কোন পথে দেশের প্রথম সারির ন্যাশনাল ব্যাংক

0
116

এমএম তোহাঃ কোন পথে এগুচ্ছে দেশের প্রথম সারির ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক।

ব্যাংক কোম্পানি আইনে প্রদত্ত ক্ষমতা বলে , গত  বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) এক আদেশে প্রথম প্রজন্মের বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

এর পরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমস্যাজর্জরিত ব্যাংকটির জন্য সাত সদস্যবিশিষ্ট নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে। নতুন পর্ষদে কারা থাকছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক  তা-ও আলাদা সার্কুলারে জানিয়ে দিয়েছে।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের লঙ্ঘন, আর্থিক অবস্থার অবনতি, ঋণ প্রদানে অনিয়ম এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) হঠাৎ পদত্যাগের প্রেক্ষাপটে ২০১৪ সালের ৪ অক্টোবর ন্যাশনাল ব্যাংকের (এনবিএল) পর্ষদে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিগত ৯ বছর পর্যবেক্ষক থাকলেও  ব্যাংকটির অবস্হার কার্যকর কোন উন্নতি হয়নি।

ব্যাংকটির মালিকানায় থাকা সিকদার গ্রুপ এবং সিকদার পরিবারের বিরুদ্ধেই ছিল অনিয়ম, বহুমুখী দূর্নীতির অভিযোগ। শেষ পর্যন্ত সিকদার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে  ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ইতিপূর্বে ২০০৩ সালে বেসরকারি খাতের  ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক একই প্রক্রিয়ায়  উদ্ধার করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

 ৯ বছর ধরে এসব অনিয়ম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে থাকা সত্ত্বেও কেন প্রশ্রয় দিল এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞগন।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর গনমাধ্যমকে  বলেন, “ব্যাংকটিতে রাখা মানুষের গচ্ছিত টাকা শেষ করার পর এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিলম্বে হলেও সিদ্ধান্তটি ভালো হয়েছে। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এই ক্ষমতা সব সময় ছিল, কিন্তু তারা সময়মতো এটা প্রয়োগ করেনি। সময়মতো সিদ্ধান্ত না নেওয়ার ব্যয় বহন করা হয় জনগণের টাকা দিয়েই।“

তিনি আরও বলেন, “এখন ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোতে অনুরুপ  কায়দায় লুট হচ্ছে, ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো টাকার জোগান দিয়েও সতর্ক করে দায় সারছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।এর মাশুলও গুনতে  হবে জনগণকে।

সময়মতো ব্যবস্থা নিলে  কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ব্যাংক খাত ও সরকারের ওপর মানুষের আস্থা বাড়ত।’

যা বলা হয়েছে গভর্নরের আদেশে

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার আদেশ জারি করে গতকালই ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডির কাছে সার্কুলার পাঠিয়েছেন। গভর্নরের পাঠানো সার্কুলারে ব্যাংকটি পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেন।

গভর্নরের পাঠানো সার্কুলারে বলা হয়েছে, ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক ঋণের নিয়ম ও বিধিবিধান লঙ্ঘন করে ঋণ অনুমোদন, পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ করন, পর্ষদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যাংকের শেয়ার একই পরিবারে কেন্দ্রভুত করন , পরিচালক নির্বাচন বা পুনর্নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জটিলতা সৃষ্টি করন , পর্ষদের গোচরে পরিচালকগণ কর্তৃক আর্থিক অনিয়ম সংঘটন করন, পর্ষদের নীতিনির্ধারণী দুর্বলতার কারণে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অবনতি, ব্যাংকিং সুশাসন ও শৃঙ্খলা বিঘ্ন করার মাধ্যমে ব্যাংক-কোম্পানি ও আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে পর্ষদ কর্তৃক সম্পৃক্ত থাকার ঘটনা সংগঠিত হয়েছে।

এ জন্য বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সুপারিশে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা ও জনস্বার্থে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করা হলো বলে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের দেওয়া আদেশে বলা হয়েছে।

