শ নিয়ে আমরা আছি আপনার সাথে।

হটলাইন নাম্বারঃ- 01810-198999

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

4 × three =