গাজীপুরে গ্যাস চুরির মহোৎসব বছরে শত কোটি টাকার রাজস্ব চুরি

0
106

গাজীপুর থেকে ফিরে তৌহিদুর রহমান মোল্যা: শিল্প সমৃদ্ধ জেলা গাজীপুরে তিতাস গ্যাস চুরির মহোৎসব চলছে। খোদ সরকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেডের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও ঠিকাদাররা প্রতি বছর ১শ কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব চুরি করছে বলে ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুরের চন্দ্রা তিতাস গ্যাস অফিসের অধীনে রয়েছে কালিয়াকৈর, চান্দরা, মৌচাক, বান্নারা, কোণাবাড়ী, বারইবাড়ী, আমবাগ, বাইমাইল, কাশিমপুর, নিঃশ্চিন্তপুর, জরুন, সফিপুর, গোলবাথান, নীলনগর, তেলিরচালাসহ বিভিন্ন এলাকা। এসব এলাকা শিল্প, কলকারখানা আর ঘন জনবসতিতে পরিপূর্ণ। ওইসব স্থাপনায় বৈধ গ্যাস সংযোগের পাশাপাশি অগণিত অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছে। চন্দ্রা তিতাস গ্যাস অফিসের সহকারী কর্মকর্তা (হিসাব বিভাগ) সফিকুল আলম সফিক  ও প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা  নজরুলের সাথে ফোনালাপের তথ্য মতে, তারা মিটারযুক্ত ৫১টি এবং মিটার ছাড়া ১১ হাজার ৫শ ১০টি আবাসিক সংযোগ দিয়েছেন।

এর মধ্যে সিঙ্গেল বার্নার ২৮৯, ডাবল বার্নার ৪৫,৭৮৯টি।  এছাড়া শিল্প প্রতিষ্ঠানে ২৪টি এবং বাণিজ্যিক ভাবে সর্বমোট ১৮৮টি সংযোগ দেয়া হয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বহুতল আবাসিক ভবনের মালিকেরা গ্যাস সংযোগ, বিচ্ছিন্নকরণ ও বিল তৈরির কর্মে নিয়োজিত দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের নির্ধারিত মাসোহারা দিয়ে অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহার করছে। এদের মধ্যে কেহ বৈধ গ্যাস সংযোগের আড়ালে চোরা লাইনে গ্যাস ব্যবহার করে। আবার কেহ একটি বাড়ী বা একটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বৈধ গ্যাস সংযোগ নিয়ে চোরা পথে আরো ২/৩ টি বাড়ী অথবা প্রতিষ্ঠানে গ্যাস ব্যবহার করে। অনেকে ৫,১০ ও ২০ টা সিঙ্গেল ও ডাবল চুলার অনুমোদন নিয়ে তার দ্বিগুন, তিনগুন বেশি পরিমান চুলা ব্যবহার করছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে প্রধান হিসাব রক্ষক সহিদুল, প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা নজরুল ও সহকারী কর্মকর্তা (হিসাব) সফিক এর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তারা অপরাধ বিচিত্রা’র কাছে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। কেহ তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে বলে মন্তব্য করেন। এ প্রকৃতির দুর্নীতিবাজ অসাধু কর্মচারী কর্মকর্তা দেশ ও জনগনের দুশমন। এদেরকে দ্রæত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। অন্যথায় দুর্নীতিবাজ ও অসাধু ব্যক্তিরা সরকারি অর্থ লুটপাটে আরো উৎসাহিত হবে বলে সচেতন মহলের দাবী।

চন্দ্রা তিতাস গ্যাস অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা নজরুল ঃ ছবি অপরাধ বিচিত্রা

আবার কারো দীর্ঘ দিনের বকেয়া বিল, চোরাই পথে গ্যাস ব্যবহার ও অতিরিক্ত চুলায় গ্যাস ব্যবহারের দায়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলে, টাকার বিনিময়ে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে তাদেরকে আবার অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে। এমনকি গ্যাস লাইনের যন্ত্রাংশাও রাইজার খুলে আনার পর মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে প্রতিমধ্যে গাড়ী থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া অনেকে আবার গ্যাস সংযোগের জন্য ৩/৪ বছর পূর্বে আবেদন করে এবং ব্যাংকে ডিমান্ড নোটের টাকা জমা দেয়ার পর বৈধ সংযোগ না পেয়ে তারা ওইসব কর্মচারী, কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের নির্ধারিত এককালীন মোটা অংকের উৎকোচ দিয়ে চোরাই লাইনে বছরের পর বছর গ্যাস ব্যবহার করছে।