পর্ষদ বাতিলের এই আদেশ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জানানোর জন্য ব্যাংকটির এমডিকে নির্দেশ দিয়েছেন গভর্নর।  ব্যাংকটির এমডি মেহমুদ হোসেন গনমাধ্যমকে বলেন, “আমরা পর্ষদ সদস্যদের বিষয়টি অবহিত করেছি।

পাশাপাশি নতুন পরিচালকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছি। আশা করছি প্রক্রিয়া শেষে তাঁরা দ্রুতই দায়িত্ব বুঝে নিবেন। ব্যাংকটি শিগগির ঘুরে দাঁড়াবে, এই আশা করছি”।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক গনমাধ্যমকে বলেন, ব্যাংকটির পর্ষদের দায়িত্ব ছিল আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা। কিন্তু তারা সেটি না করতে পারায় আগের পর্ষদ বাতিল করে নতুন পর্ষদ গঠন করে দেওয়া হয়েছে।

নতুন পর্ষদে যাঁরা

গতকালই  বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন পর্ষদ গঠন করে ব্যাংকটির এমডিকে চিঠি দিয়েছে। এতে নতুন তিনজন স্বতন্ত্র পরিচালকের পাশাপাশি চারজন শেয়ারধারী পরিচালককে রাখা হয়েছে।

আকুন্ঠ দূর্নীতি ও ক্ষমতা কেন্দ্রিক দ্বন্দে লিপ্ত   জয়নুল হক সিকদারের স্ত্রী মনোয়ারা হক সিকদার এবং দুই পুত্র পরিচালক রন হক সিকদার, রিক হক সিকদার, নাইমুজ্জামান ভূঁইয়া ও মুরশিদ কুলি খান বাদ পড়েছেন। এদের মধ্যে প্রথম তিনজন শেয়ারধারী পরিচালক এবং বাকি দুজন স্বতন্ত্র পরিচালক ছিলেন।

নতুন পরিচালনা পর্ষদে যাঁরা স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম ও সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম কামাল হোসেন।

নতুন এই পর্ষদের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়েছে অধ্যাপক সৈয়দ ফারহাত আনোয়ারকে। মেঘনা ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগের শর্তে তাঁকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

নতুন পর্ষদে শেয়ারধারী চার পরিচালক হলেন জয়নুল হক সিকদারের মেয়ে পারভীন হক সিকদার, উদ্যোক্তা পরিচালক খলিলুর রহমান, সিকদার ইনস্যুরেন্স কোম্পানির পক্ষে প্রতিনিধি পরিচালক মো. সফিকুর রহমান ও উদ্যোক্তা শেয়ারধারী পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন।

এদিকে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ গনমাধ্যমকে বলেন, “ব্যাংকটিকে রক্ষা করতে আমরা বুধবারই বৈঠক করে বর্তমান পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নিই। 

এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছি। আমরা মনে করি, এতে ব্যাংকটির গ্রাহকদের পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থও রক্ষা হবে”।

পর্ষদ ভাংগার নেপথ্য কারন

জয়নুল হক সিকদার ১৯৮৩ সালে এ ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত করেন। তারা মৃত্যুর পর তার সন্তানরা উত্তরাধিকার সূত্রেই ব্যাংটির পরিচালক হন।তার মৃত্যুর পরপরই পরিচালকরা ক্ষমতার লড়াইয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পরেন। এ কারণে সংকটে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকের সংকট আরো ঘনিভূত হতে থাকে।

সম্প্রতি ব্যাংকের অন্যতম পরিচালক পারভীন হক সিকদার আচ করতে পারেন  ‘প্রহসনমূলক ভোটে’ পরিচালক পদ থেকে তাকে বাদ দেয়া হতে পারে। এ আশংকায়তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) চিঠি দিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অধীনে এজিএম অনুষ্ঠানের দাবি জানান।

পারভীন হক সিকদারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকটির ৪০তম বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) আয়োজনের ওপর আগামী ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থিতাবস্থা জারি করেন চেম্বার আদালত।

ওই দিন আপিল বিভাগে এ বিষয়ে শুনানি আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম গত মঙ্গলবার আদেশটি দেন। এই আদেশের ফলে গতকাল বৃহস্পতিবার ব্যাংকটির এজিএম স্হগিত হয়ে যায় ।