অপরদিকে অনেকে ওদের দ্বার সম্পূর্ণ চোরা পথে রাতের অন্ধকারে গ্যাস সংযোগ নিয়ে নির্ধারিত মাসোহারায় দীর্ঘ বছর ধরে বীরদর্পে চালিয়ে যাচ্ছে। এসব অবৈধ গ্যাস ব্যবহারকারীদের লোক দেখানো নকল ও ভূয়া বিল বই সরবরাহ করেছে ওই অফিসের দুর্নীতি বাজরা। ফলে সরকার এসব দুর্নীতিবাজ অসাধু কর্মচারী, কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের জন্য শুধুমাত্র গাজীপুর থেকেই প্রতি বছর শতকোটি টাকারও বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে। এসব দুর্নীতিবাজ ও অসাধু কর্মচারী, কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের মধ্যে যাাদের নাম উঠে এসেছে তারা হলেন, চন্দ্রা তিতাস গ্যাস অফিসের গ্যাস সংযোগ ও বিচ্ছিন্নকারী দলের অন্যতম সদস্য ও সহকারী কর্মকর্তা (হিসাব বিভাগ) এর সফিকুল আলম (সফিক), প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা নজরুল, প্রধান হিসাব রক্ষক শহিদুল, পিওন মমিন, কর্মচারী ওসমান, ইমন, গাড়ীচালক সালাম সহ আরো ২/৩ জন। এছাড়া ওই অফিসের তালিকাভুক্ত ঠিকাদারদের মধ্যে জাহাঙ্গীর, সোলাইমান ও রিপন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এ চক্রের প্রত্যেকেই কোটিপতি বনে গেছে। এর মধ্যে শফিক, নজরুল ও সহিদুলসহ প্রত্যেকের নামে-বেনামে রয়েছে শতকোটি টাকার জমি, একাধিক বহুতল ভবন, একাধিক বিলাশবহুল গাড়ী ও ব্যবসা-বাণিজ্য। এ চক্রের সবচেয়ে নি¤œ শ্রেণীর সদস্যের আর্থিক অবস্থান সম্পর্কে জানলে সবার চোখ কপালে উঠবে।

ওই তিন কর্তার অবৈধ তত্ত¡াবধানে যেসব বাড়ী মালিক, নির্ধারিত মাসোহারা দিয়ে চোরাপথে গ্যাস ব্যবহার করছে, তাদের মধ্যে মৌচাক চেয়ারম্যান বাড়ী সড়কে সফি হাজী, আনোয়ার, রাজা মিয়া, কোহিনুর, সুমাইয়া ইয়াসমিন ও জিয়াসমিন। মৌচাক আম বাগান এলাকায় সানোয়ার, সুলতান, উবায়শা উকিল, শাজাহান ও মোতালেব। মৌচাক বাজারে সফি হাজী, আইয়ুব আলী, হযরত আলী, মৌচাক ফরেস্ট অফিস সংলগ্ন বিলকিস, বান্নারা পশ্চিমপাড়া স্কুলের পিছনে সুজন, হুমায়ুন, সুভাষ পুলিশ, নিরিকের গলির ফারুক ( সোবান ফ্যাক্টরী), প্যারাসুট কোম্পানীর পিছনে  মোতাহারসহ ওইসব এলাকায় এমন হাজার হাজার অবৈধ গ্রাহকের সন্ধান মিলেছে।

প্রধান হিসাবরক্ষক সহিদুল, প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা নজরুল ও সহকারী কর্মকর্তা (হিসাব) ও সিন্ডিকেট প্রধান সফিকুল আলম অভিনব কৌশলে ও মিথ্যা নাটক করে বৈধ-অবৈধ গ্রাহকদের থেকে প্রতি মাসে কোটি-কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ভূক্তভোগী সূত্র জানায়, অতিরিক্ত চুলা ব্যবহারের দায়ে ৬ মাসের মধ্যে সংযোগ না পাওয়া সহ জরিমানার ভয়ভীতি দেখিয়ে গ্যাস লাইন বিচ্ছিন্ন করার পরই সর্বনি¤œ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও ৬ মাসের সমপরিমান বিলের টাকা নিয়ে পুনঃসংযোগ দেয়। কিন্তু কোন রশিদ প্রদান করে না। তারা ঠিকাদার জাহাঙ্গীর, সোলাইমান ও রিপন এর দলকেই বেশি ওইসব অনৈতিক কাজে ব্যবহার করে।

এছাড়া সফিকুল ব্যক্তিগত ভাবে আর্থিক লাভবান হওয়ার জন্য কখনও অফিসের লোক আবার কখনও বহিরাগত লোক দ্বারা অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। আবার লাখ-লাখ টাকা উৎকোচের বিনিময়ে তাৎক্ষনিক পুনঃসংযোগ দেয়। এছাড়াও তার একান্ত ব্যক্তিগতভাবে কয়েক হাজার অবৈধ সংযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ওইসব গ্রাহকদের থেকে তার মাসিক অবৈধ আয় কয়েক কোটি টাকা। তার এসব অবৈধ টাকা পিওন মমিন, গাড়ীচালক সালাম, কর্মচারী ওসমান ও ইমন কে দিয়ে আদায় করে থাকে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।

Print Friendly, PDF & Email

মন্তব্য করুন

Please enter your comment!
Please enter your name here

six + 9 =