ন্যাশনাল ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন পারভীন হক প্রয়াত  জয়নুল হক সিকদার মেয়ে । পরে তাঁর পরিবারের সদস্যরা ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদে আসেন।

জয়নুল হক সিকদারের স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার ছিলেন ভেঙে দেওয়া পর্ষদের চেয়ারম্যান। রন হক সিকদার এবং রিক হক সিকদার তাঁর দুই ছেলে। উদ্যোক্তারাই এই ব্যাংকটি ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে নিয়ে যায়।

ব্যাংকটির বর্তমান এমডি মেহমুদ হোসেন পদত্যাগও করেছিলেন। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপে তিনি আবার ব্যাংকে ফেরেন।

ন্যাশনাল ব্যাংকে নানা অনিয়ম ও এমডির পদত্যাগের ঘটনা অবশ্য নতুন নয়।ব্যাংকটিতে সিকদার পরিবার এতটাই বেপরোয়া ছিলো গত দেড় দশকে ব্যাংকটির বেশির ভাগ এমডিই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগ করে চলে বাধ্য হয়েছেন।

এনবিএলের আর্থিক অবস্থা

বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এনবিএল এর তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ১৩ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৩১ শতাংশ।

এ ছাড়া অবলোপন করা খেলাপি ঋণ রয়েছে ১ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা। এছাড়া ৭ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা নিয়মিত দেখানো হলেও এর বিপরীতে কোনো আয় নেই।

 সব মিলিয়ে ২২ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা বা ৫৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ ঋণের বিপরীতে কোনো আয় পাচ্ছে না ব্যাংকটি। এদিকে মোট ঋণের মধ্যে ২৪ হাজার ৭১৭ কোটি টাকা বা ৫৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ যার পরিমাণ রয়েছে শীর্ষ ৩০ গ্রাহকের কাছে, যাঁদের মধ্যে কাগুজে প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।

এত বড় ধরণের দূর্নীতির সাথে ব্যাংকটির উদ্যোক্তা পরিচাকরা কোন না কোন ভাবে জড়িত বলে একাধিক সুত্র জানিয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকও দায় এড়াতে পারে না।

গত এক দশক ব্যাংকটিতে একের পর সমস্যা চলমান। তারা যথা সময়ে উদ্যোগী হলে একটি প্রথং শ্রেনীর ব্যাংকের এ দশা হতো না।

একটি প্রতিষ্ঠান শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়ানোর পর অথবা ঘটণা সংঘটিত হওয়ার পর ব্যাবস্হা গ্রহণ কোন প্রতিকার মূলক ব্যাবস্হা নয় বলে মনে করেন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞগন।

ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, একক পরিবার, ব্যক্তি বা মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান একটি ব্যাংকের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে পারে। তবে ব্যাংকটিতে সিকদার পরিবারের শেয়ার রয়েছে ১৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ।ব্যাংকিং খাত বিশেষজ্ঞগন অনেকেই এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন এ বিষয়টি কেন্দ্রিয় ব্যাংক জানতো না?

তাদের না জানিয়ে এসব করার কোন উপায় ছিল?যেহতু বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ বিষয়ে জেনেও প্রতিকার মূলক ব্যবস্হা গ্রহণ করে নি তাদেরকেও এ অপকর্মের সাথে জড়িত করে কঠোর ব্যবস্হা গ্রহণ করা উচিৎ।

প্রচলিত ধারার প্রতিটি ব্যাংককে মোট আমানতের ১৭ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা নগদ জমা (সিআরআর) ও বিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর) রাখতে হয়। তবে ন্যাশনাল ব্যাংক ১৪ মাস ধরে বিধিবদ্ধ তারল্য জমা রাখতে পারছে না।

এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ৩০০ কোটি টাকা জরিমানা করলেও ব্যাংকটি তা পরিশোধ ব্যর্থ হয় ।জানা যায়, টাকার সংকট মেটাতে এখন উচ্চ সুদে গ্রাহক আমানত সংগ্রহ করছে ন্যাশনাল ব্যাংক।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

seventeen − 11 =